কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ট্রাম তুলে দিতে চাইছে সরকার

শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর সামনে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়।

এই বছরই কলকাতা ট্রামের দেড়শো বছর পূর্ণ হতে চলেছে। ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তার পথচলা শুরু। সেসময় ট্রাম ছিল ঘোড়ায় টানা। শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত চলাচল ছিল ট্রামের। যদিও ওই বছরই ২০ নভেম্বর যাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কয়েক বছরের বিরতির পর ১৮৮০ সালের ১ নভেম্বর লর্ড রিপনের হাত ধরে ট্রামের পুনরায় যাত্রা শুরু হয় শহর কলকাতায়। কলকাতায় প্রথম কলের ট্রাম বা স্টিমচালিত ট্রাম আসে ১৮৮২ সালে। চৌরঙ্গি ও খিদিরপুর রুটে অল্প কিছু দিন তা চলেছিল। কলকাতায় প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চালু হয় ১৯০২ সালে ২৭ মার্চ, খিদিরপুর থেকে ধর্মতলা রুটে। এটি এশিয়ার প্রথম ট্রাম পরিবহণ ব্যবস্থা।

স্বাধীনতার পরেও ব্রিটিশ কোম্পানির দায়িত্বেই ছিল ট্রাম পরিবহণ ব্যবস্থা। তারা মুনাফা বাড়াতে ১৯৫৩ সালে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের টিকিটের ভাড়া ১ পয়সা বাড়ানোর বিজ্ঞপ্তি জারি হলে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে শহর কলকাতা। এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) সহ বামপন্থী দলগুলোর নেতৃত্বে ট্রাম ও বাসভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে গড়ে উঠে ‘প্রতিরোধ কমিটি’। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত করে। আন্দোলন দমনে জারি হয় ১৪৪ ধারা, নেমে আসে পুলিশি নির্যাতন, গ্রেপ্তার হন অসংখ্য সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। আন্দোলনের ব্যাপকতা দেখে সরকার বাধ্য হয় ভাড়াবৃদ্ধি নিয়ে কমিশন গঠন করতে। আন্দোলনের চাপে শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ কোম্পানি ট্রামের বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ১৯৬৭ সালে রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ে ব্রিটিশ কোম্পানিকে সরিয়ে ট্রামের জাতীয়করণ হয়।

দূষণ রোধে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে যখন পরিবেশবান্ধব যান চলাচলের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে, পুনরায় ফিরিয়ে আনা হচ্ছে ট্রাম পরিষেবা, তখন রাজ্যের তৃণমূল সরকার ঐতিহ্যবাহী ট্রাম পরিবহণ তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। কিছুদিন আগে এক গবেষণা সংস্থার বায়ুদূষণ সংক্রান্ত রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে, বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত শহর কলকাতা। দূষণহীন যান হিসাবে ট্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। ট্রাম শুধু পরিবেশবান্ধবই নয়, কম ভাড়ার কারণে নিম্নবিত্ত গরিব মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে যাতায়াতের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। আবার ট্রামে যাতায়াত অন্যান্য অনেক পরিবহণ ব্যবস্থার তুলনায় আরামদায়ক ও নিরাপদ।

ট্রাম পরিবহণের সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য কর্মচারীর জীবন। ট্রাম পরিবহণ ব্যবস্থাকে তুলে দিতে সিপিএম সরকারের মতো তৃণমূল সরকারও হাতিয়ার করেছে– ট্রামের শ্লথগতি, যানজটের সমস্যা ও অলাভজনক দিককে। কলকাতার নাগরিক মাত্রই জানেন যানজটের প্রকৃত কারণ ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিগত গাড়ি আর যত্রতত্র রাস্তায় অপরিকল্পিত খনন। কী ভাবে যানজট কমানো যায়, তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু একে অজুহাত করে ট্রাম তুলে দেওয়া কী উদ্দেশ্যে? দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দেওয়াই যেহেতু সরকারি গণপরিবহণ ব্যবস্থার প্রকৃত উদ্দেশ্য, তাই লাভ হচ্ছে না এ কথা তুলে কার স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে সরকার?

শহরের বেশ কয়েকটি জায়গায় ব্রিজের ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে বন্ধ করা হয়েছে ট্রাম চলাচল। অথচ ওই সব ব্রিজ দিয়ে দেদার যাতায়াত করে চলেছে বালি-পাথর বোঝাই ভারি লরি। এমনকি ট্রাম লাইনে পড়ে কনস্টেবলের মৃত্যুকেও ট্রাম বন্ধের অজুহাত করছে রাজ্য সরকার। ভাবখানা এমন যেন ট্রাম বন্ধ হলেই সমস্ত দুর্ঘটনা বন্ধ হবে। ট্রাম বন্ধ করা হয়েছে ফ্লাইওভার ও মেট্রো সম্প্রসারণের নামেও। ট্রাম পরিবহণ ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়ার যে প্রচেষ্টা সরকারি পক্ষ থেকে হয়ে চলেছে তার উদ্দেশ্য বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সরকারি গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে বৃহৎ পুঁজির হাতে এই ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়া, গণপরিবহণ ব্যবস্থায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেল চালু করাই সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য।

