এ দেশের কৃষক-খেতমজুর জীবনের অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশার কথা কারও অজানা নয়। প্রতি ১২ মিনিটে একজন কৃষক এ দেশে আত্মহত্যা করেন। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে দারিদ্রের দুঃসহ জ্বালা সহ্য করে তাঁদের দিনাতিপাত করতে হয়। এ দিকে কোনও সরকারেরই কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। তাঁরা ব্যস্ত দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির সেবা করতে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই সব একচেটিয়া পুঁজির সম্পদ প্রতিদিন ফুলে ফেঁপে উঠছে, আর জনগণ নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, দেশের ১ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশ গিয়ে জড়ো হয়েছে। এই হল দেশের বাস্তব পরিস্থিতি।
এই কর্পোরেট পুঁজিপতিদের সম্পদ স্ফীতিকেই উন্নয়ন বলে দাবি করছেন একদল ধামাধরা বুদ্ধিজীবী। তাঁরা নানা কুযুক্তি তুলে শোষণের এই মহোৎসবকে ন্যায়সঙ্গত প্রতিপন্ন করতে চাইছেন। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁরা অনেক সময় গরিব মানুষের প্রতি একধরনের ছদ্ম সহানুভূতি দেখান, দু-একটা সরকার বিরোধী কথাও বলেন, রাষ্ট্রকে একটু উপদেশও দেন। কিন্তু মূল জায়গায় আঁকড়ে থাকতে তাঁদের ভুল হয় না। রাষ্ট্রীয় যে নীতির ফলে গরিব মানুষের জীবনে এই দুর্দশা, পুঁজিপতিদের এই সম্পদ স্ফীতি তা যেন বহাল তবিয়তে বজায় থাকে সে দিকে তাঁদের প্রখর দৃষ্টি। এই ধরনের একটা সম্পাদকীয় নিবন্ধ গত ১৮ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘ধামাচাপার চেষ্টা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। এই নিবন্ধেও লেখক অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে একই কাজ করেছেন। কেন্দ্রীয় কৃষিনীতির বিরুদ্ধে শুরুতে একটু বিরোধিতার ভাব প্রকাশ করে মাঝামাঝি জায়গায় এসে ঝুলি থেকে বেড়াল বের করে দিয়েছেন।
প্রবন্ধে লেখা হয়েছে– চাষিরা যে পর্যায়ে সরকারি সুরক্ষা চাইছেন এবং কৃষিকে বেসরকারি বিনিয়োগ থেকে দূরে রাখতে চাইছেন, তাতে চাষ কার্যত একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ মোদ্দা কথা হল, যেহেতু চাষকে কার্যত একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে পরিণত করা যায় না, তাই চাষি যে সব সুযোগ সুবিধা চাইছে তা তাকে দেওয়া সম্ভব নয় এবং বেসরকারি বিনিয়োগ থেকে কৃষিকে মুক্ত করার দাবিও অযৌক্তিক। সম্পাদকীয় নিবন্ধের এই যুক্তিকে আমাদের বিচার করে দেখতে হবে। কিন্তু তার আগে দেখা দরকার আমাদের দেশে কৃষি এতদিন কোন নিয়মে পরিচালিত হয়েছে, এতদিন কাদের স্বার্থ রক্ষা করেছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশের কৃষি বিকশিত হয়েছে পুঁজিবাদী পথে। এই পথ বেয়ে, বিশেষ করে তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের পর থেকে ধীরে ধীরে কৃষি উৎপাদন সামগ্রী, জমি ও কৃষি বিপণন এক এক করে একচেটিয়া পুঁজির করতলগত হতে থাকে। দেখা যায়, সমস্ত কৃষি উপকরণ ও কৃষিজ পণ্য চলে গিয়েছে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে। সমস্ত সরকারি নীতি ও পরিকল্পনা এই লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। ফলে গ্রামাঞ্চলে কৃষক ক্রমাগত জমি হারিয়ে খেতমজুরে পরিণত হচ্ছে। আর খেতমজুর পরিণত হচ্ছে ভিখারিতে। নয়া আর্থিক নীতি গ্রহণের পর এই প্রক্রিয়া আরও বেগবান হয়েছে। অর্থাৎ বলা যায়, স্বাধীনতার পর সমস্ত সময় জুড়েই কৃষকদের এই সর্বনাশ করা হয়েছে। আর এই সময়ে ক্ষমতায় ছিল প্রধানত কংগ্রেস।