রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি প্রায় তুলে দিয়ে বিজেপি সরকার যেমন মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির উপর আর্থিক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তেমনই কেরোসিনের ভর্তুকিও প্রায় তুলে দিয়ে গরিব মানুষের উপরও মারাত্মক আক্রমণ হেনেছে। অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে লিটার পিছু প্রায় সাড়ে সাত টাকা দাম বাড়াচ্ছে সরকার। ফলে রেশনে কেরোসিনের দাম ৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেল।
গৃহস্থের রান্নাঘর নিয়ে এক নিষ্ঠুর রসিকতা শুরু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। গরিব মানুষের একমাত্র ব্যবহার্য জ্বালানি কেরোসিন। কেরোসিন ব্যবহার করেন মূলত অতি দরিদ্র মানুষেরা। গ্যাস ব্যবহারের আর্থিক সামর্থ্যটুকু যাদের নেই, তাদের কাছে কেরোসিন অপরিহার্য। কুপিতে তেল দিয়ে আজও একটু আলো জ্বালতে দেখা যায় অসংখ্য মানুষকে। এ ছাড়াও কেরোসিন ব্যবহার করেন রাস্তার ধারের অসংখ্য ছোট দোকানদার। যদিও অধিকাংশ গ্রাহকের জন্য মাসে মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ৫০০ মিলি। সেই কেরোসিনের ভর্তুকি ২০২০-র এপ্রিল থেকে কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
এর উপর লাগাতার দাম বেড়ে চলেছে রান্নার গ্যাসের। এখন গ্যাসের দাম ৯২৬ টাকা। আধুনিক জীবনের অঙ্গ রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি নামতে নামতে এখন ১৯.৫৭ টাকা, প্রায় না দেওয়ার মতো। উজ্জ্বলা যোজনার গ্যাস সংযোগে টাকা না লাগলেও গ্যাসের দাম বাড়ায় তা কিনতে পারছেন না দরিদ্র গ্রাহকরা। অথচ গ্যাসের দাম ক্রমাগত বাড়ানোর সময় ভর্তুকি কমানো হবে না বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছিল সরকার। তারপর সময় গড়াতেই ভর্তুকি ভ্যানিশ। বর্তমানে ভর্তুকিযুক্ত সিলিন্ডারের দাম এতটাই বেড়েছে যে তা পৌঁছে গিয়েছে ভর্তুকিহীন সিলিন্ডারের দামের কাছাকাছি। নামের ফারাক ছাড়া দামে কোনও ফারাক নেই। খোলা বাজারে কেরোসিন বিক্রির মতো গ্যাসও বিক্রি হচ্ছে বিপুল দামে। গ্যাস কোম্পানিগুলির রমরমা ব্যবসা আরও ফুলেফেঁপে উঠছে, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে গ্যাসের মতো অপরিহার্য জ্বালানির দাম।
গ্যাস অগ্নিমূল্য হওয়ায় সুন্দরবনের জঙ্গল লাগোয়া বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গভীর জঙ্গলে যাচ্ছেন জ্বালানির কাঠ সংগ্রহ করতে। শুধু এখানকার নয়, গ্রাম ও শহরের বহু মানুষ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন গ্যাসে রান্না। যাদের বাড়িতে উজ্জ্বলা যোজনার গ্যাস সংযোগ আছে তারাও আর গ্যাসে রান্না না করে সিলিন্ডারের পাশেই কাঠ-খড়ের উনুন জ্বালিয়ে রান্না করেন। রান্নায় কাঠকয়লা ব্যবহার হলে ধোঁয়ায় মা-বোনেদের কষ্ট হবে এবং দূষণ হবে, এই যুক্তি দিয়ে উজ্জ্বলা যোজনা এনেছিল সরকার। গ্যাসের বিপুল দামবৃদ্ধিতে এখন উজ্জ্বলা গ্রাহকদের চোখেও জল এসে যাচ্ছে।
সম্প্রতি সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় তেল প্রতিমন্ত্রী একটি পরিসংখ্যান পেশ করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, রান্নার গ্যাস এবং কেরোসিন খাতে মোট ভর্তুকি ২০১৮-১৯ সালে ছিল ৪৩ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। তা কমতে কমতে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায়।
সরকারের বক্তব্য, ভর্তুকি তুলে দেওয়া হয়নি, বাস্তবে ভর্তুকি দেওয়ারই প্রয়োজন পড়ছে না। কারণ কী? সাধারণ মানুষের রোজগার কি বেড়ে গেছে? সে রকম কোনও তথ্য সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা দিতে পারেননি। বরং গত দু’বছরে অতিমারি পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের উপার্জন এক লাফে অনেক কমে গেছে, বেকারি বেড়েছে ভয়ঙ্কর হারে, দারিদ্রে আফ্রিকার ছোট দেশগুলির সাথে এক সারিতে অবস্থান করছে ভারত। তা হলে?
সরকারের যুক্তি, যাঁদের সত্যিই দরকার তাদের জন্যই অন্যদের ভর্তুকি ছাঁটাই। সত্যি কাদের দরকার আর কাদের দরকার নেই, তা যাচাইয়ের কোনও মাপকাঠি সরকার ঘোষণা করেনি। গরিব মানুষকে নিখরচায় গ্যাস দেওয়ার জন্যই নাকি তারা ‘উজ্জ্বলা যোজনা’ চালু করেছেন! কিন্তু ভর্তুকি কমে যাওয়ার কারণে অর্থেরঅভাবে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত বহু গ্রাহক দ্বিতীয়বার গ্যাস কিনতেই পারছেন না। রান্নার গ্যাস ব্যবহার করতে না পেরে বহু মানুষ এখন কাঠ-কয়লা ব্যবহার করছেন, অথবা অনেক বাঁচিয়ে গ্যাস ব্যবহার করছেন। সরকারের কি এটা অজানা? তা হলে এই সব কুযুক্তি কেন? এর দ্বারা গরিব-নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে কোন ‘আচ্ছে দিন’ তাঁরা নিয়ে আসছেন? আসলে সরকার সাধারণ মানুষের পরিষেবা নিয়ে এতটুকু দায়বদ্ধ নয়। তাদের দায়বদ্ধতা আম্বানিদের মতো তেল কোম্পানির একচেটিয়া মালিকদের প্রতি।