১০০ দিনের প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে চলছে চাপানউতোর। প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে রাজ্যের জন্য বরাদ্দ টাকা গত এক বছর ধরে বন্ধ রেখেছে মোদি সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের অভিযোগ, ২০ লক্ষ ভুয়ো জবকার্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে রাজ্যে। তৃণমূল সরকারের বক্তব্য, তারা অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছে।
রাজ্যে রাজ্যে ভুয়ো জবকার্ড রয়েছে লক্ষ লক্ষ, দুর্নীতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার, কিন্তু তাকে অজুহাত করে গরিব মানুষকে বঞ্চিত করা হবে কেন? এই প্রকল্পের যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পেত সাধারণ মানুষ, তা-ও না পাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বিজেপি-তৃণমূলের ঠেলাঠেলিতে। আবার সম্প্রতি রাজ্যের বিজেপির দুই শীর্ষ নেতা আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের কথা মাথায় রেখে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রীর কাছে এই বরাদ্দ চালুর জন্য তদ্বির করেছেন।
এই অর্থবর্ষে আগের অর্থবর্ষের তুলনায় বরাদ্দ ২৫ শতাংশের বেশি ছাঁটাই করে দিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। আরও দুর্দশার মুখোমুখি হল কোনও রকমে দিন গুজরান করা বিপুল সংখ্যক মানুষ। রিপোর্টে প্রকাশ, ডিসেম্বরে ভারতে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ, শহরে প্রায় ১১ শতাংশ। গ্রামেগঞ্জে কৃষির বাইরে রোজগারের বড় ভরসা হল একশো দিনের কাজ। অথচ বরাদ্দ ছাঁটাই হওয়ায় বহু শ্রমিক মজুরি পাচ্ছেন না। শহরেও অসংগঠিত নানা ক্ষেত্রে কাজ ক্রমশ সংকুচিত হওয়ার ফলে মানুষের রোজগারের একমাত্র ভরসা এই প্রকল্প।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত ক্রমশ নামছে, আয় কমছে মারাত্মক হারে, দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতো এ রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ শিশু পুষ্টির অভাবে ঠিক মতো বাড়ছে না, শিশুর মুখে তুলে দেওয়ার মতো খাদ্য জোটাতে পারছে না রাজ্যের ৩৩ শতাংশ পরিবার, অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একমাত্র জায়গা হিসাবে দেখানো হচ্ছে জরাজীর্ণ, ধুঁকতে থাকা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে, শিশু অপুষ্টির জন্য বাবা-মায়ের অসচেতনতাকে দায়ী করে দায় ঝেড়ে ফেলতে ব্যস্ত সরকারগুলি– পরিস্থিতি যখন এরকম ভয়ঙ্কর, তখন কোনও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে একশো দিনের প্রকল্পে বিপুল ছাঁটাই কেন?
ছাঁটাইয়ের পক্ষে যুক্তি করতে গিয়ে বিজেপির হয়ে কেউ কেউ সওয়াল করেছেন, এই প্রকল্পে বিপুল ব্যয়, এমন প্রকল্প চালিয়ে সরকারের লাভ কী? কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্টে্র সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে যে জনকল্যাণমুখী প্রকল্প, তাতে লাভ-ক্ষতির হিসাব কেন? দ্বিতীয়ত, যে প্রকল্পে কম-বেশি ২৫ কোটি মানুষ প্রয়োজনের ভগ্নাংশও সুফল পান, তার কোনও বিকল্প ব্যবস্থা না করে শুধুমাত্র সরকারের লাভ-ক্ষতির হিসাব কারা করতে পারেন? আর সরকার যে গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনাকে গুটিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা কি টাকার অভাবে? পুঁজিপতিদের কর ছাড় দিতে সরকারের ভাঁড়ার তো শূন্য হয় না!
বিজেপি সরকারের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে অনেকে বলেন, যখন বাজারে অন্য কাজ আছে এবং ‘এনরেগা’র থেকেও বেশি মজুরিতে মানুষের কাজ পাওয়ার পরিস্থিতি রয়েছে তখন এই প্রকল্পের প্রয়োজন কী? অন্য কোন কাজের কথা তারা বলতে চেয়েছেন তা দেশের মানুষের বোধগম্য নয়। সরকারি রিপোর্টেই তো প্রতিদিন কাজ ছাঁটাই, বেকারি বৃদ্ধির খবর প্রকাশ্যে আসছে। আর মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তো আরও ভয়াবহ। ফলে সরকার-ভজা কর্তাদের এই ছেঁদো যুক্তি বাস্তবেঅচল। সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র-নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি থাকলে দেশের বহু মানুষের স্বার্থবাহী এই প্রকল্প বন্ধ করার জন্য এ সব যুক্তিহীন সওয়াল তাঁরা করতে পারতেন না।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, কর্পোরেট পুঁজিপতিদের দাক্ষিণ্যে যে দলগুলি ক্ষমতার মসনদে বসছে, সরকারি কোষাগারের শূন্যতা পূরণ করতে তারা পুঁজিপতিদের মুনাফার উপর সামান্য কোপও বসাতে চায় না। সরকারি কোষাগার পূর্ণ করার জন্য হাড় জিরজিরে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলিকেই তারা যোগ্য ঠাউরেছেন! ধনকুবেরদের উপর এতটুকু কর চাপাালেই সরকারি কোষাগার উপচে পড়তে পারে, সেই সম্পদের ছিটে-ফোঁটা ব্যয়েও এ দেশে ‘বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুর সংখ্যা’ কমতে পারে। সেই বরাদ্দে অপুষ্টিতে ভোগা কোনও মাকে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে হয়ত রক্তাল্পতায় মরে যেতে হবে না, সদ্য জন্মানো শিশুকে চোখের জলে ঝোপের ধারে হয়ত ফেলে দিয়ে যেতে হবে না অভাবী কোনও বাবা কিংবা মাকে, স্কুলের ফি জোগাড় না করতে পারার যন্ত্রণা বুকে চেপে কোনও বাবাকে ধারালো কাটারি দিয়ে হয়ত সন্তানকে হত্যা করতে হবে না। কিন্তু ক্ষমতালোলুপ শাসক বিজেপি অথবা ক্ষমতাপিপাসু কোনও দলই ঐ কর্পোরেট পুঁজি মালিকদের উপর ট্যা’ বাড়াবে না। কারণ, তারা ওই মালিকদেরই সেবক। ফলে গরিব মানুষরাই তাদের সহজ শিকার।
মোদি সরকারের কর্মসংস্থান প্রকল্প সংকোচনের এই পরিকল্পনা স্পষ্ট দেখিয়ে দিচ্ছে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব খেটে-খাওয়া মানুষের প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দায়বদ্ধতা তো দূরের কথা, সামান্য দরদও নেই। পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে অন্যান্য পুঁজিবাদী রাষ্টে্রর শাসকদের মতোই ক্রমাগত আরও ভয়াবহভাবে সাধারণ মানুষের অধিকারগুলি লঙ্ঘন করে চলেছে বিজেপি সরকার। সাধারণ মানুষের জীবনের অপরিহার্য প্রতিটি জিনিসের মূল্য নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে–কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, শ্রমিকদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে বেপরোয়াভাবে। ১০০ দিনের প্রকল্পের মাধ্যমে গরিব মানুষের বেঁচে থাকার নূ্যনতম সুযোগটুকুও কেড়ে নিতে বদ্ধপরিকর সরকার তাই বরাদ্দ ছাঁটাইয়ে নেমেছে।