১১ জুন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আহ্বান জানিয়েছেন–‘আসুক আর এক নবজাগরণ’৷ প্রেক্ষিতটি হল, বিদ্যাসাগরের মূর্তি পুনঃস্থাপন৷
পূর্ববর্তী ঘটনা হল গত ১৬ মে বর্তমান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা অমিত শাহের নেতৃত্বে নির্বাচনপূর্ব এক মিছিলের উন্মাদনা ও কলেজ স্ট্রিট চত্বরে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ৷ এই মিছিল থেকে উন্মত্ত দুষ্কৃতীরা যখন বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত কলেজের ভিতরে ঢুকে তাঁর মর্মর মূর্তিকে আছড়ে ভাঙছিল, তখন এ রাজ্য তথা গোটা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল৷ রাজনৈতিক দলাদলি যা–ই থাকুক, বিদ্যাসাগরের মর্মর মূর্তিকে টুকরো টুকরো করে ফেলা চিন্তার অতীত৷ কিন্তু যারা মূর্তি ভাঙল বা যাদের নেতৃত্বে ভাঙা হল তাদের বিন্দুমাত্র লজ্জা বা অনুশোচনা দেখা গেল না৷ তারপর ভোটের হাওয়া বুঝে মূর্তি কে আগে বসাবে তার কাড়াকাড়ি পড়ে গেল৷ রাজ্য সরকার দ্রুত ঘোষণা করল বিদ্যাসাগরের মূর্তি পুনঃস্থাপিত হবে৷ আর দেশের প্রধানমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা আরেকটু চমক দিয়ে বললেন পঞ্চধাতুর মূর্তি তৈরি করে দেব৷ এর আগে একবার নকশালপন্থার ভ্রান্ত রাজনীতিতে কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগরের মূর্তির শিরশ্ছেদ ঘটেছিল গত শতাব্দীর সাতের দশকে৷ সে অন্য অতীত, অন্য প্রেক্ষিত, রাজনীতির চূড়ান্ত অবিবেচনা ও অজ্ঞতাপ্রসূত ঘটনা৷ সচেতন মানুষের একথা জানা আছে, মর্মর মূর্তি শুধু মূর্তি নয়, ‘মহৎপ্রাণ মানুষের মূর্তি’ ক্ষণিকের মধ্যে সুপ্ত বিবেককে জাগিয়ে দেয়৷ শিল্পীরাও যখন মূর্তি তৈরি করেন তাঁরাও জানেন, কয়েকশো পাতার বই দিয়ে যে চরিত্রকে তুলে ধরা হয়, মর্মর মূর্তির রেখায় তাকে করতে হয় জীবন্ত৷ তাই সমাজ অগ্রগতির পতাকাবাহীরা এই মর্মরমূর্তিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে তাঁদের স্মরণ করেন৷ আর যারা প্রতিক্রিয়ার শক্তি, তাদের কাছে এই মূর্তির কোনও মূল্য নেই৷
মুখ্যমন্ত্রী নবজাগরণ কথাটি ব্যবহার করেছেন৷ কিন্তু কী সেই নবজাগরণের ইতিহাস? নবজাগরণ হল সেই আন্দোলন, ধর্মীয় অন্ধতা গোঁড়ামি কুসংস্কারের শৃঙখল ভেঙে যুক্তির ভিত্তিতে যা মানুষকে যথার্থ মানুষ করতে চেয়েছে। শেক্সপিয়রের কথায় ‘What a piece of work is a man! …The beauty of the World! The paragon of animals!’ আমাদের দেশের সেই নবজাগরণের প্রভাতসূর্য হলেন বিদ্যাসাগর৷ তাঁর পূর্ববর্তী রাজা রামমোহন রায় ছিলেন নবজাগরণের ঊষালগ্ণের শঙ্খবাদক৷ তারপরে এ দেশের নবজাগরণের এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের দীর্ঘ ইতিহাস৷ রাজনীতিতে, কাব্যে, সাহিত্যে, চরিত্রে, সঙ্গীতে, শিল্পকলায় গৌরবোজ্জ্বল ভারত৷ এই নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র ছিল বাংলা– কলকাতা৷ তারপর ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে এ দেশের বুর্জোয়া শ্রেণি রাষ্ট্রে আসীন হয়েছে৷ তারা নবজাগরণের গৌরব, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমস্ত আত্মত্যাগ আত্মসাৎ করেছে৷ মনীষীদের, বিশেষ করে যাঁরা আপসহীন তাঁদের জীবন ও কর্মসাধনাকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে৷ কেবলমাত্র মুনাফা অর্জনের পুঁজিবাদী তাগিদ থেকেই কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলি চলেছে৷ দেশজুড়ে জবরদস্তি, সন্ত্রাস, টাকার খেলা, দলবদল– অবক্ষয়, অবনমন সর্বত্র৷ সে আজ এমন একটি পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে মানুষ দিশাহীন৷ আর নির্বাচন যখন আসে তখন এই অবক্ষয়ের মাত্রা যে কতশত গুণ বেড়ে যায় তা কারওরই অজানা নয়৷ প্রতিশ্রুতির কত বন্যা বইতে থাকে কিন্তু সবই মিথ্যার বেসাতি৷
