পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী দল হিসাবে কংগ্রেস, বিজেপি এবং আঞ্চলিক পুঁজির প্রতিনিধিত্বকারী ডিএমকে, অকালি, আরজেডি, বহুজন সমাজ পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস সহ ডজন ডজন আঞ্চলিক দল কর্পোরেট হাউসের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দল চালায় এবং নির্বাচনে লড়ে। এরা মালিক শ্রেণিরই স্বার্থরক্ষাকারী দল। কিন্তু সিপিএমকে কর্পোরেট হাউস টাকা দেবে কেন? নিশ্চয় পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে আপসহীন বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তুলে পুঁজিবাদের কবর খোঁড়ার জন্য তারা দেয়নি। এই দৌড়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসও সিপিএমের অনেকটা পিছনে। এবার কর্পোরেট হাউস সিপিএমকে দিয়েছে ১৯.৬ কোটি টাকা, তৃণমূল পেয়েছে ৮ কোটি টাকা (সূত্রঃ বিজনেস টুডে-১০ জুন, ২০২১)। সিপিএম সত্যিই বামপন্থার চর্চা করলে কর্পোরেট হাউস তাদের নির্বাচনী ভেট দিত কি? তাই বামপন্থার ঝাণ্ডা ফেলে সুবিধামতো কখনও কংগ্রেসকে সেকুলার, কখনও সাম্প্রদায়িক আব্বাস সিদ্দিকির দলকে সেকুলার তকমা দিতে তাদের কোনও অসুবিধা হয় না। কর্পোরেট হাউসের কাছ থেকে অর্থ নিতে গদি ফিরে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর সিপিএমের নৈতিক বিরোধ দেখা দেয়নি।
দেশের মধ্যে বড় বামপন্থী দল বলে পরিচিত সিপিএম। তথাকথিত নিরপেক্ষ প্রচারমাধ্যম সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের পরাজয়কে বামপন্থার পরাজয় হিসাবেই তুলে ধরছে। কিন্তু সিপিএমের জয়-পরাজয়ের সাথে বামপন্থার সম্পর্কটা কী?
বামপন্থী রাজনীতি মানে অত্যাচারিত মানুষের হয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠার আপসহীন লড়াই। বামপন্থী রাজনীতি সমাজের শোষিত শ্রেণির মানুষের স্বার্থে আপসহীন লড়াইয়ের রাজনীতি। বামপন্থী বলে পরিচিত দলগুলোর এই রাজনীতির চর্চাই একসময় জওহরলাল নেহরুর চোখে বাংলাকে দুঃস্বপ্নের নগরীতে পরিণত করেছিল। এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে টানা তিন মাস লড়াই, ১৯৫৪ এর শিক্ষক আন্দোলন, ১৯৫৬ এর বাংলা-বিহার সংযুক্তি বিরোধী আন্দোলন, ১৯৫৯ ও ১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলন সহ ছাত্র-যুব-মহিলা-শ্রমিক-কৃষকদের বাঁচার লড়াই– সেদিন দেশের ছাত্র-যুব সমাজকে বিনা প্রতিবাদে অন্যায়কে না মানার, মাথা উঁচু করে চলার পথ দেখিয়েছিল। এই পথ ধরে এল ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার। কিন্তু সিপিএম সরকারে বসে নিজেরা আন্দোলনের রাস্তা পরিত্যাগ করল শুধু নয়, দক্ষিণপন্থীদের মতোই পুলিশকে দিয়ে লাঠি-গুলি চালিয়ে আন্দোলন ভেঙে দিতে শুরু করল, গুণ্ডা দিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের খুনের রাজনীতি শুরু করল। সে দিন থেকেই বামপন্থার পথ থেকে তারা সরে গিয়ে পুঁজিপতিদের কৃপাপ্রার্থী হতে শুরু করেছে। তাই ১৯৭৭ সাল থেকে টানা ৩৪ বছরের শাসনের শেষের দিকে সিঙ্গুরে বহুফসলি জমিতে টাটার গাড়ি কারখানার বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের প্রতিবাদ যখন তুঙ্গে, তখন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন– টাটার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে দেব না। বাস্তবে করেও দেখিয়েছে সিপিএম। বিশ্বের কোনও দেশের গণআন্দোলন ভাঙতে এর আগে যা কেউ দেখেনি। বহুজাতিক সালেম গোষ্ঠীর সেজ বিরোধী গণআন্দোলন দমন করতে নন্দীগ্রামে দলের আশ্রিত কুখ্যাত গুণ্ডাদের পুলিশের পোশাক পরিয়ে গণহত্যা ও গণধর্ষণের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। এগুলো কি বামপন্থা? এর দ্বারা কি বামপন্থাকে কালিমালিপ্ত করা হয়নি?
শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির অন্য দলগুলির সাথে সিপিএমের নীতিগত কোনও ফারাক আছে কি? তাই সিপিএম হারলে বামপন্থার পরাজয় হয় না। বরং তাতে প্রকৃত বামপন্থী আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি হওয়ার রাস্তা আরও পরিষ্কার হয়।
দেবব্রত বিশ্বাস, বর্ধমান