কেনাকাটাই নেই, তবু নাকি ভারতের অর্থনীতি সবচেয়ে দ্রুত এগোচ্ছে!

ছোটবেলার বইতে দেখা তেলের ঘানিতে বাঁধা বলদের ছবিটা মনে পড়ে? ঘানির চাকার সাথে ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় বারবার ফিরে আসত তারা। এখন ভারতীয় অর্থনীতির কর্ণধারদের এগিয়ে চলার চেষ্টা দেখে সেই চাকায় বাঁধা প্রাণীগুলোর উদাহরণ বেশি বেশি করে মনে আসছে।

বেশ কিছুদিন ধরেই সারা দেশে জিনিসপত্রের দাম ভয়াবহ হারে বেড়ে চলেছে। ফলে বাজারে কেনাকাটা কমছে। আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার দু’বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়ে ঠেকেছে ৫.৪ শতাংশে। অবশ্য মোদিজির দলবল ভারতকে ‘বিশ্বের দ্রুততম অর্থনীতি’ বলে গলা ফাটিয়ে চলেছেন! এদিকে তেল-সাবান-শ্যাম্পু থেকে বিস্কুট-মুড়ি-চানাচুর-পাঁউরুটির পর্যন্ত দাম বেড়ে চলেছে। মূল্যবৃদ্ধিকে কিছুটা বাগে আনার চেষ্টায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তারা আগে থেকেই ব্যাঙ্কের সুদ বাড়িয়ে রেখেছেন। কিন্তু তাতেও কোনও সুরাহার আশা নেই। বিক্রি কমার ফলে এই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের (এফএমসিজি) কোম্পানিগুলি কমে যাওয়া মুনাফা পোষাতে হয় নতুন করে দাম বাড়াচ্ছে, না হলে দাম একই রেখে প্যাকেটে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ জিনিস কম দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞ সংস্থা কান্টারের সমীক্ষা জানাচ্ছে, পরিবারগুলো মাসকাবারি বা সাপ্তাহিক বাজার করার বদলে গড়ে আড়াই দিনে একবার ছোট ছোট প্যাকেট কিনে সংসার সামাল দিচ্ছে। এই ধরনের অত্যাবশ্যক পণ্য কেনার খাতে পরিবারগুলির মাসিক খরচ বেড়েছে গড়ে ১৮ শতাংশ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ এবং ৩০ নভেম্বর ২০২৪)। এর ফলে অন্যান্য ভোগ্যপণ্য কেনার হার কমছে। এর ধাক্কায় প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশ্বগুরু’ হওয়ার স্বপ্নে ছাই দিয়ে দেশে শিল্প উৎপাদনও কমে চলেছে। তারই অনুষঙ্গ হিসাবে কমছে কর্মসংস্থানের হার। এই দেখেকেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল রীতিমতো হুমকি দিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি দেখে ভয় পেলে চলবে না, অবিলম্বে ব্যাঙ্কের সুদ কমাতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির হাতে রাখা আবশ্যিক তহবিল কমিয়ে বাজারে টাকা ছাড়তে হবে বেশি করে। একই সাথে বন্ডে এবং ব্যাঙ্ক ঋণেও সুদ কমাতে হবে। তার কয়েকদিন পরেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীও বলেছেন, ব্যাঙ্কের সুদ কমাতেই হবে, না হলে ঋণের চাহিদা বাড়বে না। আর তাতেই বেসরকারি বিনিয়োগের বান ডাকবে এবং তার হাত ধরেই কাটবে কর্মসংস্থানের খরা।

