বাজেট হল দেশের মানুষের থেকে কর বাবদ সরকারের আয় এবং তা ব্যয়ের পরিকল্পনা। বাজেটে সরকার কোন খাতে এবং কী ভাবে খরচ করার পরিকল্পনা নিল তাতে সাধারণ মানুষ সম্পর্কে সরকারের ভাবনা বোঝা যায়, একই সাথে বোঝা যায় ধনীদের সম্পর্কে, পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের সম্পর্কে ভাবনাও। এ বারের বাজেট হল একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে। প্রায় এক বছর ধরে কোভিড মহামারি এবং লকডাউনে জনজীবন তছনছ হয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ ছোট-মাঝারি সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে, না হয় ধুঁকছে। কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে রোজগারহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। একটা ভাল অংশের মানুষের জীবনে ছোবল বসিয়েছে করোনা ভাইরাস। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, ওষুধ প্রভৃতি সব কিছুর দাম লাফিয়ে বাড়ছে। ধনী-দরিদ্রে ফারাক বাড়ছে এ যাবৎ কালের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে।
মানুষের আশা ছিল, এ বারের বাজেটে মানুষের এই দুদর্শাকে সরকার গুরুত্ব দেবে। এমন ব্যবস্থা সরকার নেবে যাতে অন্তত মানুষ দু’বেলা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে। কিন্তু গোটা বাজেট ঘেঁটে কোথাও তেমন ব্যবস্থার চিহ্নমাত্র পাওয়া গেল না। গোটা বাজেট জুড়ে শুধু ধনীদের, শিল্পপতি-পুঁজিপতিদের সেবা করার, পাইয়ে দেওয়ার রকমারি ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফল, সাধারণ মানুষের উপর আরও বেশি মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, ছাঁটাই বোঝা।
কাজ হারানো কোটি কোটি মানুষের কথা সরকার ভাবেইনি
প্রথমেই দেখা যাক, কাজ হারানো কোটি কোটি মানুষকে বাজেট কী দিল। লকডাউনে ২ কোটির বেশি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এদের একটা বিরাট অংশ পরিযায়ী শ্রমিক। এঁরা যেমন নিজের নিজের রাজ্যে ফিরে এসেছেন, তেমনই স্থানীয় মানুষও বিরাট সংখ্যায় কাজ হারিয়েছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের শত শত মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরার মর্মান্তিক দৃশ্যে গোটা দেশ জুড়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে বাধ্য হয়ে সরকার খাদ্য নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ায়। গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে চাল-গম এবং কিছু মানুষকে ডাল দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু পরিস্থিতি একই রকম থাকা সত্তে্বও নভেম্বরের পরই সরকার তা বন্ধ করে দেয়। কোভিড চলাকালে জনমতের চাপে খাদ্য নিরাপত্তা খাতে আগের বরাদ্দ ৭৮ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লক্ষ ৪৪ হাজার কোটি টাকা করা হলেও এবার তা নামিয়ে ২ হাজার কোটির সামান্য বেশি করা হয়েছে। এতখানি কমানোর কারণ কী? কাজ হারানো মানুষগুলি কি আবার কাজ ফিরে পেয়েছে? এর কোনও উত্তর সরকার দেয়নি। পুঁজিপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিলেও গরিব সাধারণ মানুষকে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত দিতেও রাজি নয় এই সরকার।
মানুষ আশা করেছিল, এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে একশো দিনের কাজ প্রকল্পে সরকার বরাদ্দ বাড়াবে এবং কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দুশো দিন করবে। বাড়ানো দূরের কথা, সরকার বরাদ্দ ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা করেছে। কাজ হারানো মানুষগুলিকে কাজ দেওয়া, তাঁদের অনহার-অর্ধাহারের হাত থেকে রক্ষা করা দায়িত্ব বলেই মনে করে না এই সরকার।
সরকারি নীতিতেই অপুষ্টি বাড়ছে
২০২০ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স রিপোর্টে ফুটে উঠেছে অপুষ্ট ভারতের মর্মান্তিক ছবি। ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তানেরও নিচে নেমে গিয়ে ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ৯৪। এ দেশে অপুষ্টির মাত্রা আফ্রিকার বহু দারিদ্রপীড়িত দেশের তুলনায় দ্বিগুণ। রাষ্ট্রসংঘের একটি (ইউএন-এফএও) রিপোর্ট বলছে, ভারতের প্রায় ২০ কোটি মানুষের প্রতিদিন দু’বেলা ভরপেট খাবার জোটে না। অথচ সরকার বাজেটেই স্বীকার করেছে, খাদ্য সংগ্রহের পরিমাণ বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। তথ্য দেখাচ্ছে, দেশের মানুষের যে পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন সরকারের ভাণ্ডারে তার প্রায় আড়াই গুণ খাদ্য মজুত রয়েছে। অথচ মানুষকে না দিয়ে সেই মজুত চাল সরকার মদ কোম্পানিগুলিকে দিয়ে দিচ্ছে অ্যালকোহল তৈরি করার জন্য। সরকারের চরম জনবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দেওয়ার ব্যবস্থার পথে প্রধান বাধা।
শুধু কৃষক আন্দোলনের নয়, কৃষক স্বার্থেরই বিরোধী বিজেপি সরকার
বিজেপি সরকারের যে নীতি, তাতে কৃষকরা যে বাজেট থেকে ভাল কিছু পাবে তা কেউই আশা করেননি। ঘটেওছে তাই। নূ্যনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) দেশের কৃষকদের দীর্ঘদিনের দাবি। এবারও বাজেটে তা প্রত্যাখ্যাতই হয়েছে। কৃষকদের জীবনে এর ফল কী ভাবে বর্তাচ্ছে? আলু চাষিদের কথাই ধরা যাক। যে আলু এক মাস আগে দেশের মানুষ পঞ্চাশ টাকা কেজি কিনতে বাধ্য হয়েছে, সেই আলুই এখন উৎপাদক চাষিরা তিন টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে। ধান, গম, আখ প্রভৃতি প্রায় সব ধরনের কৃষকের অবস্থাই এক। এই সরকার নাকি কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেবে!
