কৃষক আন্দোলনের দাবি মানার ঘোষণা করতে গিয়ে কৃষকদের দুঃখে নাকি চোখের জলই ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী! কৃষকদের ভাল করতে চেয়েও তাঁদের ‘বোঝাতে না পারা’র দুঃখ তিনি উগরে দিয়েছেন টিভির পর্দায়। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি সরকার দেশের কৃষকদের ব্যাঙ্ক ঋণ দেওয়ার নামে আসলে কাদের হাতে জনগণের গচ্ছিত টাকা তুলে দিয়েছে?
‘দ্য ওয়ার’ সংবাদমাধ্যম ২০১৮ সালে তথ্যের অধিকার আইনে প্রশ্ন করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছ থেকে জেনেছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো ৫৮ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা কৃষিঋণ দিয়েছে মাত্র ৬১৫টি অ্যাকাউন্টে। অর্থাৎ গড়ে প্রায় ৯৫ কোটি টাকা ঋণ গেছে এই ‘কৃষকদের’ কাছে। এর মধ্যে কেউ কেউ পেয়েছে ১০০ কোটি টাকারও বেশি।
১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে যারা, তারা কেমন কৃষক? এই ‘কৃষক’দের মধ্যে আছে আম্বানিদের রিলায়েন্স ফ্রেস, আছে আদানি, গোয়েঙ্কা, টাটা এমন সব একচেটিয়া মালিকদের পরিচালনায় চলা বৃহৎ কৃষি কোম্পানি।
এই সংবাদমাধ্যমই স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে রাজ্যভিত্তিক কৃষিঋণের তথ্য চাইলে এই ব্যাঙ্কের মুম্বই জোন ছাড়া আর কোনও জোন তথ্য দেয়নি। দেখা যাচ্ছে মুম্বই শহরের সবচেয়ে ধনী এলাকায় স্টেট ব্যাঙ্কের শাখা তিনটি অ্যাকাউন্টে কৃষি ঋণ দিয়েছে ২৯.৯৫ কোটি টাকা। আর ২৭ কোটি টাকা দিয়েছে ৯টি অ্যাকাউন্টে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা আছে কৃষিঋণ মানে– কৃষক যে ঋণ নিয়েছে বা ঋণের টাকা পেয়েছে। তথ্য দেখাচ্ছে স্বল্প সুদের এই কৃষিঋণ গেছে একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের কোম্পানিগুলির কাছেই। এই হল কৃষক দরদের নমুনা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোর গলায় বলে চলেছেন, কৃষকদের আয় তিনি দ্বিগুণ করে দেবেন। আর তার জন্যই নাকি তিনটি কৃষি আইন তিনি এনেছিলেন। কৃষক আন্দোলনের জোয়ারের সামনে আপাতত তা থেকে পিছু হটলেও তাঁরা যে কৃষিকে সম্পূর্ণভাবে একচেটিয়া মালিকদের হাতে তুলে দিতেই বদ্ধপরিকর তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এ জন্য যে কোনও ভাবে হোক না কেন আপাতত বাতিল করতে বাধ্য হওয়া তিন কৃষি আইন কিংবা পারলে তার থেকেও মারাত্মক আইন কৃষকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য যে সরকার ওৎ পেতে আছে, তা কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রীর কথাতে স্পষ্ট হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি আইন আনার অনেক আগে থেকেই একচেটিয়া মালিকদের কর্পোরেট কোম্পানিগুলি কৃষি ফসল কেনা, গুদামজাত করা, তার সামগ্রিক ব্যবসার বিশাল পরিকাঠামো নির্মাণ শুরু করে দিয়েছিল, একথা আজ জানা। তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল এই কর্পোরেটদের নির্দেশেই সরকার তিন কৃষি আইন এনেছে।
এখন দেখা যাচ্ছে, কৃষিঋণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাধারণ মানুষের টাকা আসলে ঢালা হয়েছে একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের কৃষিপণ্য পুরোপুরি কুক্ষিগত করার পরিকাঠামো নির্মাণে। তার সাথে ঢালা হয়েছে বড় বড় শপিং মল রিটেল চেনের ব্যবসায়, যে সব মলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি তাদের ছাপ মারা প্যাকেটবন্দি কৃষিপণ্য বিক্রি করবে। ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন, বিগবাস্কেট ইত্যাদি নামে তারা কাঁচা সবজি, মাছ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অনলাইন ব্যবসা করবে। এ জন্যই ব্যয়িত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অধিকাংশ কৃষিঋণ।