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি কি কোনও ভিন্ন পথ গ্রহণ করেছে? না। তারা এই প্রক্রিয়া আরও বেগবান করেছে, একচেটিয়া পুঁজির সেবা করার কাজে এরা আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এরা কী কী নীতি গ্রহণ করেছে সে দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক।
১। সমস্ত কৃষি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সার, বীজ, বিদ্যুৎ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি উপকরণের বেসরকারিকরণ করা। বিজেপি এই বিষয়টাকে চরম সীমায় নিয়ে গিয়েছে। সার, বীজ, কীটনাশক, জল, বিদ্যুৎ প্রভৃতির উপর বৃহৎ বহুজাতিক পুঁজির কর্তৃত্ব এখন প্রশ্নাতীত। ফলে এই সব কৃষিপণ্য উৎপাদন সামগ্রীর দাম হয়েছে আকাশছোঁয়া। ফলে চাষের খরচ বাড়ছে। চাষে নগদ টাকার প্রয়োজন বাড়ছে। বিদ্যুৎ-ক্ষেত্রকে বহুজাতিক পুঁজির হাতে পুরোপুরি তুলে দেওয়ার জন্য বিজেপি সরকার বিদ্যুৎ বিল ২০২৩ প্রণয়ন করেছে।
২। নগদ টাকার ব্যবস্থা সরকার করছে না। বিজেপি সরকারের কৃষিঋণ-নীতির ফলে ক্ষুদ্র মাঝারি প্রান্তিক কৃষকদের ব্যাঙ্কঋণ পাওয়ার উপায় নেই। ফলে তাঁদের গ্রামের মহাজনদের দ্বারস্থ হতে হয়, অনেক বেশি সুদে টাকা ধার করতে হয়। ফলে ঋণের বোঝা বাড়ে, কৃষক আত্মহত্যা বৃদ্ধি পায়।
৩। লাভজনক দামে ফসল বিক্রির ব্যবস্থা নেই। বিজেপি সরকার মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসকে আইনসিদ্ধ করতে চাইছে না। ঘোষণা করেছিল ২৩টি কৃষিজ দ্রব্য এমএসপি রেটে কিনবে। কিন্তু বাস্তবে কিছুটা কিনছে চাল আর গম এবং তার পরিমাণ ক্রমাগত কমছে। যতটুকু কিনছে তা কিনছে মূলত পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে। দেশের মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক এর সুযোগ পায়।
বিজেপি সরকার এই ব্যবস্থাও বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বেসরকারি মান্ডি খুলে শস্য সংগ্রহের অধিকার বৃহৎ পুঁজিকে দিয়ে দেওয়ার ফলে শস্যবাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এই বৃহৎ পুঁজির ভূমিকা এখন নিয়ন্ত্রণকারী।
৪। খুচরো ব্যবসায় দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির প্রবেশের অবাধ অধিকার দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কৃত্রিম ভাবে দাম কমিয়ে ছোট ব্যবসা এবং কৃষককে বাজার থেকে হটিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা এদের অসীম। আগে কৃষকরা ছোটখাটো ফড়েদের সাথে খানিকটা লড়তে পারত। কিন্তু বৃহৎ পুঁজির সামনে কৃষকরা এখন অসহায়।
এ বছর হিমাচলপ্রদেশে কৃষকরা আদানি কোম্পানির কাছে আপেল ১৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। সেই আপেল আদানি রিটেল চেন দিল্লিতে বিক্রি করেছে ২৬৯ টাকা কেজি দরে। মনে রাখতে হবে, এই রিটেল চেন যখন আপেল-বাজারে ঢুকতে পারেনি তখন আপেল চাষিরা দাম পেত গড়পড়তা ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে। এ একটা সামান্য উদাহরণ।