যে পিএম কিসান প্রকল্পের কথা বিজেপির তাবড় নেতা-মন্ত্রী বুক ঠুকে বলতে ভালবাসেন সেই প্রকল্পে বরাদ্দ কমানোয় কৃষকদের কোন মঙ্গল-উদ্দেশ্য কাজ করছে? কৃষকদের বছরে ৬ হাজার টাকা দেওয়ার এই প্রকল্পে গত বারের ৭৫ হাজার কোটি টাকা সরকার পুরোটা খরচই করেনি। এবার বরাদ্দ কমিয়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের ৬০ বছর বয়সের পর থেকে মাসে ৩ হাজার টাকা পেনশন প্রকল্পে বরাদ্দ ২২০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে মাত্র ৫০ কোটি টাকা করা হয়েছে। কৃষকদরদি সরকারই বটে!
কৃষি পরিকাঠামো তৈরির জন্য ১ লক্ষ কোটি টাকার তহবিল গড়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে বাজেটে। এই টাকা আসবে কোথা থেকে? এর জন্য সরকার পেট্রোলে আড়াই টাকা প্রতি লিটার ও ডিজেলে ৪ টাকা প্রতি লিটার সেস চাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমত, এর ফলে সেই কৃষকদের উপরই বোঝা চাপবে! সেচের খরচ বাড়বে। তা ছাড়া, তেলে সেস মানে সব রকমের পরিবহণের খরচ বেড়ে যাওয়া! কৃষক সহ সাধারণ মানুষকেই এর বোঝা বইতে হবে। সদুদ্দেশ্য থাকলে সরকার কৃষকদের এবং গণপরিবহণকে এই সেসের আওতা থেকে বাদ দিত। তা ছাড়া, দেশের পুঁজিপতিরা লকডাউনের মারাত্মক সময়েও ৩৫ শতাংশ বাড়তি মুনাফা করেছে। আম্বানির মুনাফা প্রতি ঘণ্টায় ৯০ কোটি টাকা হারে বেড়েছে। তাদের বাদ দিয়ে গরিবের ঘাড়ে বোঝা চাপানো কেন? দ্বিতীয়ত, এই কৃষি পরিকাঠামো দেশের ৮৬ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের কোন কাজে লাগবে? বাজেটে এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য, কৃষিপণ্যের ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদের স্বল্পসূদে বা বিনা সুদে ঋণ দেওয়া। ইতিমধ্যেই আম্বানি-আদানি এবং অন্য বৃহৎ ব্যবসায়ীরা এই প্রকল্পের টাকায় বিরাটাকার হিমঘর, গুদামঘর তৈরি করছে। আগামী দিনেও এই টাকা তাদেরই কাজে লাগবে। সরকার অবশ্য বলেছে, এই টাকায় নাকি তারা মান্ডি তৈরি করবে। এমএসপির আইনি গ্যারান্টি ছাড়া নতুন আইন কার্যকর হলে মান্ডিগুলি সাধারণ কৃষকদের কোন কাজে লাগবে? তা ছাড়া, কৃষকরা ঋণ চায় না, চায় সার-বীজ-কীটনাশক-ডিজেল-বিদ্যুতের দাম কমানো হোক, সরকার ফসলের ন্যায্য দাম দিক। এই টাকায় সরকার কেন তার ব্যবস্থা করল না? আসলে আম্বানি-আদানিদের কৃষিপণ্যের ব্যবসার জন্য পুঁজির ব্যবস্থা করে দেওয়াই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। এর মধ্যে কৃষক-কল্যাণের ছিটেফোঁটাও নেই।
প্রধানমন্ত্রী এক সময়ে ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশে’র স্লোগান তুলেছিলেন। তাঁর এই ‘সব’–এর মধ্যে কি দেশের সাধারণ মানুষ পড়ে না? বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের কাছে আম্বানি-আদানিরাই যে একমাত্র ‘সব’ তা বাজেটের ছত্রে ছত্রে স্পষ্ট। রান্নার গ্যাসে সরকার ভর্তুকি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে লাফিয়ে বাড়ছে জ্বালানির দাম। গরিব মানুষের একটা বড় অংশ জ্বালানির জন্য কেরোসিনের ওপর নির্ভরশীল। সেই কেরোসিনের ওপর থেকে সমস্ত ভর্তুকি তুলে নিয়েছে এই সরকার– এমনই এদের জনদরদ!
