গত ৭ মার্চ কাশ্মীরে সভা করলেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তথা ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির পর এই প্রথমবার সেখানে পা রাখলেন নরেন্দ্র মোদি। শ্রীনগরে বক্সি স্টেডিয়ামের সেই সভায় যোগ দিতে সেদিন কয়েক হাজার সরকারি কর্মচারী ও সরকারি দফতরে কর্মরত দিনমজুরকে প্রবল ঠাণ্ডায় রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে বের করে আনা হয়েছিল।
সামনেই লোকসভা ভোট। তাই সভায় প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে কাশ্মীরকে দুর্দশার অতল খাদ থেকে স্বর্গের কোন উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার, গলা ফাটিয়ে তার খতিয়ান দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। বলেছেন, হাল ফিরে গেছে কাশ্মীরের। বিজেপি আমলে তৈরি হয়েছে ‘নতুন কাশ্মীর’। কাশ্মীর এখন শিকলমুক্ত। এরই জন্য নাকি মানুষ দশকের পর দশক অপেক্ষা করেছেন। উপস্থিত কাশ্মীরবাসীদের ধন্যবাদও জানিয়েছেন তিনি সমাবেশে আসার জন্য।
তা, মোদিজির এই ‘নতুন কাশ্মীর’ কতখানি নতুন? উপত্যকার প্রান্ত-প্রত্যন্ত থেকে মিলিটারির বুটের শব্দ মিলিয়ে গেছে কি? রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কবল থেকে বেরিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারছেন নাকি ভূস্বর্গের নাগরিকরা? স্বাধীন ভাবে মতপ্রকাশ সহ গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি ভোগ করতে পারছেন তাঁরা? অর্থনীতির উন্নতি হয়েছে? সে দিন সমবেত হয়েছিলেন যে হাজার হাজার মানুষ, তাঁরাই বা কারা? কাশ্মীরের নতুন চেহারায় তৃপ্ত হয়ে মোদিজির সভায় তাঁকে ধন্যবাদ জানাতেই তাঁরা এসেছিলেন নাকি?
দুঃখের হলেও সত্য, এই সব ক’টি প্রশ্নেরই উত্তর না-বাচক। ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার পাঁচ বছর পার হতে চলল, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ফাঁসে আজও শ্বাসরুদ্ধ কেন্দ্রশাসিত কাশ্মীর। বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের বহু প্রতিশ্রুতি সত্তে্বও ২০১৪ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত সেখানে কোনও নির্বাচন হয়নি। জোটেনি স্বতন্ত্র রাজ্যের মর্যাদা। আজও সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছেন বহু নিরীহ মানুষ। সরকারের সামান্যতম বিরোধিতা করলে, কিংবা রাজ্যের মানুষের প্রকৃত পরিস্থিতি সংবাদমাধ্যমে তুলে আনলে গণতন্ত্রের সমস্ত রীতিনীতি দু-পায়ে দলে গ্রেফতার করা চলছে সাধারণ মানুষকে, বিশেষ করে সাংবাদিকদের। বিরোধী দলের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। সর্বত্র বিরাজমান বেয়নেট উঁচানো মিলিটারির বুটের তলায় আজও পিষ্ট হচ্ছে কাশ্মীরের জনজীবন।
তা যদি না হত, প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী যদি কাশ্মীরে সুস্থিতি কায়েম হয়ে থাকত, তাহলে তাঁর সফর উপলক্ষে শ্রীনগর শহরটিকে দুর্গে পরিণত করতে হত কি? শুধু বক্সি স্টেডিয়ামের আশপাশের এলাকাই নয়, শ্রীনগরের বিরাট অংশ জুড়ে অনুমতি ছাড়া যানবাহন চলাচল সেদিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ৭ মার্চেই শুরু হওয়ার কথা ছিল কাশ্মীরের দশম শ্রেণির বোর্ডের পরীক্ষা। নরেন্দ্র মোদির সভার কারণে সেই পরীক্ষা পর্যন্ত স্থগিত করে দেওয়া হয়। সফর উপলক্ষে গোটা কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে, বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিক ও সংখ্যালঘুদের মহল্লাগুলিতে নিরাপত্তার বহর প্রবল ভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়েছিল। ঠিক এক মাস আগে ৭ ফেব্রুয়ারি শ্রীনগরের শহিদগঞ্জ এলাকায় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন দুই পরিযায়ী শ্রমিক। ফলে সতর্কতার অন্ত ছিল না পুলিশ-প্রশাসনের। যে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের উপর সন্ত্রাসবাদী হানা নিয়ে এত সাম্প্রদায়িক প্রচার চালায় বিজেপি, সেই পণ্ডিতদের সংগঠন ‘কাশ্মীরী পণ্ডিত সংঘর্ষ সমিতি’-র সভাপতি সঞ্জয় টিক্কুও নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাড়াবাড়িতে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে তাঁদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে, বাইরে বেশি চলাফেরা করতে নিষেধ করা হয়েছে। টিক্কু মন্তব্য করেছেন, এ সব থেকেই তো পরিষ্কার যে কাশ্মীর এখন কতখানি স্বাভাবিক! শ্রীনগরেরই এক ব্যবসায়ী বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে যদি এই মাপের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়, তাহলে বলতে হয় ৩৭০ ধারা বিলোপের ফলে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ দূর হয়ে গেছে বলে বিজেপির সমস্ত দাবি হয় অযৌক্তিক, না হয় এ সব করা হয়েছে সাধারণ মানুষের হয়রানি বাড়ানোর জন্য।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিই কাশ্মীরের মানুষের প্রতি মানবিকতা দেখাতে চান, তাহলে কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদাদান এবং নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করুন।’’
বাস্তবে এই হল কাশ্মীরের জনসাধারণের মনের কথা। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের কর্মকর্তাদেরও এ কথা অজানা নয়। তাই পাছে সভা ফ্লপ করে, তাই সমস্ত সরকারি দফতরে হুকুম জারি করে কমপক্ষে ৭ হাজার সরকারি কর্মচারীকে সেদিন সভায় উপস্থিত হতে বলা হয়েছিল। সরকারি দপ্তরগুলিতে কর্মরত কয়েকশো ঠিকা-কর্মীকেও সভায় হাজির হওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন প্রশাসনের বড়কর্তারা। লিখিত নির্দেশ ছিল না। কিন্তু কর্মীরা জানিয়েছেন, বড়কর্তাদের ভাবেভঙ্গিতে স্পষ্ট ছিল, সভায় উপস্থিত না থাকলে ফল ভালো হবে না। ফলে নানা অসুবিধা সত্তে্বও দূর দূরান্ত থেকে ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রবল ঠাণ্ডায় বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল সরকারি কর্মী ও ঠিকা শ্রমিকদের।
ফলে প্রধানমন্ত্রীর অনুগত সেনাবাহিনী কিংবা প্রশাসনের বড়কর্তারা যতই বলুন, নরেন্দ্র মোদির প্রথম প্রকাশ্য সভায় কাশ্মীরের মানুষ সেদিন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা ভালোবাসা থেকে আসেননি। তাঁরা এসেছিলেন ওপরওয়ালাদের চাপে বাধ্য হয়ে। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের এই ক্ষোভের কথা খুব ভালো করেই জানা আছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের। তাই বোধহয় সেখানে বিধানসভা নির্বাচন করতে এত গড়িমসি তাদের।