স্বপ্নের ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে রইল নীতিন কুথুরের তৈরি হতে চলা বাড়িটা। কেরালা থেকে বছর পাঁচেক আগে কুয়েত পাড়ি দিয়েছিলেন নীতিন, সেখানকার এনবিটিসি কোম্পানিতে ড্রাইভারের চাকরি নিয়ে। গত ১২ জুন ভোররাতে দক্ষিণ কুয়েতের মানগাফে যে বাড়িটিতে বিধ্বংসী আগুন লাগে, তারই একটা ঘরে পুড়ে মারা যান তিনি। বছরখানেক আগে বাড়ির শুধু ভিতটুকু তৈরি কর়েছিলেন। আশা ছিল, কুয়েতে কাজ করে টাকা জমিয়ে সেটি সম্পূর্ণ করবেন।
দেশে ভালো কাজ না মেলায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর কেরালার সাজন জর্জকে কুয়েতে কাজ করতে পাঠান তাঁর বাবা, গত এপ্রিলে। এ দিন মৃত্যু হয়েছে তাঁরও।
বাড়িতে এসে পৌঁছেছে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের বাসিন্দা দ্বারিকেশ পট্টনায়কের নিথর দেহ। তিনিও এনবিটিসি কোম্পানির কর্মী হিসাবে থাকতেন মানগাফের ওই বাড়িতে।
কুয়েতের এই অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত যে ৫০ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে, তার মধ্যে ৪৬ জনই ভারতীয়। ২৪ জনের বাড়ি কেরালায়, বাকিরা অন্য রাজ্যের। এঁরা সকলেই ছিলেন এনবিটিসি কোম্পানির শ্রমিক-কর্মচারী। মানগাফ শহরে কোম্পানির দেওয়া ওই বাড়িতে যত জনের জায়গা হয়, তার ঢের বেশি– প্রায় দুশো জন কর্মী থাকতেন। দুর্ঘটনার পর বোঝা গেছে, কোম্পানি বাড়িটিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলে কিছুই রাখেনি। ছিল না কোনও রকম অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা, জরুরিকালীন বেরনোর রাস্তা বা ফায়ার অ্যালার্ম। ফলে এ দিন ভোর রাতে যখন আগুন লাগে, ঘুমন্ত বাসিন্দারা অনেকক্ষণ পর্যন্ত বিপদের আঁচই করতে পারেননি। আগুন লেগেছে বুঝতে পারার পরেও বেরনোর পথ পাননি হতভাগ্য মানুষগুলি। কেউ ঝলসে পুড়ে, অনেকে প্রবল ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। বাঁচতে চেয়ে উপর তলা থেকে বেপরোয়া ঝাঁপ দিয়ে মারা গেছেন শামির উমারুদ্দিন নামের এক হতভাগ্য কর্মী।
পুড়ে যাওয়া বাড়িটি ঘুরে দেখে কুয়েত প্রশাসনের প্রতিনিধি মন্তব্য করেছেন, এই দুর্ঘটনা রিয়েল এস্টেট মালিকের লোভের ফল। প্রশ্ন ওঠে, এ কথা কি আগে তাঁদের জানা ছিল না! ভিনদেশ থেকে যে মানুষগুলি গিয়ে কুয়েত দেশটিকে গড়ে তোলার কাজে দিনরাত পরিশ্রম করছেন, তাঁরা কেমন ভাবে দিন কাটাচ্ছেন, কাজের জায়গায় কোনও রকম বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন কি না, এ সবের খোঁজ রাখা কি তাঁদের দায়িত্ব নয়? আসলে ভারত সরকারই হোক বা কুয়েত সরকার, এদের সকলের চোখেই এইসব শ্রমিক-কর্মচারীদের জীবন অনেকটা পোকামাকড়ের মতো, যাদের মরা-বাঁচা আদৌ বিবেচ্য বিষয়ই নয়। কারণ, এ কথা কুয়েত কিংবা ভারত– উভয় সরকারেরই জানা আছে যে, পেটের দায়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও শ্রমিক-কর্মচারীদের এই স্রোত বন্ধ হবে না।
কুয়েতের এই অগ্নিকাণ্ডে এ কথা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, বিদেশে কাজ নিয়ে চলে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নেই। খোদ সরকারি তথ্যই বলছে, এ দেশের প্রায় তিন কোটি শ্রমিক-কর্মচারী অভিবাসী হিসাবে দেশে দেশে কাজ করেন, যে সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এঁদের মধ্যে ৮৮ লক্ষই কাজ করেন কুয়েত, কাতার, সৌদি আরবের মতো উপসাগরীয় দেশগুলিতে। কুয়েতের মোট শ্রমিকসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ অধিকার করে আছেন ভারত থেকে যাওয়া ছুতোরমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, নির্মাণশ্রমিক, কারখানাশ্রমিক ও গৃহ-পরিচারক, ড্রাইভাররা। বছরের পর বছর নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে বার বার সামনে এসেছে এই মানুষগুলির অসহনীয় জীবনযাত্রার কথা। বহু সমীক্ষায় উঠে এসেছে, উপসাগরীয় দেশগুলিতে ভারতের অভিবাসী শ্রমিকদের কোনও রকম শ্রম-অধিকার না থাকার বিষয়টি। অমানুষিক কাজের পরিবেশ, বসবাসের অবর্ণনীয় দুর্দশা– কোনও কিছুই কেন্দ্রীয় সরকারের অজানা নয়। দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে পাসপোর্ট