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, কৃষিঋণের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক সুদ নেয় মাত্র ৪ শতাংশ। ফলে নামমাত্র সুদে বৃহৎ কোম্পানিগুলি এই ঋণের টাকায় তাদের আখের গুছিয়েছে। আবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ফসল নষ্ট হলে যখন কৃষিঋণ মকুব করার দাবি ওঠে এবং কিছু মকুবও হয়, তখন তার ষোল আনা লাভ কৃষকের পরিবর্তে এই পুঁজিপতিরাই পেয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার বলেছিল, ১১ লক্ষ কোটি টাকা কৃষিঋণ দেবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারেই শুধু আরটিআইতে যেটুকু জেনেছে ‘দ্য ওয়ার’, তার বাইরেও নানা পথে কৃষিঋণের বড় অংশের টাকা গেছে একচেটিয়া মালিকদের কাছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা একাধিকবার দেখিয়েছে, ১৯৯০ সালে অর্থনীতির উদারিকরণ, বিশ্বায়ন শুরু হওয়ার পর থেকে যত দিন গেছে সরকারি তরফে ক্ষুদ্র কৃষিঋণ কমেছে, বৃহৎ ঋণ বেড়েছে। ২০১৪ থেকে বিজেপির আমলে সরকারি কৃষিঋণের মাত্র ১৪ শতাংশ গেছে .০১ হেক্টরের থেকে কম জমির মালিকদের কাছে। ২৪ শতাংশের বেশি গেছে সেই কৃষকদের কাছে যারা ১০ লক্ষ টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে পারে। অথচ একেবারে ক্ষুদ্র কৃষকরাই মহাজনী ঋণের জালে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের ঘরে চাষে খাটানোর মতো টাকা থাকেই না। সরকার সহজে ঋণ ও সহায়তা না দিলে তাদের পক্ষে চাষ করা তো দূরের কথা বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৮.০২.২০১৯)
ঐতিহাসিক কৃষি আন্দোলনের সময় সারা ভারতে জনগণ কৃষকদের অন্নদাতা বলে সম্মান জানিয়েছে। সেই কৃষকদের পরিস্থিতি কী তা কারও অজানা নয়। সার, বীজ, কীটনাশক, সব ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি, ডিজেল, বিদ্যুৎ সবকিছুর দাম বাড়ায় ফসল ফলানোর খরচ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এদিকে বাজারে সাধারণ ক্রেতার জন্য চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, সবজি, ভোজ্য তেলের দাম যতই বাড়ুক না কেন, চাষি যখন বাজারে ফসল বেচতে যায় তখন ফসলের দাম থাকে সবচেয়ে কম। সাধারণ চাষির পক্ষে কৃষিকে ক্রমাগত অলাভজনক করে তোলার জন্য একটা বিশাল চক্র কাজ করে চলেছে। মাঝে মাঝে কিছু ছোটখাটো ফড়ে, মহাজনদের বিরুদ্ধে সরকারি দলগুলি কথা বললেও যে বড় বড় পুঁজি-মালিকরা বাজারের উপর তাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের জোরে কৃষি ফসল নিয়ে এখনই যে ফাটকা খেলছে, ইচ্ছামতো মজুত করে এবং বাজারের দামকে সরাসরি কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে বা কমিয়ে ইতিমধ্যেই সাধারণ চাষিকে জমি-ছাড়া করতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তা সরকার জানে না তা নয়। নাসিকের পেঁয়াজ চাষি কিংবা পশ্চিমবঙ্গের আলু চাষিদের খবর যাঁরা রাখেন তাঁরা এই চক্রের কারসাজি খুবই ভাল জানেন।
সম্প্রতি সরষের তেল, সাদা ভোজ্য তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় বড় কোম্পানিগুলির কারসাজি কত সর্বনাশা হতে পারে তা মানুষ দেখেছে। তারা ফসল ওঠার সময় কৃষকদের থেকে তৈলবীজ কিনেছে সামান্য দামে। তারপর বেআইনিভাবে তা বিপুল পরিমাণে মজুত করেছে, তারপর বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করে সুযোগ বুঝে তেলের দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাড়ছে কৃষকের আত্মহত্যা।
জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২০-তে কৃষির সাথে যুক্ত ১০ হাজার ৬৭৭ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক ৫৫৭৯ জন, ভূমিহীন ভাগচাষি ও খেতমজুর ৫০৯৮ জন। (টাইমস অফ ইন্ডিয়া ২৯.১০.২০২১) যদিও কি রাজ্য কি কেন্দ্র কোনও সরকারই বেশিরভাগ চাষির আত্মহত্যার কারণ হিসাবে এই দুর্বিষহ কৃষি পরিস্থিতির কথা স্বীকারই করে না। পারিবারিক অশান্তি, অভাবের কারণে আত্মহত্যা বলে চালায়। পুলিশে চাষির আত্মহত্যা বলে রেকর্ড হয় আসল ঘটনার অতি সামান্য অংশ। তাতেও দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেক দিন ২৯ জনের বেশি অর্থাৎ প্রত্যেক ঘন্টায় একাধিক চাষি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে জীবনের জ্বালা জুড়োচ্ছেন।
