Breaking News

গিগ শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে

গিগ শ্রমিক– কথাটা কয়েক বছর আগেও শোনা যায়নি। লকডাউনের পর থেকে গিগ শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে হু হু করে। একদিকে শ্রমিকদের জন্য রাষ্ট্রের সামাজিক দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলা, অন্য দিকে পুঁজি-মালিকদের তীব্র মুনাফা-লালসা তৈরি করেছে এই গিগ শ্রমিকদের। তৈরি খাবার থেকে জামাকাপড়, ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র, ওষুধ সহ প্রায় সব রকমের পণ্য ক্রেতাদের কাছে দ্রুত পৌঁছে দিতে– এঁরা এখন হয়ে উঠেছে অপরিহার্য। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অনলাইন নির্ভর কাজকর্মে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে নতুন একটা ক্ষেত্র জন্ম নিয়েছে– গিগ।

‘গিগ শ্রমিক’ শব্দটিতে বোঝায় সাময়িক ভাবে নিযুক্ত শ্রমিক বাহিনী। মোবাইলে শুধু একটা ক্লিক, মুহূর্তেই বাড়ির দোরগোড়ায় হাজির তারা। পিঠে বিশাল বোঝা। একটা অর্ডার সার্ভ করতে না করতেই আরেকটা বুকিং চলে আসে মোবাইলে। ফলে এক মুহূর্তও থামলে চলবে না। স্যুইগি, জোম্যাটো, ওলা, উবের কিংবা অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট ইত্যাদি কোম্পানির গিগ বা প্ল্যাটফর্ম ওর্য়ার্কারদের জীবন এ রকমই।

গিগ শ্রমিকের জীবন ভাবলেই চলে আসে একরাশ অনিশ্চয়তার কথা। নেই কোনও বেতন চুক্তি, তাই রোজগারেরও কোনও নিশ্চয়তা নেই। নেই স্বাস্থ্য বিমা ও অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা। বেশির ভাগই সারা দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে যা আয় করেন, মূল্যবৃদ্ধির বাজারে সেই টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। গিগ কোম্পানিগুলির মালিকরা এঁদের গালভরা নাম দিয়েছে ‘পার্টনার’। কারণ ‘কর্মচারী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে এঁদের ন্যূনতম মজুরি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, স্বাস্থ্যবিমা, পেনশনের সুবিধা দিতে হবে। দিতে হবে ন্যায্য ছুটিও। এদের জন্য খরচ বাড়লে মালিকের মুনাফা-ভাণ্ডার আকাশচুম্বী হবে কী করে? তাই শ্রমিক বা কর্মচারীর মর্যাদা ছাড়াই কাজ করতে হয় তাঁদের। সরকারগুলিও পুঁজির দাস হিসাবে এই চরম জনবিরোধী নীতিতে সিলমোহর দিয়েছে।

২০২২-এ নীতি আয়োগের রিপোর্টে জানা গেছে, ২০২১-এ দেশে গিগ শ্রমিক ছিল ৭.৭ মিলিয়ন বা ৭৭ লক্ষ। বর্তমানে এই সংখ্যা ২০ কোটি। এই শ্রমিক-সংখ্যা সুইডেন, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। ২০৩০-এর মধ্যে ভারতে গিগ শ্রমিক সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৩ কোটি ৫০ লক্ষে। গিগ শ্রমিকদের সংখ্যা ক্রমশ এত বাড়ছে যে, ‘গিগ অর্থনীতি’ বলে একটা কথাই এখন চালু হয়ে গেছে।