সত্যিই কি তাই! বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা নিদান দেন, সরকার ব্যাঙ্কের আমানত ও ঋণের ওপর সুদ কমিয়ে এবং নানা পথে বাজারে টাকার জোগান বাড়ালে মানুষের হাতে বেশি নগদ টাকা থাকবে, ফলে মানুষ বেশি জিনিস কিনলে কিছুটা চাহিদা বাড়বে। এতে পুঁজি মালিকরা উৎসাহিত হয়ে বিনিয়োগ বাড়ালে কর্মসংস্থানের খরা কাটবে, অর্থনীতি গতিলাভ করবে। কিন্তু সমাজে মোট উৎপাদিত মূল্যের তুলনায় অর্থনীতিতে টাকার জোগান বাড়লে বেশি পরিমাণ টাকায় কম জিনিস পাওয়া যায়। এতে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। হাতে নগদ টাকা বেশি থাকলে মানুষ বেশি জিনিস কিনতে চাইলেও সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ‌্যে পুঁজিমালিকরা ততটা উৎপাদন করে না। এর ফলে জোগান কমে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, কেনাকাটা মার খায়। তখন আবার চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদনও কমতে থাকে। ফলে পুঁজি খাটার জায়গা পায় না, অলস পুঁজি বেড়ে যায়। বাড়ে বেকারত্ব। তখন আবার বাজারের স্থায়িত্ব ধরে রাখতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিচালকরা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সুদ এবং ব্যাঙ্কে জমা থাকা আবশ্যিক তহবিলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। তাতে অর্থনীতিতে টাকার জোগান কমে। বেশি সুদের আশায় কিছু মানুষ বেশি সঞ্চয়ের দিকে ঝোঁকে। এর ফলে কেনাকাটা কমে গিয়ে বাজারে পণ্য বিক্রি কম হয়, চাহিদা কমে গিয়ে দামও কমে যায়। এতেও আবার সমস্যা– এর ফলে বিনিয়োগ কমে, উৎপাদন কমে, কর্মসংস্থানও কমে। এ এক অদ্ভূত দুষ্টচক্র!

ব্যাঙ্কের সুদ কমিয়ে দিলে জিনিসের দাম বেড়ে মানুষের কেনার ক্ষমতা কমে গিয়ে অর্থনীতিতে সংকট আসে। আবার ব্যাঙ্কে সুদ বাড়িয়ে তাকে সামাল দিতে গেলেও কর্মসংস্থান কমে গিয়ে মানুষের কেনার ক্ষমতা কমে যেতে থাকে। পুঁজিবাদী বাজারের রোগ সারাতে তার কর্তাদের হাতে যে দুটি ওষুধ আছে, দেখা যাচ্ছে সেগুলি রোগ সারানোর পরিবর্তে তার মাত্রাই বাড়িয়ে দিচ্ছে!

যদিও, এই বিষয়ে একটা প্রশ্নের উত্তর বিজেপি মন্ত্রীদের দিতে হবে। দাম নিয়ন্ত্রণে সুদ তো বেশ কিছুদিন ধরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বাড়িয়ে রেখেছে। তাতে কোন জিনিসটার দাম কমেছে? উচ্চবিত্তের জন্য কিছু মহার্ঘ পণ্যের দাম হয়তো কমতে পারে! সাধারণ জনগণ যে সব জিনিস ব্যবহার করেন, তার কোনটা সস্তা হয়েছে? উত্তরটা জনগণ জানে না, মন্ত্রীমশাইদেরও পক্ষেও এমন জিনিস খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

কিন্তু মোদিজির রাজত্বে ভারতীয় অর্থনীতির বহর ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে প্রায় পৌঁছেই গেছে নাকি! তাহলে আর চিন্তা কী? বাস্তবটা হল, বিজেপি সরকারের কর্তারা নিজেরাই জানেন অর্থনীতির কী হাল তাঁরা করেছেন! কেন্দ্রীয় সরকার যতই পরিসংখ্যানকে চাপা দিয়ে রাখতে উদ্যোগী হোক না কেন, তাদের সব ঢাকাঢাকিকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে বেকারত্ব, রোজগারহীনতার তীব্রতা। এর ছোবল আজ ঘরে ঘরে, তা ঢাকবার কোনও উপায় নেই। শিল্প উৎপাদন এক মাস একটু বাড়ে তো পরের মাসে পুরোপুরি শুয়ে পড়ে। ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, খনি, বিদ্যুৎ, ভারি শিল্পের অবস্থা খুবই সঙ্গীন। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা রূপায়ণ মন্ত্রকের তথ্য অনুসারে গত আগস্টে সারা দেশে শিল্প উৎপাদন বাড়ার বদলে গত বছরের আগস্টের তুলনায় সংকুচিত হয়েছে ০.১ শতাংশ। এই কম ভিত্তির ওপরে সেপ্টেম্বরে ৩ শতাংশের মতো বৃদ্ধি তারা দেখালেও সমীক্ষা সংস্থা ইক্রার মতে, ২০২৩-এর তুলনায় এই বছর অক্টোবর-নভেম্বরে শিল্প-উৎপাদন অন্তত ৩ থেকে ৪ শতাংশ সংকুচিত হবে (ইকনমিক টাইমস, ১২.১১.২০২৪)।

বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীরা ব্যাঙ্কের আমানত এবং ঋণের ওপর সুদ কমিয়ে পুঁজিমালিকদের জন্য পুঁজির জোগাড় করে দিতে ব্যগ্র। কিন্তু তাঁরা যে কথাটা বলছেন না, এই পুঁজিটা খাটবে কোথায়? অধিকাংশ মানুষের কেনার ক্ষমতা না থাকলে পুঁজি কী উৎপাদন করবে? সরকার পরিকাঠামো খাতে ব্যয় বাড়িয়ে, যুদ্ধাস্ত্র, সামরিক উৎপাদনে পুঁজি ঢালার রাস্তা করে দিয়ে সাময়িক কিছু রিলিফ পুঁজিমালিকদের দিতে পারে। তাতে কি সামগ্রিক বাজারের হাল ফিরবে? কোনও আশা নেই। এ দেশে উৎপাদন মার খায় কি পুঁজির অভাবে? তাহলে ধনকুবেরদের সিন্দুকে যে বিপুল পরিমাণ পুঁজি উদ্বৃত্ত পড়ে আছে সেগুলো কাজে লাগে না কেন? ব্যাঙ্কের থেকে ইতিমধ্যে যে বিপুল পরিমাণ টাকা কর্পোরেট মালিকরা ঋণ নিয়ে বসে আছে, সেগুলি শিল্প গড়তে কাজে লাগল না কেন? কেন শিল্পের বদলে বৃহৎ পুঁজি ফাটকার কারবার, বন্ড ইত্যাদি ফিনান্স বাজার, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, ইনসিওরেন্স কোম্পানির দিকে বেশি ঝুঁকছে? প্রশ্ন আসে, কোভিডের আগে বহু বছর ধরে ব্যাঙ্কের সুদের হার ছিল একেবারে তলানিতে। সেই সময় কি শিল্পের বান ডেকেছে? বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান বেড়েছে? ইউপিএ জমানার শেষ দিক এবং মোদি সরকারের প্রথম ছয় সাত বছরে ব্যাঙ্কের সুদ কমেছে। আর্থিক নীতি সংক্রান্ত সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাক্স দেখিয়েছে, ২০১৫-থেকে ২০২০-তে ভারতে ব্যাঙ্কের গড় সুদ ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। তাতে কি বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং তার সঙ্গে মিলিয়ে কর্মসংস্থান বেড়েছে? তথ্য বলছে, বাস্তবটা ঠিক বিপরীত। সেই সময় বেকারত্ব ৪৫ বছরে সর্বাধিক বেড়েছে। শিল্প উৎপাদন ক্রমাগত কমেছে।

আজ ভারতের যে আর্থিক পরিস্থিতি তাতে সুদ বাড়ুক আর কমুক, মানুষের কেনাকাটার ক্ষমতা বাড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। এই সত্যটাকেই মোদি সাহেবরা আড়াল করতে ব্যগ্র। তাঁরা দুনিয়া জুড়ে বলে বেড়াচ্ছেন, দেশের অর্থনীতির বহর এতটাই বেড়েছে যে ভারত এখন দুনিয়ার পঞ্চম অর্থনীতির দেশে পরিণত। অথচ মাথাপিছু আয় ধরলে ভারতের স্থান ১৩৯ নম্বরে। মনে রাখতে হবে এর মধ্যে ছেলের বিয়েতে ৫ হাজার কোটি টাকা উড়িয়ে দেওয়া আম্বানি, আদানি থেকে শুরু করে ১০০ জন ধনকুবের যেমন আছেন, তেমনই দুনিয়ার এক-চতুর্থাংশ অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের বাসভূমি এ দেশ। খাদ্যই যারা জোগাড় করতে পারছে না, তারা ব্যাঙ্কের সুদ কমলে ঋণ নিয়ে কী কিনতে বাজারে যাবে? সরকারি হিসাবে এ দেশের মানুষের গড় ব্যয়ের ক্ষমতা গ্রামে দৈনিক ১২৬ টাকা, শহরে ২১৫ টাকা। এর মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে থাকা ৭ কোটি গ্রামীণ মানুষ গড়ে ৪৬ টাকার বেশি ব্যয় করতে অক্ষম (এনডি টিভি ২৫.০২.২৪)। এই গড়ের মধ্যেও আদানি, আম্বানি থেকে গ্রামের দরিদ্রতম খেতমজুর সবার হিসাবই ধরা আছে। আজকের দিনে জীবন নির্বাহের খরচ যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে এই সামান্য টাকায় অধিকাংশ মানুষের খাদ্য জোগাড় করাই দুষ্কর। অন্যান্য ভোগ্যপণ্য তারা কিনবে কী করে? তার ক্রেতা মূলত মধ্যবিত্তরা, অথচ সরকারি সমীক্ষাতেই দেখা যাচ্ছে ভারতে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। এ দেশে জনসংখ্যার খুব বেশি হলে ৩ শতাংশ (৪ কোটির সামান্য বেশি) দিনে ৮০০ টাকার বেশি ব্যয় করতে পারেন (দ্য ওয়্যার, ২৭.১০.২৪)। তাহলে এ কথা তো বলাই যায় যে, সরকার অন্তত এদের কেনাকাটা বাড়ার আশায় বসে নেই!

তাহলে কাদের জন্য এত সুদ কমিয়ে চাহিদা বাড়ানোর হুঙ্কার? ভারতে এখন কমদামি গাড়ি, কমদামি ফ্ল্যাট ইত্যাদির চাহিদা কমছে। কিন্তু বাড়ছে দামি গাড়ি, দামি ফ্ল্যাট ইত্যাদির চাহিদা। ব্যাঙ্কের সুদ কমলে এই সমস্ত দামি সম্পত্তির ক্রেতারা আরও ঋণ নেবেন। ধনকুবের পুঁজিমালিকরা এখনই ব্যাঙ্কের ১২ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ গায়েব করে বসে আছেন। সরকার তার বড় অংশ ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দিলেও এখনও ৫ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া ঋণ সেখানে জ্বলজ্বল করছে। ব্যাঙ্কে জনগণের গচ্ছিত টাকা আরও সহজ শর্তে ঋণ হিসাবে যাতে ব্যাঙ্ক এই ধনকুবেরদের হাতে তুলে দিতে পারে তার জন্যই বিজেপি সরকারের মন্ত্রীদের এত সুদ কমানোর সওয়াল নয় কি? তাতে হয়তো সামান্য কিছু মধ্যবিত্ত দু-চারটি জিনিস কিনবেন। তাতে তো আর শিল্পের বান ডাকবে না! ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে জনস্বার্থে উৎপাদন হয় এমন শিল্পের দরজাও খুলবে না। তাহলে, বিনিয়োগের সিংহভাগ যাবে কোথায়? যাবে ভারতীয় একচেটিয়া মালিকদের অস্ত্রব্যবসা, শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদি ব্যবসায়। এই পথেই জনগণের ঘর থেকে আরও বেশি সম্পদ গিয়ে জমা হবে জালিয়াতি করে নিজের কোম্পানির দাম বাড়ানো পুঁজিপতিদের সিন্দুকে। ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস হিসাবে বিজেপি তার এই কর্তব্যে অবিচল।