স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কমিয়ে জনস্বাস্থ্যকে চরম অবহেলা করা হয়েছে
স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ নিয়ে বাজেটে সরাসরি মিথ্যাচার করেছে এই সরকার। হিসেবের কারিকুরিতে দেখাতে চেয়েছে যেন এ বার বরাদ্দ বেশি করা হয়েছে। খুঁটিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অন্যান্য খাতের টাকাও এ বার স্বাস্থ্যখাতে ঢোকানো হয়েছে। এমনকি করোনা ভ্যাক্সিনের জন্য বরাদ্দ ৩৫ হাজার কোটি টাকাও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বলে দেখানো হয়েছে। এই ভাবে অর্থমন্ত্রী দেখিয়েছেন যেন তিনি ১৩৭ শতাংশ বরাদ্দ বেশি করেছেন। বাস্তবে স্বাস্থ্যখাতে এ বার বরাদ্দ গত বাজেটের থেকে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। অথচ দেশের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার দশা যে কতখানি বেহাল, করোনা অতিমারি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। আসলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বেসরকারি পুঁজিকে সুযোগ করে দিতেই বিজেপি সরকার যে জনস্বাস্থ্যকে চরম অবহেলা করে চলেছে এ বারের বাজেট তার স্পষ্ট উদাহরণ।
শিক্ষার সুযোগ নয়, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়াই সরকারের নীতি
শিক্ষাখাতে গত বছরের তুলনায় বাজেট বরাদ্দ প্রায় ৬.১৩ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত বছর বরাদ্দ ছিল ৯৯ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। সেই টাকাও সরকার পুরো খরচ করেনি। এ বছর বরাদ্দ করা হয়েছে ৮৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অথচ কোভিড অতিমারি ও লকডাউনের কারণে টানা প্রায় এক বছর বেশির ভাগ ছাত্রই পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সেই ক্ষতি পূরণ করে দিতে এ বার প্রয়োজন ছিল শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানো। শুধু তাই নয়, ভারতের মতো দেশে যেখানে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী দরিদ্র-নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি থেকে আসে, সেখানে অনলাইন শিক্ষার নামে সরকার দেশি-বিদেশি টেলিব্যবসায়ীদের বিপুল মুনাফার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দেখা গেছে, লকডাউনের সময়ে ব্যবসা করেই বেশ কিছু আইটি ব্যবসায়ী শত কোটিপতি হিসাবে উঠে এসেছেন। জাতীয় শিক্ষা নীতিতে শিক্ষার যে আমূল বেসরকারিকরণের প্রস্তাব রাখা হয়েছে বাজেটে তাতেই সিলমোহর দেওয়া হয়েছে। বাজেটে প্রি-স্কুলে পড়া বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতেই প্রি-স্কুল শিক্ষার জন্য অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। অঙ্গনওয়াড়িগুলির পরিকাঠামো যা, তাতে সব শিশুর প্রি-স্কুল শিক্ষার ব্যবস্থা যে তাতে হওয়া সম্ভব নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিমধ্যেই প্রি-স্কুল শিক্ষার একটা বড় অংশ বেসরকারি স্কুলগুলির মালিকরা দখল নিয়েছে। এ বার বাজেটে প্রি-স্কুল শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে সেই বেসরকারি শিক্ষাব্যবসারই বাড়বাড়ন্তের ব্যবস্থা করা হল। পিপিপি মডেলে ১০০টি সৈনিক স্কুল স্থাপনের প্রস্তাব আসলে সরকারি খরচে বেসরকারি পুঁজিকে মুনাফার সুযোগ করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
জনগণের করের টাকায় গড়ে ওঠা রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ জলের দামে পুঁজিপতিদের পায়ে
গত এক বছরে সরকারের বাজেট ঘাটতি অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে ৯.৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এই অবস্থায় সরকার রাজকোষ ভরাতে অন্য কোনও আয়ের সংস্থান করার বদলে সরকারি সম্পদ বেচে দেওয়াকেই একমাত্র উপায় ঠাওরেছে। সরকারের মন্ত্রীরা বৃদ্ধির আকাশকুসুমের গল্প শোনাতে ছাড়েন না, অথচ আয়ের জন্য সরকারি সম্পত্তি বেচা ছাড়া তাঁরা আর কোনও উপায় দেখতে পান না। এ যেন জমিদারের অপদার্থ সন্তানের সম্পত্তি বেচে জমিদারি চাল বজায় রাখার মতো ব্যাপার। বিজেপি সরকার তাদের ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের হাতে দেশের প্রায় সব সম্পদই তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, রেল, তেল, গ্যাস, বিমানবন্দর, ব্যাঙ্ক, বিমা প্রভৃতি সব কিছু বেসরকারিকরণের মাধ্যমে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে এই বাজেটে। ২০২১-২২-এ সম্পত্তি বেচে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী বাজেট বত্তৃতায় জানিয়েছেন, আইডিবিআই ব্যাঙ্ক ছাড়াও দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং একটি সাধারণ বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণ করা হবে। এলআইসি-র শেয়ার বাজারে ছাড়তে প্রয়োজনীয় আইনি সংশোধনী এই অধিবেশনেই আনার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই জনগণের করের টাকায় তৈরি এই সব সংস্থাগুলি জলের দামে পেয়ে যাওয়ার ঘোষণায় শিল্পমহল বাজেটের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অন্য দিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের চাকরিতে যেমন কোপ পড়বে তেমনই নতুন কর্মসংস্থানও মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তা ছাড়া বেসরকারি মালিকানা মানেই ব্যাপক জনগণকে শুষে নিয়ে মুনাফার আয়োজন। ফলে হানা দেবে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, যা সাধারণ মানুষকেই বইতে হবে। বাজেটে বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের সীমা ৪৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৪ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। বিলগ্নিকরণের ঘোষিত উদ্দেশ্য যদি হয় আয় বাড়ানো, তবে আসল উদ্দেশ্য দেশীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে এই সব সম্পদ তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্র যে একচেটিয়া পুঁজির লেজুড়ে পরিণত হয়েছে, এ সবই তার প্রমাণ।
বাজেট : পুঁজিপতি শ্রেণির পদসেবার নির্লজ্জ দলিল
ভারত একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। পুঁজিপতি শ্রেণির পুঁজির স্বার্থ, মুনাফার স্বার্থ সব দিক থেকে রক্ষা করাই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কাজ। যে সরকার এ কাজ যত দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে সেই সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা পুঁজিপতি শ্রেণির তত বেশি সমর্থন পায় এবং ক্ষমতায় থাকে। মুনাফা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে শোষণ করে। কিন্তু তা ঢাকতে সরকারের মন্ত্রীরা জনগণের স্বার্থের ধুয়ো তোলেন। জনগণের ক্ষোভ বাড়তে বাড়তে যখন বিক্ষোভের আকারে ফেটে পড়ে তখন পুঁজিপতি শ্রেণি ক্ষমতায় নিয়ে আসে তাদেরই স্বার্থরক্ষাকারী আর একটি দলকে। দীর্ঘ দিন কংগ্রেস ক্ষমতায় থেকে পুঁজিপতি শ্রেণির সেবা করতে গিয়ে জনগণের রোষের মুখে পড়লে পুঁজিপতি শ্রেণি আর এক বিশ্বস্ত সেবাদাস হিসাবে ক্ষমতায় বসিয়েছে বিজেপি সরকারকে। পুঁজিবাদী নির্বাচনের সত্যিকারের রূপটি তুলে ধরতে শ্রমিক শ্রেণির শিক্ষক, সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা লেনিন দেখিয়েছিলেন, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন আসলে পাঁচ বছর ধরে জনগণকে শোষণ করে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার কাজটি পুঁজিপতি শ্রেণিরই বিশ্বস্ত কোন দল করবে তারই নির্বাচন। স্বাধীন ভারতে দারিদ্র ক্রমাগত বাড়তে থাকা এবং পুঁজিপতি শ্রেণির ক্রমাগত সম্পদ বৃদ্ধি দেখলেই মহান লেনিনের বক্তব্যের সত্যতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি বাজেট বিশ্লেষণ করলে সেগুলি সবই যে পুঁজিপতি শ্রেণিরই স্বার্থ রক্ষা করেছে এবং শ্রমিক-কৃষক সহ সাধারণ মানুষ যে দুরবস্থার অতল গহ্বরে ডুবেছে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। এ বারের বাজেটও কর্পোরেট পুঁজির পদসেবার নির্লজ্জ দলিল ছাড়া আর কিছু নয়।