এই যখন অবস্থা, সে সময় সরকার এবং তার পরিচালনায় থাকা ব্যাঙ্কগুলোর কাজ ছিল না কি অনেক বেশি ক্ষুদ্র, মাঝারি কৃষক, ভূমিহীন বার্গাদার, ভাগচাষি, কৃষির উপর নির্ভরশীলখেতমজুরদের জন্য অতি সহজ শর্তে, বিনা সুদে ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করা? প্রয়োজনে কৃষি মজুরির সরাসরি দায়িত্ব নেওয়া? কৃষকদের সার-বীজ-কীটনাশক কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া মালিকদের হাতে ছেড়ে না দিয়ে এইগুলি এবং অন্য সমস্ত কৃষি উপকরণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ-ডিজেল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরকারি উদ্যোগে সস্তায় কৃষকদের দেওয়ার ব্যবস্থা করাই ছিল জরুরি। কিন্তু দেখা গেল সরকার হেঁটেছে ঠিক তার বিপরীত পথে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার যে তিনটি কৃষি আইন এনেছে তার প্রধান অভিমুখই হল কৃষি ক্ষেত্রে কর্পোরেট মালিকদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল বিজেপি থেকে শুরু করে তাঁর বিরোধী সংসদীয় সব দলই কৃষিঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যদিও ভোট মিটে যেতেই তাদের কারও এ বিষয়ে বিশেষ মাথাব্যথা দেখা যায়নি। একচেটিয়া পুঁজি মালিক কর্পোরেট কোম্পানির টাকায় চলা সংবাদমাধ্যম এবং ভোটবাজ সংসদীয় দলগুলি মাঝেমাঝেই একটা ধুয়ো ধরে– সমস্ত ক্ষুদ্র-মাঝারি কৃষিঋণ মকুব করলে অনাদায়ী ঋণের চাপে ইতিমধ্যেই বিপর্যস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির উপর প্রবল চাপ বাড়বে। সরকারি তহবিলের উপরেও চাপ পড়বে, যা অর্থনীতির ক্ষেত্রে নাকি সমস্যা সৃষ্টি করবে। কথাটা যে কত বড় মিথ্যা, তা দেখা যায় সরকারের দেওয়া হিসাবেই। ১০টা রাজ্য সরকার মিলে ২০১৮-তে ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যদিও এর কত শতাংশ বাস্তবে তারা মকুব করেছে তার তথ্য ঠিকমতো সরকার দেয়নি। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের বদান্যতায় ওই বছরেই মাত্র ১২টি বৃহৎ কর্পোরেট কোম্পানি ঋণ ফেরত না দেওয়ায় ব্যাঙ্কগুলির অনুৎপাদক সম্পদ দাঁড়িয়েছিল ৩ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। যা ‘রাইট অফ’ অর্থাৎ খাতা থেকে মুছে দিয়েছে সরকার (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৮.০২.২০১৯)।
কৃষকদের উন্নতির অজুহাত দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বকলমে একচেটিয়া মালিকদের হাতে জনগণের গচ্ছিত সম্পদ তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার আবারও দেখিয়ে দিল এই দেশের সরকার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সমস্ত শাসনব্যবস্থা আসলে কাদের তাঁবেদারি করে। একচেটিয়া মালিকদের সেবাদাস হিসাবে কখনও বিজেপি, কখনও কংগ্রেস যে-ই কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের গদিতে যাক না কেন, তাদের কাছে আজ ভোটের অর্থেও জনগণের কোনও দাম নেই। তারা জানে টাকার জোরই হচ্ছে আসলে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রধান জোর। শ্রমিক, কৃষক থেকে শুরু করে সমাজের সমস্ত স্তরের খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি আজ বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সরকারের কোনও দায় নেই। এই পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের সামনে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে দিল্লির সীমান্তে চলা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন। এই আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রশক্তির সমস্ত নখ-দাঁত এবং কর্পোরেট মালিকদের টাকার থলি ও প্রচারমাধ্যমের মোকাবিলা করে কীভাবে সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য দাবি করতে পারে। এই পথেই কৃষকদের প্রতি সরকারের প্রতারণাকে মোকাবিলা করতে হবে। আগামী ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি সারা দেশ জুড়ে খেটে-খাওয়া মানুষের দাবি নিয়ে সাধারণ ধর্মঘটে এজন্যই সামিল হবেন সমস্ত কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-যুব সহ সব পেশা সর্বস্তরের জনগণ।