আঠারোতম লোকসভা নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলছে। ক্ষমতাসীন বা বিরোধী সব রাজনৈতিক দলই প্রতিশ্রুতির ঝুলি নিয়ে জনতার দরবারে যাচ্ছে। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলির জন্যও এই প্রতিশ্রুতির কমতি কোনও দিনই হয়নি। সংসদীয় দলগুলি আদিবাসী, চিরাচরিত বনবাসী সহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে হাতে রাখার জন্য কিছু চমক নানা সময় দিয়েছে।
এখন আবার আদিবাসীদের সম্মানার্থে কেন্দ্রীয় সরকার পালনকরেছে ‘জনজাতীয় গৌরব দিবস’, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা যথাসময়ে পাওয়ার কথা বলে ঘোষিত হয়েছে ‘বিকাশ ভারত সংকল্প যাত্রা’, সংকটগ্রস্ত আদিবাসীদের উন্নতির জন্য জন-মন মিশন, বনজ সম্পদ বিক্রি করে আয়ের জন্য বিশেষ প্রকল্প ও আদিবাসী মহিলাদের জন্য সেলফ হেলপ গ্রুপ সহ নানা সুবিধার ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু গর্জন যত বেশি, বাস্তবে বর্ষণ ততই কম।
অরণ্যের অধিকার কর্পোরেটের হাতে
প্রথমেই আসা যাক অরণ্যের উপর আদিবাসী এবং চিরাচরিত বনবাসী নানা গোষ্ঠীর দরিদ্র মানুষের সুদীর্ঘ অধিকারের প্রশ্নে। তাঁদের বিকাশের সাথে এই অধিকার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অরণ্যের অধিকারকে পুরোপুরি একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিয়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। গত বছর ২৬ জুলাই লোকসভা ও রাজ্যসভায় মণিপুর নিয়ে টানা গণ্ডগোল বাধিয়ে রেখে কোনও আলোচনার সুযোগ না দিয়েই বিজেপি সরকার ‘বন (সংরক্ষণ) বিল-২০২৩’ পাশ করিয়ে নিয়েছিল। এমনিতেই বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করে টুরিজমের নামে বিস্তীর্ণ এলাকার পরিবেশ ধ্বংস করা, বনভূমি বা পাহাড়ের অভ্যন্তরে থাকা খনিজ উত্তোলনের জন্য বিজ্ঞানসম্মত নিয়মনীতি মেনে চলা, পরিবেশ আইন মানা প্রভৃতি কোনও কিছুর তোয়াক্কা পুঁজিমালিকরা করে না। এর ওপর বর্তমান আইনটি কর্পোরেট কোম্পানিকে যথেচ্ছ বন-পরিবেশ ধ্বংস করার অবাধ ছাড়পত্র দিয়েছে। এর সরাসরি কুফল বর্তাচ্ছে বনভূমি সংলগ্ন অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জীবনে।
বিজেপি সরকার এবং একচেটিয়া মালিকদের সুচতুর পরিকল্পনা বোঝা যায় এর পরবর্তী কয়েকটি ঘটনায়। এই বিল পাশ হওয়ার পনেরো দিনের মধ্যে ওড়িশার রায়গড়া জেলার সিজিমালি পাহাড়ে বেদান্ত গোষ্ঠী বনভূমির দখল নিতে যায়। রায়গড়া ও কালাহান্ডি জেলার কুত্রুমালি পাহাড়ে আদানি গোষ্ঠীও একইভাবে বনভূমির দখল নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবশ্য এখানে গ্রামবাসীরা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রতিবাদী আদিবাসী যুবকদের উপর পুলিশ অত্যাচার করে এবং তাদের বিরুদ্ধে নানা জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করে। এই দুটি প্রকল্প গড়ে তুলতে ১৮০টি গ্রামের প্রায় দুই লক্ষ আদিবাসী মানুষকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হতে হবে।
এর আগে অরণ্যের অধিকারের জন্য আদিবাসী, চিরাচরিত বনবাসী মানুষের দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছিল অরণ্যের অধিকার আইন-২০০৬। সেই আইনকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য বিজেপি সরকার অত্যন্ত চতুর এক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। প্রথমে ২০২২-এর জুন মাসে ‘বন সংরক্ষণ রুল’-এর সাহায্যে গ্রাম সভার অধিকারকে এড়িয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। অরণ্যের অধিকার আইন অর্জিত হওয়ার পিছনে আদিবাসী, চিরাচরিত বনবাসী জনগোষ্ঠীর সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক