প্যালেস্টাইন থেকে সেখানকার আদি বাসিন্দা আরব জনগোষ্ঠীর চিহ্নটুকুও মুছে দিতে চায় উগ্র ইহুদিবাদী ইজরায়েল। সাম্রাজ্যবাদ শিরোমণি মার্কিন যুক্তরাষ্টে্রর সমস্ত রকম মদতে পুষ্ট ইজরায়েল বিধ্বংসী বোমাবর্ষণে বস্তুত গোটা প্যালেস্টাইনকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে নিহত হয়েছেন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ, যার এক-তৃতীয়াংশই নাবালক। এবার সেখানকার গাজা ভূখণ্ডকে মুঠোয় পোরার মতলবে গাজার খাবার সরবরাহ কেন্দ্র, খাদ্য সঞ্চয় করে রাখার গুদামঘর ও রান্নাঘরগুলিকে হামলার নিশানা করেছে ইজরায়েল। গাজার সরকারি প্রচারদপ্তর জানিয়েছে, সম্প্রতি মধ্য গাজার ডের আল-বালাহ্-তে ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী খাবারের একটি গুদামঘরে বোমা ফেলেছে। এতে মৃত্যু হয়েছে গাজার পাঁচ ক্ষুধার্ত নাগরিকের, আহতের সংখ্যা বহু। খাবারের খোঁজে ওখানে জড়ো হয়েছিলেন এঁরা। গত কয়েক সপ্তাহে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে ইজরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন প্যালেস্টাইনের কয়েকশো মানুষ। বস্তুত অনাহারকে এবার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েল।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত গাজার ৬৮টি খাদ্য-কেন্দ্র ইজরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়েছে। গাজার সীমান্তে সবকটি প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি গত মার্চ থেকে কোনওরকম ত্রাণসামগ্রী সেখানে ঢুকতে দিচ্ছে না ইজরায়েল। এমনকি খাদ্য ও ওষুধপত্রেও ছাড় নেই। ফলে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার পর্যন্ত পাচ্ছেন না বিধ্বস্ত প্যালেস্টাইনের বিপর্যস্ত মানুষ। অসুস্থ হলে মিলছে না ওষুধপত্র। খাবার সরবরাহকারী গাড়ির সামনে একটু খাবারের জন্য মরিয়া হয়ে ঠেলাঠেলি করতে থাকা অনাহারী মানুষের ছবি সংবাদপত্রে দেখে শিউরে উঠতে হচ্ছে। সে ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বড়দের ভিড় ঠেলে কোনও ক্রমে সামনে এগিয়ে এসে একবাটি খাবারের জন্য দুধের শিশুদেরও বাড়িয়ে ধরতে হচ্ছে তাদের শীর্ণ হাত। এবার এই খাবার সরবরাহ কেন্দ্রগুলিতেও বোমা ফেলছে ইজরায়েল। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ হেন নিষ্ঠুরতার নজির বোধহয় খুব কমই আছে।
সমস্ত রকম আন্তর্জাতিক আইন দু-পায়ে মাড়িয়ে খুব সুপরিকল্পিত ভাবেই গাজায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি করেছে নরঘাতী সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েল রাষ্ট্র ও তার সরকার। তার মতলব হল গোটা প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডের দখল নেওয়া। তাই বোমার আঘাতে প্যালেস্টাইনকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। নারী, শিশু সহ সেখানকার বাসিন্দারা প্রাণের তাগিদে ছুটে চলেছেন এক আশ্রয় শিবির থেকে আরেক আশ্রয় শিবিরে। যদিও গোটা বিশ্বের ধিক্কারকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আশ্রয় শিবিরগুলিকেও বোমা মেরে ধ্বংস করতে পিছপা হতে দেখা যাচ্ছে না নরঘাতী ইজরায়েলকে। এর সঙ্গে এবার প্যালেস্টাইনের বাসভূমি থেকে উৎখাত হওয়া ক্লান্ত, আতঙ্কিত, চরম বিপর্যস্ত মানুষগুলিকে অনাহারে তিলে তিলে মারার ছক কষেছে ইজরায়েল।
এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে পৃথিবীর দেশে দেশে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন মানুষ। বিক্ষোভ হচ্ছে খোদ ইজরায়েলেও। প্যালেস্টাইনের সরকারের পক্ষ থেকেও রাষ্ট্রসংঘ, প্রতিরক্ষা কাউন্সিল সহ বিশ্বের মানবিক সংস্থাগুলির কাছে আবেদন জানানো হয়েছে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলিকে সুরক্ষিত রাখা, সীমান্তের প্রবেশপথগুলি খুলে দেওয়া ও গাজায় ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগী হতে। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলির কাছে তারা আবেদন জানিয়েছে যাতে ইজরায়েলের এই বর্বরতার খবর গোটা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
বাস্তবে অবরুদ্ধ গাজার নিরুপায় মানুষের মুখ থেকে খাবারের গ্রাস কেড়ে নিয়ে তিল তিল করে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার যে ভয়ঙ্কর রাস্তা নিয়েছে ইহুদিবাদী ইজরায়েল, তার বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে মানুষ আজও যদি সরব না হয়, তার অর্থ দাঁড়ায় পরোক্ষ ভাবে ইজরায়েলের নরমেধ যজ্ঞের ষড়যন্ত্রে সামিল হওয়া।
সমাজতান্ত্রিক শিবির ও বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের অনুপস্থিতিই যে আজ ইজরায়েলকে এ হেন গণহত্যার সাহস জোগাচ্ছে এ কথা বুঝে সর্বশক্তি দিয়ে ইজরায়েলের হত্যালীলার বিরুদ্ধে আজ সমস্ত স্তরের গণতান্ত্রিক মানুষকে দাঁড়াতেই হবে।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ২৩ – ২৯ মে ২০২৫ এ প্রকাশিত