৫। বিজেপি সরকার কৃষিজ দ্রব্যের আমদানি রপ্তানি নীতির ব্যাপক পরিবর্তন করেছে। সবটাই করেছে দেশের খাদ্য ব্যবসায়ীদের মুনাফার কথা মাথায় রেখে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। কেন্দ্রীয় সরকার মিট সিন্ডিকেটকে অনুমতি দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া থেকে সস্তায় দুধ আমদানি করার। এর ফলে দেশের লক্ষ লক্ষ দুধ-চাষির রুটি-রুজির সর্বনাশ হয়েছে। তৈলবীজ, আখ ইত্যাদির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার তুলোর উপর আমদানি শুল্ক ৩০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে দেশের লক্ষ লক্ষ তুলো চাষির সমূহ সর্বনাশ হয়েছে।
৬। ২০১৬ সালে বিজেপি সরকার মডেল এগ্রিকালচারাল ল্যান্ড লিজ অ্যাক্ট প্রণয়ন করে। উদ্দেশ্য হল কৃষি জমিকে অকৃষি কাজে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া। এই আইনবলে লক্ষ লক্ষ একর কৃষি জমি বহুজাতিক পুঁজির হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৭। বিজেপি সরকার ২০২০ সালে ন্যাশনাল হাইওয়ে অ্যাক্ট সংশোধন করে জমি অধিগ্রহণের এক বিরাট পরিকল্পনা করেছে। এই আইন অনুযায়ী সরকার জাতীয় সড়কের উভয় পাশের ২ কিলোমিটার পর্যন্ত জমি কৃষকের সম্মতি না নিয়েই অধিগ্রহণ করতে পারবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার বাস্তবে কয়েক কোটি একর জমি অধিগ্রহণের আওতায় নিয়ে এল।
৮। বিজেপি সরকার বিভিন্ন কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই চুক্তি চাষ চালু করেছে।
৯। ফসল বিমার ক্ষেত্রে বিজেপি সরকার এক চূড়ান্ত ধাপ্পাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা। কিন্তু বাস্তবে এটা কী? এই যোজনা অনুযায়ী কৃষককে বিমার প্রিমিয়াম দিতে হবে বহুজাতিক কোম্পানিকে। এই কোম্পানি ঠিক করবে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ। এর ফলে বহুজাতিক বিমা কোম্পানির পোয়াবারো হয়েছে। তারা জমা প্রিমিয়ামের ৯৭ শতাংশ টাকাই সরিয়ে ফেলছে। বিপুল মুনাফা লুটছে। চাষিদের সাহায্য করার নামে তাদের দুঃখ নিয়ে এ এক অদ্ভুত ধরনের ব্যবসা।
১০। বিজেপি সরকার একশো দিনের কাজের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ আগের তুলনায় অনেক কম। তার আবার সবটা খরচ করা হয় না। আইনকে এমন জটিল করা হচ্ছে যার উদ্দেশ্য হল কেউ যেন কাজ করার উৎসাহ বোধ না করে। এই ভাবে একশো দিনের কাজের আইনকে বাস্তবে অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই সমস্ত কৃষক বিরোধী আইন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার উৎসাহের সাথে কার্যকর করছে। এই সব প্রশ্নে এদের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। একশো দিনের কাজের ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতি সীমাহীন। ফলে এই রাজ্যে এই আইনে কাজ পাওয়ার বিষয়টি প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ২০১৪ সালে তৃণমূল সরকার চুক্তি চাষ সংক্রান্ত আইন তৈরি করেছে। ২০১৯ সালে করেছে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আইন। সেই আইনে এ কথা বলা হয়েছে, কৃষকের সম্মতি না নিয়েও তার জমি অধিগ্রহণ করা যাবে। বৃহৎ পুঁজির রিটেল চেনকে রাজ্যে খুচরো ব্যবসায় বাধাহীন ভাবে কাজ করতে