সংগ্রামের অবদান আছে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে চলেছে একের পর এক বিদ্রোহ। রাজমহল এলাকায় পাহাড়িয়া বিদ্রোহ, ভাগলপুরে তিলকা মাঝির নেতৃত্বে বিদ্রোহ, জঙ্গলমহলে চুয়াড় বিদ্রোহ, ভূমিজ বিদ্রোহ, ছোটনাগপুরে কোল বিদ্রোহ, সিংভূমে হো বিদ্রোহ, সাঁওতাল পরগণায় সিধু-কানুর নেতৃত্বে হুল-বিদ্রোহ, ছোটনাগপুর এলাকা জুড়ে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা উলগুলান প্রভৃতি ঐতিহাসিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অদিবাসীরা এবং জঙ্গল সংলগ্ন এলাকার অধিবাসীরা সামান্য কিছু হলেও অধিকার ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে আদায় করেছিল। স্বাধীনতার পর থেকেও নানা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁদের যেতে হয়েছে। অবশেষে ২০০৬-এ অরণ্যের অধিকার আইনে সামান্য হলেও কিছু অধিকার তাঁরা অর্জন করেছিলেন। বিজেপি সরকারের নয়া আইন তা আবার কেড়ে নিল।
কোনও সরকারই আদিবাসীদের জঙ্গলের ন্যায্য অধিকার দেয়নি
এ দেশের প্রায় ২০ কোটি মানুষ জীবনধারণের জন্য জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল। ঐতিহাসিকভাবে ইংরেজ শাসনের আগে জঙ্গল ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীগুলি পরম্পরাগতভাবে জঙ্গলের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করতেন। এর মধ্যে ১০ কোটির বেশি আদিবাসী ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল জঙ্গলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। জঙ্গলের উপর নির্ভরশীলতা তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অঙ্গ। এই সমস্ত জনগোষ্ঠী কোনওদিন জঙ্গলের ক্ষতি তো করেনি, বরং জঙ্গলকে তারা প্রাণ দিয়ে রক্ষা করে চলেছে। যদিও ব্রিটিশ থেকে শুরু করে স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস বা বিজেপি সরকার সকলেই জঙ্গল রক্ষার নামে এদের উচ্ছেদ কর়েছে। না হলে জঙ্গলকে শোষণ করে ব্যবসায়িক লাভ তোলা বৃহৎ পুঁজিমালিকদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাই স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসী মানুষ দেশের জনগণের সবচেয়ে গরিব ও পিছিয়ে পড়া অংশ।
১৯৫২ সালে কংগ্রেস সরকারের জঙ্গল নীতি প্রথম জঙ্গলের উপর জনসাধারণের অধিকার কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭২-এর ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট বন্যপ্রাণ রক্ষার দোহাই দিয়ে জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীগুলির পরম্পরাগত জীবন-জীবিকার জন্য জঙ্গলের উপর অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বহীন করে দেয়। এর পর একের পর এক আইন এনে রাজ্যে রাজ্যে ব্যাপক উচ্ছেদ অভিযান চলে। অনন্যোপায় পাহাড় জঙ্গলের অধিবাসী দরিদ্র মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে ২০০৩ সালে গঠিত প্রাক্তন বিচারপতি বিএন কৃপালের নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল ফরেস্ট কমিশন’-এর সুপারিশেই অবশেষে ‘অরণ্যের অধিকার আইন-২০০৬’ তৈরি হয়। এর ফলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্জিত হয়।
আইনে বলা হয়, ১৩ নভেম্বর ২০০৫ অবধি যারা জঙ্গলের জমিতে বসবাস করছেন বা জঙ্গলের জমি চাষাবাদ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন তাদের ওই জমির পাট্টা দেওয়া হবে। এত লড়াই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি প্রণয়নের পরেও কেন্দ্র কিংবা বিভিন্ন রাজ্যের সরকার তা কার্যকরী করেনি। এমনকি পিচমবঙ্গেরসিপিএমপরিচালিত‘বামফ্রন্ট’ সরকার এরপর পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল। ত্রিপুরাতে ছিল আরও কয়েক বছর। তারাও এই আইন প্রয়োগ করে বনবাসীদের জমির পাট্টা দেওয়ার ব্যবস্থা করেনি।