এই অসহনীয় অবস্থার হাত থেকে মুক্তির পথ কী? সে কি এই বিজেপি কংগ্রেস সিপিএমের বিরুদ্ধে তৃণমূলের সরকারি শাসন? এক দলের জায়গায় আরেক দল? মুখ্যমন্ত্রী কি এই নবজাগরণের কথা উল্লেখ করছেন? তিনি বিদ্যাসাগরের মূর্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন৷ কিন্তু যুগের প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগরের চিন্তা আদর্শকে কি তাঁরা অনুসরণ করছেন? তাঁর প্রাণের ধারাকে নির্ণয় করবে কে? যারা সমস্ত রীতি নীতি বিসর্জন দিয়ে শাসক শ্রেণির সেবায় নিবেদিত– তারা? পঞ্চধাতুর মূর্তি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দানকারী বিজেপি, যারা ধর্মীয় উন্মাদনা নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে নির্বাচনী স্বার্থ চরিতার্থ করছে, তারা নবজাগরণের পার্থিব মানবতাবাদী বিদ্যাসাগরের নামটুকু উচ্চারণ করার নৈতিক অধিকার রাখে কি? আজ থেকে দুশো বছর আগে পার্থিব মানবতাবাদী এই মানুষটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, দয়া বা বিদ্যা নয়, তাঁর চরিত্রের প্রধান দিক হল তাঁর অজেয় পৌরুষ, অক্ষয় মনুষ্যত্ব৷ তাই বিদ্যাসাগরের যদি কেউ সত্যিকারের চর্চা করেন, তাহলে তার দ্বারা আমরা কেউই বাঙালিত্বের দিকে, হিন্দুত্বের দিকে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে যেতে পারি না৷ মাইকেল মধুসূদন যেমন বলেছিলেন, তিনি আমাদের মধ্যে প্রথম ‘মানুষ’৷ রবীন্দ্রনাথও নানা উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি এর চেয়েও বড় ছিলেন, তিনি মানুষ ছিলেন৷ এই মানুষ নবজাগরণের জীবন্ত প্রতিমূর্তি৷
সেই নবজাগরণের ধারায় আজকে চাই নতুন সমাজ গঠনের নতুন আদর্শ৷ সে আদর্শ ব্রিটিশের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে শাসক শ্রেণি যে ক্ষমতা পেয়েছে, রাজ্যে ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলগুলি এরই স্বার্থরক্ষা করে চলেছে – তা দিয়ে হবে না৷ এ–দল ও–দল করা অথবা এ দলের পরিবর্তে ও দলের সরকার পরিবর্তন করার মধ্যে নবজাগরণ নেই৷ আমাদের দেশের নবজাগরণের চরিত্র সাধনা করে আজকের যুগের প্রেক্ষিতে নতুন সমাজ গড়তে হবে৷ নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে৷ সেই সমাজ পরিবর্তন অর্থাৎ বিপ্লবের আদর্শের মূর্ত রূপ হল মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা৷ কমরেড শিবদাস ঘোষ তাই বলতেন, সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে নবজাগরণ যে বিপ্লব সাধিত করেছে, আজ এই অবক্ষয়ী পুঁজিবাদের যুগে তার নির্যাস গ্রহণ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনীতি সংস্কৃতি চরিত্র সাধনাকে গড়ে তুলতে হবে, তবেই সত্যিকারের পুনর্জাগরণ হবে৷ তা না হলে বিদ্যাসাগরের নাম নিয়ে মূর্তি গড়ে বা নবজাগরণ বলে আজকের এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই৷