দেওয়ার জন্য ‘সিঙ্গল উইন্ডো সিস্টেম’ বা ‘এক জানালা ব্যবস্থা’ চালু করা হচ্ছে। ধান কিছুটা কেনা ছাড়া রাজ্য সরকার আর কোনও ফসল কেনার ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করে না। পাট এই রাজ্যের ফসল। দেশের ৭০ শতাংশ পাট এই রাজ্যে তৈরি হয়। ১৫ লক্ষ পাটচাষি পরিবার এর সাথে যুক্ত। অথচ রাজ্য সরকার এক কেজি পাট কোনও দিন কেনেনি। এই হল কৃষকের ফসল কেনার ক্ষেত্রে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের অবস্থা।
এই সমস্ত ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রের ও রাজ্যের সব সরকারই একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থেই সমস্ত নিয়ম কানুন প্রণয়ন করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। একে বলা যায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বেসরকারিকরণ। অর্থাৎ, গুটিকতক পুঁজিপতির স্বার্থে কোটি কোটি কৃষক খেতমজুরের সর্বনাশ। যাঁরা পুঁজিপতিদের ধামাধরা সেই সব বুদ্ধিজীবীদের এতে কোনও আপত্তি নেই। ওঁরা মনে করেন, এটাই স্বাভাবিক। মনে করেন গরিব মানুষের জীবনের মূল্য কী, তারা তো মরবেই। ওঁদের মতে ধনীর ধনস্ফীতিই হল উন্নয়ন। সেই উন্নয়নের জন্য কাজ করাই হল রাষ্টে্রর দায়িত্ব।
কিন্তু নিপীড়িত শোষিত কৃষক-মজুর তো বাঁচতে চাইবেনই। তাঁরা তো চাইবেনই রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা করুক যাতে তাঁরা ধনে প্রাণে মারা না পড়েন, যাতে তাঁদের সন্তান সন্ততি দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পায়, রোগ হলে চিকিৎসা পায়, শিক্ষার আলো পায়। তার জন্য কৃষিকাজ লাভজনক হতেই হবে। দুটো পয়সা হাতে থাকতে হবে।
আর এটা করতে চাইলে, সরকারকে দুটো কাজ করতেই হবে। এক, চাষের খরচ কমানো। অর্থাৎ, সার, বীজ, বিদ্যুৎ ইত্যাদির দাম কমাতে হবে এবং সরকারকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ, বেসরকারি মালিকরা এই কাজ করে না, করতে পারে না। সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের জন্য তারা সর্বোচ্চ শোষণ করবেই। দেখা গেছে, সার বীজ তেল বিদ্যুৎ একচেটিয়া পুঁজির হাতে চলে যাওয়ার ফলে বাজারে তার দাম বেড়েছে বহুগুণ। তাই কৃষকরা দাবি তুলেছে কৃষি উৎপাদনের জন্য এই সব প্রয়োজনীয় শিল্পসামগ্রী সস্তায় সরকারকেই সরাসরি সরবরাহ করতে হবে।
দুই, ফসল লাভজনক দামে বিক্রি করার সুব্যবস্থা। বেসরকারি মালিকরা এটাও করবে না। তারা ফসল কেনার সময় কৃত্রিমভাবে দাম কমিয়ে দেবে। কৃষকের ফসল কম দামে কিনে গুদামজাত করবে, বিপুল মুনাফা লুটবে। এদের হাতে যদি কৃষিবিপণন ব্যবস্থা ছেড়ে দেওয়া হয় তবে কৃষকের সর্বনাশ, সর্বনাশ সাধারণ মানুষেরও। হচ্ছেও তাই। স্বাভাবিকভাবে কৃষকরা একচেটিয়া পুঁজির এই সর্বাত্মক আক্রমণের হাত থেকে মুক্তি চাইছে। তাই তারা দাবি তুলেছে ২৩টি কৃষিজ দ্রব্যের উপর এমএসপি চালু করো, এমএসপি-কে আইনসঙ্গত করো,প্রকৃত উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম দিয়ে (C২+৫০%) কৃষকের ফসল কিনে নাও, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের প্রবেশ বন্ধ কর়ো। কিন্তু একচেটিয়া পুঁজির ক্রীতদাস বিজেপি সরকার ও ধামাধরা বুদ্ধিজীবীরা বলছেন– কী অসম্ভব দাবি! এত টাকা কোথায়? এ তো রাজকোষ ফাঁকা করে দেওয়ার চক্রান্ত!
