ভারতের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের প্রায় দু’ভাগই চরম দরিদ্র। স্বয়ং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন এই তথ্য। ভাগ্যিস! অন্য কেউ বললে সঙ্গে সঙ্গে হয়তো দেশদ্রোহিতার দায়ে পড়তে হত।
লকডাউন ঘোষণার দু’দিন পর ২৬ মার্চ ১.৭ লক্ষ কোটি টাকার ত্রাণ-প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। বলেছেন, আগামী তিন মাস ৮০ কোটি গরিব মানুষকে সরাসরি চাল গম ও রান্নার গ্যাস দেওয়া হবে বিনামূল্যে। তা হলে স্বয়ং অর্থমন্ত্রীকেও স্বীকার করতে হল যে, দেশের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ– ৮০ কোটি মানুষ গরিব! বিপর্যয় তাহলে এভাবেই ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’-এ বিকশিত উদ্ভাসিত ভারতের উজ্জ্বল আবরণ এক টানে খুলে দেখিয়ে দিয়ে গেল ভেতরের গভীর ক্ষতটাকে! গরিবি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারিতে জর্জরিত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষের প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত তখন উন্নয়নের প্রচারের ঢাক পিটিয়ে উজ্জ্বল হোর্ডিংয়ে আর উচ্চকিত স্লোগানে চরম নিষ্ঠুরের মতো তা চাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন সরকারি নেতা-মন্ত্রীরা। করোনা বিপর্যয় যেন ঝড় বাদলের অন্ধকারে বিদ্যুৎচমকের মতো দেখিয়ে দিয়ে গেল সত্যটাকে।
সাম্প্রতিক এই মহাবিপর্যয়ে দেশের বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষের জন্য মাত্র ১.৭ লক্ষ কোটি টাকার ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ টাকাও কোন খাত থেকে আসবে তার হদিস নেই। তাছাড়া এই প্যাকেজে যেসব বরাদ্দ ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী, দেখা যাচ্ছে তার বেশিরভাগটাই আসলে পুরোনো বরাদ্দ। যেমন এনরেগায় মজুরি বৃদ্ধির কথা বলেছেন তিনি। এ সিদ্ধান্ত করোনা বিপর্যয়ের বহু আগেকার। প্রধানমন্ত্রী কিষান যোজনায় ৮ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ ঘোষণাও পুরনো। অর্থাৎ নানা খাতে আগেই যেটুকু ব্যয়ের সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল, তার সঙ্গে সামান্য কিছু যোগ করে বিপর্যয় মোকাবিলা প্যাকেজ নাম দিয়ে ব্যাপক ঢাক ঢোল পেটালো বিজেপি সরকার। শুধু তাই নয়, প্যাকেজে প্রতিশ্রুত টাকার পরিমাণও মোট অভাবী জনগণের প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। সংক্রমণ এড়াতে দীর্ঘদিন ধরে লকডাউন প্রয়োজন সন্দেহ নেই, কিন্তু এই ঘরবন্দি পরিস্থিতি দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষজনের জীবনে কত বড় আর্থিক বিপর্যয় নিয়ে এসেছে, সে বিষয়ে সরকারের যে বিশেষ মাথা-ব্যথা নেই জিডিপির মাত্র ১.১৫ শতাংশ ত্রাণবরাদ্দ থেকেও তা পরিষ্কার।
পাশাপাশি, বিপর্যয় মোকাবিলার নামে তড়িঘড়ি ‘পিএম কেয়ারস’ তহবিল তৈরি নিয়েও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে। একটি জাতীয় ত্রাণ তহবিল এবং সেই তহবিলে আটত্রিশশো কোটি চুয়াল্লিশ লক্ষ টাকা থাকা সত্তে্বও প্রধানমন্ত্রী ২৮ মার্চ সন্ধ্যাবেলা টুইট করে পিএম কেয়ারস তহবিল গড়ার কথা ঘোষণা করলেন। এই তহবিলের চেয়ারম্যান স্বয়ং তিনি এবং সদস্যরা হলেন প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী।প্রশ্ন উঠেছে, কবে কখন ও কোন আইনের আওতায় এই তহবিল খোলার সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্রীয় সরকার? এর টাকা কী উপায়ে খরচ হবে, কীভাবেই বা তার হিসাব পরীক্ষা করা হবে, সে সংক্রান্ত নিয়মকানুন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী চুপ কেন?
এর আগেও এই ধরনের তহবিল নিয়ে বড়োসড়ো প্রশ্নের মুখে পড়েছে বিজেপি সরকার। ২০১৯-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা বিস্ফোরণে ৪০ জন সেনা নিহত হওয়ার পর অসংখ্য মানুষের অনুদানে ‘ভারত কে বীর’ তহবিলে জমা হয়েছিল বিপুল অর্থ। সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে গেছে, ঘটনার এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও নিহত সেনা কর্মীদের পরিবারগুলির হাতে তহবিলের অর্থসাহায্য সম্পূর্ণ পৌঁছায়নি। আড়াইশো কোটি টাকা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
এই পুলওয়ামা কাণ্ড ও পরবর্তী বালাকোট বিমানহানাকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলেছিল বিজেপি। এতে ভর করেই দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। অথচ এই ঘটনায় নিহত সেনাদের নামে তৈরি তহবিলের বিপুল টাকা খরচ করা হল না। সরকারের এ কোন নৈতিকতা? এরপরেও অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে আবার একটা ভুঁইফোড় তহবিল গজিয়ে তোলা কেন? দেখা যাচ্ছে, যেসব শিল্পপতি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জাতীয় ত্রাণ তহবিলে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীন থাকলেন, তাঁরাই আবার দলে দলে টাকার থলি হাতে ‘পিএম কেয়ারস’-এ সাহায্য দিতে এগিয়ে আসছেন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে তহবিলের উদ্দেশ্য নিয়ে।
দেশে আজ করোনা সংক্রমণ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিকাঠামোর চূড়ান্ত অভাব। যে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবন বাজি রেখে এই রোগ আটকাতে রুখে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের নিরাপত্তা উপকরণ পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণে মিলছে না। কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘরবন্দি গরিব মানুষের পেটে ভয়ঙ্কর টান পড়ছে। বাড়ি ফিরতে মরিয়া পরিযায়ী শ্রমিকরা অনেকে পথেই প্রাণ হারাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারকে উত্তর দিতে হবে, গালভরা প্যাকেজ ঘোষণা ও অপ্রয়োজনীয় তহবিল তৈরিতে তাদের যে তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে কেন তার একাংশও নজরে পড়ছে না? যে মানুষগুলির ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসা, এই চরম দুঃসময়ে তাদের প্রতি কোন দায়বদ্ধতার পরিচয় দিচ্ছেন তাঁরা?
( সূত্র : ইকনমিক টাইমস ২৭ মার্চ, আনন্দবাজার পত্রিকা ২৭ মার্চ, ন্যাশনাল হেরাল্ড ১৪ ফেব্রুয়ারি ও দ্য ওয়্যার ৩১ মার্চ ২০২০)