পাট্টা পাওয়াকে অসম্ভব করে তুলেছে বিজেপি সরকার
বিজেপি ২০১৪-তে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বসেই অরণ্যের অধিকার আইনের নতুন রুল এনে এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছে, জমির পাট্টা পেতে হলে তিন প্রজন্ম ধরে বসবাসের প্রমাণ দিতে হবে। তিন প্রজন্ম মানে ৭৫ বছর। এই নথি আদিবাসী, চিরাচরিত বনবাসী দরিদ্র মানুষ পাবেন কোথায়? অধিকাংশ পরিবারকে সরকারি নথি দেওয়াই হয়নি। শিক্ষা বঞ্চিত, আইনকানুন সম্পর্কে ধারাণাহীন এই মানুষগুলির পক্ষে এই নথি জোগাড় করা বাস্তবে অসম্ভব। আর একটি আক্রমণ সরকার এনেছে আদালতের মাধ্যমে। কেন্দ্রীয় সরকারের আবেদনক্রমে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ মিশ্রের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ যে নির্দেশ দেন তার ফলে ১৬টি রাজ্যের ১১ লক্ষ ২৭ হাজার ৪৪৬টি আদিবাসী ও বনবাসী পরিবার তাদের ভিটেমাটি হারাবে। (সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯-০২-২০১৯)
গড়ে উঠছে প্রতিরোধ
গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশ, ২০০০ সাল থেকে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই বৃক্ষহীন হয়েছে ভারতের ২৩ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর জমি (বর্তমান,১৪এপ্রিল’২৪)। আশার কথা, এই জনবিরোধী সরকারি নীতির বলে সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা, যারাই জঙ্গলের দখল নিতে যাচ্ছে– আদিবাসী, বনবাসী ও গরিব শোষিত মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। পরিবেশ সচেতন নাগরিক সমাজও এই সকল আন্দোলনকে সমর্থন করছেন, সর্বতোভাবে সাহায্য করছেন। গড়ে উঠেছে অল ইন্ডিয়া জন অধিকার সুরক্ষা কমিটি।
ইতিপূর্বে ওড়িশার সিমলিপালে উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। লাদাখে পাহাড় ও পরিবেশ বাঁচানোর দবিতে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চলছে। ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ জেলার বড়কাগাঁও, ছত্তিশগড, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, আসামে উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। পিচমবঙ্গেরবীরভূমেদেউচাপাঁচামিতেখোলামুখ কয়লা খনির প্রতিবাদে এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে ড্যাম তৈরি বা ইকোট্যুরিজম-এর নামে কিছু মানুষের আমোদ-ফূর্তির জন্য উচ্ছেদ করছে হাজার হাজার পরিবারকে। যারা এই উচ্ছেদের নায়ক, তারাই ত্রাতা সেজে এদের কাছে ভোট চাইতে আসছে।
অরণ্যের জনসাধারণের অধিকার রক্ষার আন্দোলন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার আন্দোলন পরস্পরের পরিপূরক। এই আন্দোলনের কণ্ঠকে লোকসভার অভ্যন্তরে ধ্বনিত করতে প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক শক্তির। যে সমস্ত রাজনৈতিক দল পুঁজিমালিকদের সেবাদাস হিসাবে তাদের রাজনৈতিক ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করে, তারাই এই উচ্ছেদের হোতা। মানুষের অধিকারকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র গণআন্দোলন ও বিপ্লবী বামপন্থার শক্তি। যে শক্তিটি হল এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)। এই দল নির্বাচনী প্রচারের মধ্যেও বনাঞ্চলের মানুষের সমস্যা তুলে ধরে পাশে থাকার় শুধু প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না, প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলন গড়ে তুলছে।