টাকা কোথা থেকে আসবে সেই আলোচনায় একটু পরে আসছি। কিন্তু তার আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করা দরকার। বিষয় হল, সরকারের কাজ কী? সরকারের প্রাথমিক কাজ হল সাধারণ মানুষের খাদ্য- বস্ত্র- বাসস্থান-শিক্ষার ব্যবস্থা করা। সমস্ত সভ্য সরকারেরই এটা প্রাথমিক দায়িত্ব। আমাদের দেশে সরকার এই দায়িত্ব পালন করছে না। তারা সবকিছুকেই পণ্যে পরিণত করেছে। অর্থাৎ সবকিছুই জনগণকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ইত্যাদি সবকিছু। সরকার হল এমন এক পরিবারের প্রধান যার পরিবারের সদস্যদের খাওয়াবার দায়িত্ব নেই, লেখাপড়া শেখাবার দায়িত্ব নেই, রোগ হলে চিকিৎসা করানোর দায়িত্ব নেই। পরিবারের এমন প্রধানের আমাদের প্রয়োজন কী? কিন্তু এই সরকার কিছুই করে না তা তো নয়! এরা ক্ষুধার্ত জনগণকে লাঠি-গুলি-টিয়ারগ্যাস উপহার দেয়। কালা কানুন জারি করে জনগণের প্রতিবাদের কণ্ঠকে সবলে চেপে ধরতে চায়। কৃষকরা এই সরকারের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাই দিল্লি আন্দোলনের সময় তাঁরা স্লোগান তুলেছিলেন ‘কর্পোরেট হামারা দুশমন হ্যায়’– একচেটিয়া পুঁজিপতিরা আমাদের শত্রু। আর সরকার হল এই একচেটিয়া পুঁজির সেবাদাস।
এই পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা কোনও সরকারের নেই। তাই বছর বছর ওরা যে নীতি গ্রহণ করে তাতে জনগণের সর্বনাশ হয়, পুঁজিপতিদের হয় পৌষমাস। এই কারণে এই সরকারগুলো টাকার অভাবের অজুহাত দেখায়। না হলে হিসাবকষে বারবার দেখানো হয়েছে ২৩টি কৃষিপণ্যের এমএসপি চালু করে সরকার কৃষকদের কাছ থেকে খরচের দেড়গুণ দরে ফসল কিনে সাধারণ মানুষের কাছে সস্তা দরে তা বিক্রির ব্যবস্থা করলে অর্থাৎ এক কথায় সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করলে সরকারের কোষাগার থেকে কত টাকা খরচ হতে পারে? বর্তমান ব্যয়ের উপর মাত্র দেড় লক্ষ থেকে দুই লক্ষ কোটি টাকা। এই টাকাটা দেশের মানুষেরই টাকা। দেশের ১৪০ কোটি মানুষের জন্য এই সামান্য টাকা খরচ করার ক্ষমতা সরকারের যদি না থাকে, তাহলে সরকার মাত্র কয়েকটা পুঁজিপতি গোষ্ঠীকে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা কর ছাড়, আমদানি শুল্ক রপ্তানি শুল্ক মকুব, অনাদায়ী ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করে কী করে?
এই সহজ প্রশ্নের উত্তর বিজেপি সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা দিতে পারবেন না, জবাব দিতে পারবেন না একচেটিয়া পুঁজির ধামাধরা অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরাও। তাই সাধারণ মানুষের জন্য যখন অর্থ খরচের দাবি ওঠে তখন এরা নানা কু-যুক্তি হাজির করে, সমস্বরে বলে ওঠে– বেসরকারি উদ্যোগকে দুর্বল করা চলবে না। এর অর্থ হল, জনগণের ট্যাক্সের টাকা পুঁজিপতিদের পকেটে গুঁজে দাও, দেশের জল জঙ্গল জমি খনিজ সম্পদ সব দিয়ে দাও আদানি-আম্বানিদের মতো হাঙরদের পকেটে। জনগণের সর্বনাশ হলে হোক।
কৃষকরা লড়ছেন এই সর্বনাশা ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য। তার কিছুটা নমুনা আমরা দেখেছি দিল্লির কৃষক আন্দোলনে। ১৩ মাস ব্যাপী এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে ৭৫০ জন কৃষক আত্মাহুতি দিয়েছেন। সগর্বে তাঁরা বলেছেন, আমরা লড়বো আমরা জিতবো। তাঁরা মোদি সরকারকে বাধ্য করেছিলেন তিনটি কালা কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে। এই পথ অনুসরণ করেই দেশের কৃষকরা আবার প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন, আবার তাঁরা লড়বেন, আবার তাঁরা শাসক-শোষকের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেবেন। এই প্রক্রিয়া অবিরাম চলতেই থাকবে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান না হওয়া পর্যন্ত।