সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো আর একটা আন্দোলন গড়ে উঠেছে কেরালায়। সিপিএম সরকার উন্নয়নের নামে রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত ৮ মিটার উঁচু যে রেলপথ স্থাপনের সিলভার লাইন প্রকল্প হাতে নিয়েছে তার বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। কারণ, তারা উচ্ছেদের মুখে। এ ছাড়া রয়েছে আরও নানা বিপর্যয়ের আশঙ্কা। তারা কেরালা রেল সিলভারলাইন বিরোধী গণসংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলে রাজ্য জুড়ে আন্দোলনে নেমেছেন।
এই কমিটির নেতৃত্বে কেরালা স্টেট সেক্রেটারিয়েটের সামনে হাজার হাজার প্রতিবাদী মানুষ ইতিমধ্যে বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অসংখ্য সাধারণ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবেন, জীবিকা হারাবেন। ফলে ধর্ম বর্ণ রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে দলে দলে মানুষ যোগ দিয়েছেন এই আন্দোলনে। যোগ দিয়েছেন পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা, রাজ্যের বিশিষ্ট মানুষেরা। পিনরাই বিজয়নের নেতৃত্বে সিপিএম পরিচালিত বিগত এলডিএফ সরকার কেরালার উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্তকে জুড়ে দিয়ে সেমি হাই স্পিড রেললাইন স্থাপনের প্রস্তাব করেছিল। শুরু থেকেই পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু সিপিএম সরকার সে সবের কোনও মূল্য দেয়নি। এ ক্ষেত্রে তারা সহযোগী হিসাবে পেয়েছে বিজেপি সরকারকে, তার রেল দপ্তরকে। তাদের মনোভাব এমন যে, যেহেতু বিধানসভায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফলে যত বিরোধিতাই হোক, প্রকল্প তারা করবেনই।
এই রেললাইন কেরালাকে লম্বালম্বি দু’ভাগে ভাগ করে দেবে। পূর্বদিকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, পশ্চিম দিকে আরব সাগর, মাঝখানে প্রাচীরের মতো এই রেলপথ আট মিটার উঁচু। কেরালার ঘন বর্ষার জল ৪ থেকে ৬ ঘন্টার মধ্যে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে এসে আরব সাগরে মেশে, এই রেললাইনের জন্য তা বন্ধ হয়ে যাবে। বন্যা বাড়বে। ঘন বর্ষায় রেল লাইনের আন্ডারপাস কোনও কাজেই আসবে না। ফলে কেরালা ভাসবে।
এছাড়াও রাজ্যের দুই প্রান্ত জুড়ে দেওয়া এই রেলপথের সাথে আন্তঃরাজ্য রেললাইন ও ব্রডগেজ রেললাইনের সাথে সংযোগ না থাকলে, পরিবহণ সমস্যার কোনও সমাধান এর দ্বারা হবে না। এমনকি রেললাইনের জন্য বালি পাথর সহ বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল যোগান দিতে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার যা ক্ষতি হবে, সেটাও পরিবেশবিদদের প্রতিবাদের অন্যতম কারণ।
এই প্রকল্পের জন্য খরচ হবে প্রায় দু’লক্ষ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাঙ্ক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি সংস্থা থেকে মোট বাজেটের ৯০ শতাংশ ধার করা হবে। ফলে বিপুল পরিমাণ ঝণের বোঝা জনগণের ঘাড়ে পড়বে, যা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের ধারণার পরিপন্থী।
এই রেলপথের জন্য মোট ১৩৮৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হবে, যার প্রায় ৮৭ শতাংশই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। রেললাইনের দু’পাশে ২৫ মিটার জমি ফাঁকা রেখে বসতি স্থাপন করা যাবে ধরে নিয়ে এই হিসেব। কিন্তু বাস্তবে রেললাইনের যা উচ্চতা এবং রেলের যা স্পিড হবে তাতে ১০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত বসতি স্থাপন করা যাবে না। ফলে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে অনেক বেশি।
সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, কেরালায় ন্যাশনাল হাইওয়ে হোক, কিংবা ভাল্লারপদম কন্টেনার টার্মিনাল হোক, কোনও ক্ষেত্রেই যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা সরকার করেনি। উন্নয়নের নামে সব বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর জন্য দায়ী কেরালার সিপিএম পরিচালিত এলডিএফ এবং কংগ্রেস পরিচালিত ইউডিএফ সরকার।
পূর্বের অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখে উদ্বিগ্ন মানুষ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলেছেন। এই কমিটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) কেরালা রাজ্য কমিটি নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেছে। ২০০ আঞ্চলিক কমিটি, ১১ জেলা কমিটি সহ রাজ্য স্তরে গড়ে ওঠা এই শক্তিশালী সংগ্রাম কমিটি আজ জনগণের অত্যন্ত ভরসার জায়গা।
মানুষ বুঝতে পেরেছে এই প্রকল্প উন্নয়নের জন্য নয়। তা যদি হত তবে, সবার আগে রাজ্যের বিস্তীর্ণ পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলি তাঁরা রেল মানচিত্রে যুক্ত করতেন। আসলে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা বৃহৎ পুঁজির মালিকদের হাতে তুলে দেওয়াই তাদের আসল উদ্দেশ্য। এই সরকারের কাছে জনগণের প্রকৃত প্রয়োজন, পরিবেশ, রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা এসব চিন্তার বিষয় নয়। একমাত্র চিন্তা মালিকশ্রেণির সুবিধা করে দেওয়া এবং তাদের মদতে ক্ষমতায় টিকে থাকা। এই সংগ্রাম কমিটির রাজ্য আহ্বায়ক এস ইউ সি আই (সি) দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড এস রাজিভন। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ইতিহাস তাঁদের এই সংগ্রামের প্রেরণা।