হাতছাড়া হওয়ার কারণে এইসব শ্রমিকদের অনেকেই কেমন করে ক্রীতদাসের জীবন কাটাতে বাধ্য হন– কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কাছে তার বহু রিপোর্ট আছে। দুক্সবছর আগে কাতারে স্টেডিয়াম তৈরির কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যুর খবরে শিউরে উঠেছিল গোটা দুনিয়া। তা সত্ত্বেও হেলদোল নেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের। অভিবাসী এই শ্রমিকদের সম্পর্কে বিশদ খোঁজখবর রাখা, তাঁদের নিরাপত্তা, কাজ ও বসবাসের সুপরিবেশ সুনিশ্চিত করার জন্য ওইসব দেশের সরকারের সঙ্গে কথা বলা ও প্রয়োজনে চাপ দেওয়া– কোনও কিছুই ভারত সরকার বোধহয় নিজের দায়িত্ব বলেই মনে করে না। এমনকি এই দুর্ঘটনার পরেও কুয়েতে ভারতীয় দূতাবাসের ঘুম ভাঙতে বহু সময় লেগেছে বলে অভিযোগ। অথচ এই বিপুল সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিকের পাঠানো ডলারে সমৃদ্ধ হয় দেশের অর্থভাণ্ডার, যা খরচ হয় ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-সাংসদ-নেতারা নিজেদের জীবনের বিলাসব্যাসন ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলতে।
কুয়েতের এই মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে ধিক্কার জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে একটি প্রশ্ন না করে পারা যায় না। প্রশ্নটি হল– মোদিজি, এই কি তবে আপনার ‘বিকশিত ভারত’-এর আসল চেহারা? ভারতকে অচিরেই ৭০০ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত করতে চলেছেন বলে প্রায়শই আপনার গর্বোদ্ধত প্রচার শোনা যায়। কিন্তু যে দেশের কোটি কোটি মানুষকে বাধ্য হতে হয় পেটের দায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে থাকতে, যে দেশের অভিবাসী কর্মীদের প্রায়শই মর্মান্তিক অকালমৃত্যুর শিকার হতে হয়, সে দেশের অর্থনীতি ৭০০ কোটি ডলার ছুঁতে পারল কি পারল না– সেটা কি আদৌ বিচার্য বিষয় হতে পারে! ‘উন্নয়ন’ ‘উন্নয়ন’ বলে আপনাদের সোল্লাস চিৎকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষগুলির জীবনের বিন্দুমাত্র উন্নতি ঘটাতে পারছে কি? শুধু তো অভিবাসী শ্রমিকরাই নন, দেশের বেকারসমস্যা আজ এত ভয়ঙ্করভাবে মাথা তুলেছে যে, বিদেশে ভাড়াটে সেনা হিসাবেও মৃত্যুর মুখে পা বাড়াতে হচ্ছে দেশের কর্মহীন তরুণ-যুবকদের। অতি সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম সূত্রে সামনে এসে গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভাড়াটে সেনার কাজ করতে সেখানে পাড়ি দিয়েছেন ভারতের কর্মহীন লাচার তরুণরা। ইতিমধ্যে এই যুদ্ধে মারাও গেছেন তাঁদের কয়েকজন। জানা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে ইজরায়েল সরকারের হয়ে কাজ করতে গেছেন কয়ের হাজার ভারতীয় শ্রমিক, যাঁদের পাঠানো হচ্ছে রাফা ও গাজার যুদ্ধক্ষেত্রে। লড়াইয়ের মাঝে পড়ে তাঁদের কয়েকজনের প্রাণও গেছে।
মোদিজি, এর পরেও কি ‘বিকশিত ভারত’ আর ‘৭০০ কোটি ডলারের অর্থনীতি’র বড়াই করে চলবেন আপনি! যে ঘটনায় লজ্জায়, ধিক্কারে, আত্মগ্লানিতে কেন্দ্রীয় সরকারের মাথা মাটিতে লুটিয়ে পড়ার কথা, সে ঘটনাকে ‘ম্যানেজ’ করতে কুয়েতে মৃতদের পরিবারপিছু ২ লক্ষ টাকা দিয়েই আপনি দায় সারতে চাইছেন! আপনার কি উচিত ছিল না, দেশবাসীর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে কুয়েত অগ্নিকাণ্ডে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ও রাফায় নিহত ভারতীয় তরুণদের মর্মান্তিক অকালমৃত্যুর দায় সম্পূর্ণ ভাবে নিজের কাঁধে নেওয়া এবং আগামী দিনে যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে, তার জন্য তৃতীয় বিজেপি সরকারকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে বলা? তা আপনি করলেন কোথায়!
পেটের দায়ে, সন্তান-আত্মজনদের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার তাড়নায় কুয়েত, রাশিয়া কিংবা ইজরায়েলে পাড়ি দেওয়া এতগুলি মানুষের মর্মান্তিক অকালমৃত্যুতে ক্ষিপ্ত ও ক্ষুব্ধ দেশের মানুষ আপনাকে ধিক্কার জানাচ্ছে এবং এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে অবিলম্বে তৃতীয় বিজেপি সরকারের জোরালো পদক্ষেপ দাবি করছে।