অত্যন্ত অনিশ্চিত এই কাজে কর্মীরা আসতে বাধ্য হন কেন? সরকারি কিংবা বেসরকারি ক্ষেত্রে স্থায়ী কাজের অভাব গোটা দেশ জুড়েই। সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ অত্যন্ত কম। বেকার যুবকরা যতটুকু কাজ পান, তার বেশির ভাগই অসংগঠিত ক্ষেত্রে। ইকনমিক সার্ভের রিপোর্ট বলছে, বেকার যুবকের সংখ্যা গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছেছে। বছরে ২ কোটি বেকারকে চাকরি দেওয়ার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ‘জুমলা’ প্রমাণ হয়েছে। ভারতের অর্থনীতি বহরে বাড়তে বাড়তে বিশ্বের চতুর্থ স্থানে পৌঁছলেও প্রয়োজনীয় চাকরি তৈরি করতে ব্যর্থ মোদি সরকার। অর্থনীতিতে এর নাম দেওয়া হয়েছে কর্মসংস্থানহীন উন্নয়ন। ফলে সুশিক্ষিত, দক্ষ বহু বেকার যুবকও গিগ শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। গরিব, নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি থেকে বহু উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতী এই কাজে যোগ দিতে বাধ্য হন। অতিমারিতে শিল্প ও ব্যবসার ক্ষেত্রে ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলি ঝাঁপ বন্ধ করতে বাধ্য হওয়ায় একচেটিয়া পুঁজির আধিপত্য আরও বেড়েছে। সর্বত্র কাজ হারানো মানুষের হাহাকার। বেশিরভাগ গিগ শ্রমিক সংগঠিত নন, কিছু ক্ষেত্রে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও তাতে রয়েছে কর্তৃপক্ষের বাধা। বেকার সংখ্যার বাড়বাড়ন্তে ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার ভয় তাড়া করে। অনিয়মিত বেতন, কাজের ঘণ্টার কোনও হিসাব না থাকা সত্ত্বেও প্রতিবাদ করতে পারে না তারা। তা হলেই ছাঁটাই হতে হবে। সামান্য অজুহাতে তাদের প্রায়ই ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। মালিক জানে, এক জনকে ছাঁটাই করলে আরও হাজার বেকার যুবক কাজের জন্য লাইন দিয়ে রয়েছে। কর্মচারীর স্বীকৃতি না থাকায় কোনও শ্রম আইন মানতে বাধ্য থাকে না মালিকরা। ২০২০ সালে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নতুন যে শ্রম কোড সংসদে পাশ করিয়েছে, তাতেও গিগ-শ্রমিকদের কথা নেই। তীব্র মালিকী-শোষণে যন্ত্রণাময় জীবন যাপন করতে বাধ্য হন গিগ শ্রমিকরা। কাজের মর্যাদা এবং শ্রমিকদের অধিকারকে সম্মান জানাতে ১ মে যখন বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদযাপন করা হয়, তখন ভারতে লক্ষ লক্ষ গিগ-শ্রমিকের দাসত্বের এই চেহারা শ্রমিক আন্দোলনকে তীব্র করার প্রয়োজনীয়তাকেই বুঝিয়ে দিয়ে যায়।

বর্তমানের প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদ চূড়ান্ত বাজার সংকটে ধুঁকছে। লাভ, আরও লাভ করে সে বাঁচতে চাইছে। সে জন্য শ্রমিক শোষণের নিত্যনতুন ক্ষেত্র তৈরি করে চলেছে মালিক শ্রেণি। শ্রমিকের শ্রম ছাড়া এই শোষণমূলক ব্যবস্থার চাকা এক ইঞ্চিও এগোবে না। কিন্তু শ্রমিককে পুরোপুরি বঞ্চিত করে উৎপাদিত সম্পদের মালিকানা ভোগ করে মালিক শ্রেণি– এটাই পুঁজিবাদ। গিগ শ্রমিকদের এভাবেই ‘সভ্য’ জগতের ‘দাস’ বানিয়ে রেখেছে মালিক শ্রেণি। অথচ আজ এঁদের হাত ধরেই চলছে আধুনিক জীবনের চাকা। কেন্দ্রীয় শ্রম দপ্তর ২০২১-এ ই-শ্রম পোর্টালে গিগ শ্রমিকদের নাম নথিভুক্তি ও তাদের সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলেই দায়িত্ব সেরেছে।

এই অবস্থায় দেশের সরকারের ভূমিকা হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে বেকার যুবকদের প্ল্যাটফর্ম কোম্পানিগুলি ফাঁদে ফেলে মুনাফা লুটছে, তাদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। সরকার আইন করে এই কোম্পানিগুলিকে ধরতে পারে। গিগ-শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু সরকার এ ক্ষেত্রে উদাসীন।

গিগ-শ্রমিকদের স্বার্থে আইন করা অত্যন্ত জরুরি। সেই আইন তৈরি ও কার্যকর করতে সরকারকে বাধ্য করতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। কলকাতায় এআইইউটিইউসি-র নেতৃত্বে বাইক-ট্যাক্সি সংগঠন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। সরকারকে বাধ্য করতে হবে শ্রমিকস্বার্থে আইনানুগ পদক্ষেপ করতে।

সূত্রঃ আউটলুক বিজনেস.কম-১ জানুয়ারি, ’২৫, দ্য হিন্দু, ১৬ মে, ’২৫

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা  ১৩ – ১৯ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত