ধরা যাক আপনার পাড়ার মরা নেড়ি কুকুরটাকে সাফাইকর্মীরা ফেলে দিল ভাগাড়ে৷ পরের দিন কোনও নামী রেঁস্তোরায় মটন বিরিয়ানির মাংসের টুকরোতে যখন কামড় বসাচ্ছেন তখন আপনি জানেন না হয়তো পাড়ার ওই মৃত নেড়িই পাতে উঠে এসেছে৷ আঁতকে উঠলেন? ওঠারই কথা৷ কিন্তু বাস্তব এটাই৷ বজবজ এলাকার এক ভাগাড় থেকে মরা পশুর পচা মাংস কেটে নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় যুবকদের হাতে ধরা পড়া কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর চক্ষু চড়কগাছ জানা যায় দীর্ঘদিন ধরে এ ভাবেই ভাগাড়ের মাংস শুধু কলকাতার নামী রেস্তোরাঁতেই নয়, দেশের বাইরেও পাচার হয়ে উঠছে মানুষের খাবারের প্লেটে৷ পুলিশ–প্রশাসন সহ সকলের নাকের ডগায় প্রথমে মরা মুরগি, তারপর ভাগাড়ের মাংস পাচারের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে কলকাতা সহ গোটা রাজ্য৷
খাদ্যে ভেজালের এটি প্রথম ঘটনা নয়৷ ১৯৮৮ সালে সিপিএম শাসনে ভেজাল–রেপসিড তেলে তৈরি খাবার খেয়ে বেহালার বুড়ো শিবতলার শ’ তিনেক মানুষের জীবনে যে চরম অন্ধকার নেমে এসেছিল তা আজও মানুষ ভুলে যায়নি৷ বহু মানুষ চিরকালের মতো বিকলাঙ্গ হয়ে যায়৷ কেউ হাঁটতে পারে না, কেউ বা দেওয়াল ধরে বা কারও কাঁধে ভর দিয়ে কোনওরকমে জীবনটাকে বয়ে নিয়ে চলেছেন৷ আর যে ‘গরিব ভাণ্ডার’ রেশন দোকানের রেপসিডে এই দুরবস্থা সেখানে এখন একটা পেল্লাই বাড়ি হয়েছে৷
শুধু বাংলা নয় দেশের অন্যত্রও একই চিত্র৷ ১৯৯৮ সালে রাজধানী দিল্লিতে ৬০ জন আর ২০১৩ সালে বিহারে ২৩ জন স্কুল ছাত্র ভেজাল তেলে তৈরি খাবারের বিষক্রিয়ায় মারা যান৷ এই সমস্ত ঘটনাগুলিকে ব্যতিক্রমী বা দু–একজন ব্যবসায়ীর অসাধু মানসিকতার প্রতিফলন বলা যেতে পারত যদি না দেখা যেত এই প্রবণতা বিশ্বময়৷ চীন, ফ্রান্স, মেক্সিকো কোথায় নেই ভেজাল? সম্প্রতি ইউরোপের চল্লিশটি দেশের সুপারমার্কেটগুলিতে কয়েক লক্ষ দূষিত ডিম সরবরাহ করা হয়৷ জনগণের নজরে আসায় তা নিয়ে হইচই হলে সেই সব দূষিত ডিম তুলে নেওয়া হয়৷ রবার্ট কেনারের ‘ফুড ইনকরপোরেশ’ তথ্য চিত্রে আমেরিকার খাদ্যে ভয়ঙ্কর ভেজাল সংক্রান্ত বিষয়ে এমন একটা প্রামাণ্য দলিল যাকে আমেরিকান সরকারও অস্বীকার করতে পারছে না৷ তাই ভেজাল শুধু পুঁজিবাদী ভারতের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক সমস্যা৷
‘হেলদি, হেলদি লাইফ’ অর্থাৎ সুস্থ খাবার, সুস্থজীবন বর্তমান বিশ্বে মাঝে মাঝে অলীক কল্পনা বলে মনে হয়৷ ভারতীয়রা ঘরের সুস্বাদু–পুষ্টিকর খাবার খেতেই অভ্যস্ত ছিল৷ অর্থনীতির উদারীকরণ নানা ক্ষেত্রের মতো খাদ্যাভ্যাসেরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে৷ মানুষ বিশেষত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি এখন অনেক বেশি করে বাইরের ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড, প্রসেসড ফুড, রেস্টুরেন্টের খাবারের দিকে ঝুঁকছে৷ সর্বোচ্চ মুনাফা তোলাই এই ব্যবসার উদ্দেশ্য বলে, এই সমস্ত খাবারের গুণগত মানের দিকে স্বভাবতই নজর দেওয়া হয় না৷ দেশি–বিদেশি পুঁজির কব্জায় খাদ্যে ভেজাল বলতে আগে সাধারণত বোঝাত দুধে জল বা চালে কাঁকর মেশানো৷ এখন সে জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে মারাত্মক ক্ষতিকারক কীটনাশক, সিনথেটিক রঙ, হরমোন, কার্সিও জেনিক পদার্থ সহ আরও নানা ক্ষতিকারক জিনিস৷ ফুটপাত থেকে শুরুর করে অভিজাত হোটেল রেস্টুরেন্ট, নামী–দামি ব্র্যান্ডের পণ্য কোনওটাই এখন আর ভেজাল মুক্ত নয়৷ খাদ্যে ভেজালের শুরু খাদ্য উৎপাদনে, আর শেষ খাবারের প্লেটে৷ প্রক্রিয়াজাত খাবার তো বটেই এমনকী সব্জি, ফলমূল, মশলা, ডেয়ারি পণ্য ঘি–তেল–দুধ–মিনারেল ওয়াটার, ঠাণ্ডা পানীয়, আইসক্রিম, চিপস সর্বত্রই ভেজাল৷ সম্প্রতি ম্যাগি–নুডলসে ভেজাল কেলেঙ্কারি ভারতে খাদ্য শিল্পের চেহারাটাকে নগ্ন করে দিয়েছে৷ একটি বেসরকারি সমীক্ষার মতে ভারতে ৩০–৩৫ শতাংশ খাদ্যে ভেজাল৷ পাঞ্জাব এই বিষয়ে প্রথম রাজ্য হলেও পশ্চিমবঙ্গ তার ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে৷ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, ভারতে ৮০ ভাগ অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী ভেজাল খাদ্য ও দূষিত পানীয় জল৷ হু–র ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের যাবতীয় রোগব্যাধির এক বিরাট অংশ খাদ্যবাহিত যা মূলত ভেজালের কারণেই ঘটছে৷ অন্য সমস্ত রোগ যদি বাদ দেওয়াও হয়, এ কথা অনস্বীকার্য যে মারণ ব্যাধি ক্যান্সার ভেজালের কারণে মারাত্মক ভাবে বাড়ছে৷ সারা বিশ্বে ৫ বছরের নিচে শিশুদের চল্লিশ শতাংশের অসুস্থতার প্রধান কারণ ভেজাল খাদ্য৷ বছরে সারা বিশ্বে ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হচ্ছে যার মধ্যে মারা গেছে কুড়ি লক্ষ৷
সেই কবে কবি বলে গেছেন, ‘খাঁটি জিনিস’ এই কথাটি রেখো না আর চিত্তে, / ভেজাল নামটি খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে’৷ খাদ্যে ভেজাল খুনের চেয়েও জঘন্য অপরাধ৷
কেন এই প্রবণতা ক্রমবর্ধমান৷ এগুলি কি দু’একজন অসাধু ব্যবসায়ী বা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিষয়? তা যদি হত তা হলে এই সমস্যা এত ভয়ঙ্কর আকার নিত না বা সমাধানে এত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হত না৷ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মুনাফা মানুষকে ঠকিয়ে বা তার শ্রমকে চুরি করেই হয়৷ পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকাশের যুগে সামন্ততন্ত্রবিরোধী সংগ্রামের রেশ থাকার কারণে খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মুনাফা করতে পুঁজিপতিরা আজকের মতো বেপরোয়া ছিল না৷ যতদিন যাচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি যত ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে ততই সে মুনাফা, সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠছে৷ বর্তমানে খাদ্য ব্যবসার পুরোটাই অসৎ অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের দখলে৷ যে ব্যবসায়ী শস্যে দেওয়ার জন্য ক্ষতিকারক কীটনাশক বেচছে, সেই আবার ক্যানসার হাসপাতাল খুলছে৷ এটাই পুঁজিবাদী অর্থনীতি৷ তাই কঠোর আইন, তার সঠিক প্রয়োগ, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নিয়মিত নজরদারি, ইত্যাদি দরকার৷ কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন৷
(৭০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ১জুন, ২০১৮)