ট্রাম পরিষেবা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু হয় সিপিএম ফ্রন্ট সরকারের আমলেই। ১৯৯২ সালে তৎকালীন পরিবহণ মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তীর সময়ে রাজ্য পরিবহণ দপ্তর সিদ্ধান্ত নেয় ধাপে ধাপে ট্রাম পরিষেবা তুলে দিয়ে বাস পরিষেবা চালু করা হবে এবং ট্রাম কোম্পানির অতিরিক্ত জমি বিক্রি করা হবে প্রোমোটারদের। ট্রামের জমিতে তৈরি হবে বহুতল আবাসন। সরকারের যুক্তি ছিল ট্রাম চালিয়ে তাদের লোকসান হচ্ছে। ১৯৯২ সালের ৪ নভেম্বর ৪০টি বাস নিয়ে বাস পরিষেবা চালু করে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) এর তীব্র প্রতিবাদ করে সেদিন শহরের বিভিন্ন ডিপোয় বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়ে বলেছিল, বাস চালানো ট্রাম কোম্পানির কাজ নয়। ট্রাম পরিষেবাকে কী ভাবে আরও আকর্ষণীয় করা যায় সেই চেষ্টাই কোম্পানির করা উচিত।

একে একে বন্ধ করে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি রুটে ট্রাম চলাচল। লোকসানের কারণ দেখিয়ে বিড়লা তারামণ্ডল চত্বর থেকে ট্রাম পরিষেবা বন্ধ করা হয়। ১৯৯৪ সালে হাওড়া ব্রিজের স্বাস্থ্যের কথা বলে হাওড়া স্টেশন টার্মিনাস থেকে ট্রাম চলাচল বন্ধ হয়। ১৯৯৫ সালে হাইকোর্ট চত্বর থেকে ট্রাম চলাচল বন্ধ হয় স্ট্র্যান্ড রোডের পুনর্গঠনের কারণে। রাস্তার কাজ শেষ হলেও পুনরায় ট্রাম পরিষেবা চালু করা হয়নি। পরবর্তী সময় সুভাষ চক্রবর্তী যখন পরিবহণ মন্ত্রী তখন সরকার সিদ্ধান্ত নেয় টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর জমি বিক্রি করা হবে, কিন্তু জনমানসে এই নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে সরকার পিছু হঠতে বাধ্য হয়।

উড়ালপুল নির্মাণ কিংবা মেট্রো সম্প্রসারণের কাজ সম্পূর্ণ হলেও যে পুনরায় ট্রাম পরিষেবা চালু হবে না এ সত্য নাগরিকরা সহজেই ধরতে পারছেন সরকারের কার্যকলাপ থেকে। সাধারণ মানুষের আবেগের কথা ভেবে তৃণমূল সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা কখনও ট্রামের আধুনিকীকরণের কথা বললেও তা আসলে শুধুই কথার কথা। দীর্ঘদিন ধরেই ট্রাম পরিষেবায় নতুন কর্মী নিয়োগ বন্ধ। একসময় যেখানে ট্রাম চলত ৪১টি রুটে, এমনকি ২০১৬ সালেও যেখানে ট্রাম পরিষেবা চালু ছিল ২৫টি রুটে, এখন সেখানে ধর্মতলা-গড়িয়াহাট এবং বালিগঞ্জ-টালিগঞ্জ এই দুটি মাত্র রুটে ট্রাম পরিষেবা চালু আছে। তৃণমূল সরকার চুপিসারে বিক্রি করে দিচ্ছে ট্রাম কোম্পানির বিভিন্ন ডিপোর জমি। গ্যালিফ স্ট্রিট, কালীঘাট ও খিদিরপুর ডিপোর বেশ কিছু জমি তুলে দেওয়া হয়েছে গোয়েঙ্কা গোষ্ঠীর সংস্থা সিইএসসি-কে। টালিগঞ্জ ডিপোর জমি তুলে দেওয়া হয়েছে বেলানী গোষ্ঠীকে। সেখানে তৈরি হচ্ছে উচ্চবিত্তদের জন্য গগনচুম্বী বহুতল আবাসন, তৈরি হচ্ছে শপিং মল। যার সাথে শহরের সাধারণ নিম্নবিত্ত গরিব নাগরিকের স্বার্থের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। এ ছাড়াও তৃণমূল সরকার গড়িয়াহাট, বেলগাছিয়া, শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর জমি বিক্রিরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ভাবেই কার্যত জনস্বার্থকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে পরিকল্পিত ভাবে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে শহর কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ট্রাম পরিষেবাকে। এ কাজে সিপিএম সরকারের সঙ্গে তৃণমূল সরকারের কোনও পার্থক্য নেই। এই অবস্থায় ট্রাম ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে নাগরিক সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে।