Breaking News

করোনায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু নগ্ন পুঁজিবাদী মুনাফা লালসারই পরিণাম

করোনা অতিমারি আজ সারা বিশ্বকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। কোটি কোটি মানুষ সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে আজ গৃহবন্দি। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি প্রভৃতি দেশে মৃত্যুমিছিল আজও চলছে। এই ভাইরাসকে প্রতিহত করার মতো কোনও ওষুধ বা ভ্যাকসিন আজও চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারেনি। প্রশ্ন হল এই অতিমারির আক্রমণ কি অপ্রত্যাশিত ছিল?

বিশ্বখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় ২০০৮ সালে একটি মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো হয়েছে, ১৯৬৬ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ৩৫৫টি নতুন রোগ পৃথিবীতে এসেছে। এর ৬০ শতাংশের উৎস বিভিন্ন জাতের বন্য প্রাণী। প্রবন্ধটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বন্য জীবজন্তুর থেকে অতি সংক্রামক জীবাণুর কারণে ১৭৫ টি রোগ যা গত শতাব্দীর শেষ দুই দশকে এসেছিল, তার ৭৫ শতাংশই আরও ভয়াবহ আকারে আগামী দিনে ফিরে আসতে পারে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন, এক ধরনের বানর থেকে এসেছে এইচআইভি, বাদুড় আর বানর থেকে এসেছে ইবোলা, শুয়োর থেকে নিপা, বাদুড় থেকে মারবার্গ, উট থেকে মার্স, বাদুড় থেকে সার্স, বানর থেকে জিকা, ইঁদুর থেকে প্লেগ ও লাসা জ্বর এবং এই ধরনের আরও বেশ কিছু রোগ। নতুন রোগের আবির্ভাবের হার আগের শতকগুলির তুলনায় বেশি।

এর কারণ কী? রাষ্ট্রসংঘের ইন্টার গভর্নমেন্টাল সায়েন্স পলিসি প্ল্যাটফর্ম অফ বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস-এর মতে, গত দুই দশকে ব্যবসায়িক স্বার্থে নজিরবিহীন ভাবে বনাঞ্চল ও জলাভূমি ধ্বংস হয়েছে, ব্যাপক হারে বন্যপ্রাণী হত্যা ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কারবার হয়েছে। তাই উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের প্রায় দশ লক্ষ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ১২ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশি বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। ঘন বনভূমি অঞ্চল ধ্বংস এবং বহু প্রজাতি বিলোপের কারণে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যেকার দূরত্ব ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জীবাণু ও ভাইরাস, যেগুলো জঙ্গলের পরিবেশে উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর দেহকে পোষক হিসাবে ব্যবহার করে বেঁচেছিল, তারা এখন মানুষকেই পোষক হিসাবে বেছে নিচ্ছে এবং মারাত্মক জীবাণু ঘটিত (জুনোটিক) রোগের সৃষ্টি করছে। মিউটেশনের ফলে যে জিনগত পরিবর্তন হয় তার ফলে তাদের সংক্রমণ ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। একটি প্রাণীর শরীরে কোনও রোগ না সৃষ্টি করেই যে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াটি থাকতে পারে তা অন্য একটি প্রাণীর শরীরে এসে বিপজ্জনক চরিত্র ধারণ করতে পারে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘ক্রস ওভার অফ ডিজিজেস’ বা ‘ক্রস স্পিসিস অফ ভাইরাস ট্রান্সমিশন’।

এইভাবে যত বেশি অবিবেচকের মতো এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপন্ন করা হবে ততই জীবজন্তু ও উদ্ভিদ দেহে যে সমস্ত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া আপাত অর্থে কোনও ক্ষতি করে না, সেগুলি মানুষের দেহে সংক্রামিত হয়ে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলবে এবং মানবসভ্যতার কাছে বিভীষিকা হয়ে উঠবে। এছাড়াও, ব্যবসায়িক কারণে যে সমস্ত জীবজন্তুর মাংস বা চামড়া বিক্রি বা রপ্তানি করা হয় বা তাদের চোরাচালান বা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাদের দেহে থাকা জীবাণুগুলি ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়ে যে সমস্ত মানুষ এদের সংস্পর্শে আসে তাদের শরীরে এই জীবাণুগুলি সংক্রামিত হয় এবং বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে।

আমাদের স্বাস্থ্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং চারপাশে উপস্থিত অসংখ্য আণুবীক্ষণিক জীবাণুর উপর নির্ভর কবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে যেটা সবচেয়ে ভয়ংকর তা হল দেশে দেশে ধনকুবের গোষ্ঠী তার অর্থলিপ্সাপূরণের স্বার্থে তথাকথিত নগরায়ন ও উন্নয়নের নামে বেপরোয়া হয়ে লাগামহীনভাবে বনভূমি ধ্বংস করে চলেছে। শিল্প কলকারখানাগুলি যে বিষাক্ত গ্যাস উদগীরণ করে চলেছে বা বর্জ্য পদার্থ তৈরি করছে তা ভীষণভাবে পরিবেশকে দূষিত করছে। অথচ তা বন্ধ করা হচ্ছে না, কারণ তাতে শিল্পপতিদের মুনাফার অঙ্ক কমে যায়। খনিজ উত্তোলনের ক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষার নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয় না। যত্র তত্র বর্জ্য জমা করা, জলাশয়গুলিকে দূষিত করা, খনির দূষিত জল, এমনকি খনি থেকে উদ্ভূত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ খনি শ্রমিকদের এবং সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারীদের কাছে এক বিপজ্জনক স্বাস্থ্য সংকটের সৃষ্টি করে চলেছে। আরও বিপজ্জনক হল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সামরিকীকরণের কারণে এবং স্থানীয় ও আংশিক যুদ্ধ বাধানো এবং দখলদারি কায়েমের জন্য ব্যাপকভাবে পরমাণু অস্ত্র এবং জীবাণু অস্ত্র তৈরি করে চলেছে।

এগুলি ছাড়াও গবেষণাগারগুলিতে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু তৈরির চক্রান্ত চলছে, ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদনের চক্রান্ত চলছে যা বাস্তুতন্তে্রর ভারসাম্যকে নষ্ট করে। ভোগবাদী এই সমাজ ব্যবস্থায় ব্যাপক হারে গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে, বনাঞ্চলের জমি দখল ও খনিজ সম্পদ উত্তোলনের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে দাবানলের সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে হিমবাহ ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, পানীয় জলের সংকট, নদীদূষণ, ভূমিকম্প, খরা, সাইক্লোন, বন্যা, সুনামির মতো ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বিপর্যয় নিত্যনতুন ভাবে দেখা দিচ্ছে। এই সমস্ত কিছুই হতদরিদ্র মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে চলেছে, প্রাণহানি ঘটাচ্ছে এবং সম্পত্তি নষ্ট করছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিতে পোকামাকড়ের আক্রমণ বাড়ছে, অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে কখনও খরা কখনও বন্যা হচ্ছে , যা কৃষিজ পণ্য উৎপাদনকে নিম্নগামী করছে। এর ফলে দরিদ্র প্রান্তিক কৃষক ও খেতমজুরদের জীবন ও জীবিকার উপর সর্বনাশা প্রভাব পড়ছে।

প্রকৃতির উপর আমরা যে অত্যাচার করছি, আপাতভাবে মনে হতে পারে যে প্রকৃতি তা নীরবে সহ্য করছে। কিন্তু তা নয়। প্রকৃতিও তার সমুচিত জবাব আমাদের দিচ্ছে। যেমন, জলবায়ু সংকট। সার্স, মার্স, এইচআইভি ইত্যাদির মতো একটার পর একটা মহামারির আক্রমণ। এই দীর্ঘ তালিকায়কোভিড-১৯ সংক্রামক ব্যাধি নবতম সংযোজন। নোভেল করোনা ভাইরাস গত চার মাসের মধ্যে ব্যাপকভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ এর শুরু হয়েছিল চীনের উহান শহরের একটি নির্দিষ্ট স্থানের কিছু মানুষের মধ্যে। বিশ্বায়নের কারণে মূলত আকাশপথে পরিভ্রমণের মাধ্যমে আজ তা সংক্রমিত হয়েছে বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে। উহান শহরটি চীনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব। এখানে চীন সহ বিশ্বের অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশের বহু শিল্প কলকারখানা আছে। ফলে আকাশপথ ও জলপথে অন্যান্য দেশের সঙ্গে এই শহরের যোগাযোগ খুবই সুদৃঢ় । সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এবং মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ২০ জানুয়ারি থেকে এই শহরকে অবরুদ্ধ করা হয় অর্থাৎ দেশের অন্যান্য সমস্ত অংশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় কিন্তু এই শহরের সঙ্গে অন্যান্য দেশের আকাশপথ ও জলপথে যোগাযোগ বজায় থাকে বাণিজ্যিক স্বার্থে, মুনাফার স্বার্থে। আর মুনাফার হাত ধরেই এই সংক্রামক ব্যাধি সংক্রমিত হয়েছে বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে। শুরু থেকেই চীন যদি এই রোগের সংক্রমণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করত তাহলে সারা বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ত না। আমরা সকলেই জানি চীন দীর্ঘদিন আগেই সমাজতন্তে্রর পথ পরিত্যাগ করে পুঁজিবাদি অর্থনীতি কায়েম করেছে। শুধু তাই নয় চীন এখন বিশ্বের অন্যতম সাম্রাজ্যবাদী শক্তিধর রাষ্ট্র এবং আমেরিকার সমকক্ষ। সেও চায়নি লকডাউনের কারণে তার অর্থনীতিতে মন্দা আসুক– তাতে কিছু মানুষ যদি মরে মরুক। বিশ্বের অন্যান্য পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশের রাষ্ট্রনায়কেরাও এই রোগকে হাল্কা ভাবে নিয়েছে। রোগ সংক্রমিত হয়ে যাওয়ার অনেক পরে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় তারা লকডাউন ঘোষণা করেছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি আজ মন্দায় ধুঁকছে। তাই কোনও দেশই লকডাউন চালু করতে চায়নি। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় প্রকৃতির থেকে পাওয়া কাঁচামালের মতোই মানুষও তার কাছে আর একটি কাঁচামাল মাত্র। যার কাছ থেকে সে শ্রম যেমন নিংড়ে নিতে পারে, তেমনি যথেচ্ছভাবে শোষণও করতে পাবে। পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থায় যে যে ক্ষেত্র বেশি মুনাফা দেয় সেই ক্ষেত্রগুলিতে বেশি দৃষ্টি পড়ে, অবহেলিত হয় পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রগুলি। কোভিড -১৯ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্য পরিষেবার করুণ অবস্থা। স্বাস্থ্য কাঠামো দুর্বল, নেই উপযুক্ত সংখ্যার হাসপাতাল, নেই ওষুধের যোগান কিংবা উন্নত মানের যন্ত্রপাতি। অথচ অতি ক্ষুদ্র সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা আজ বিভিন্ন দেশে তার উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রকৃতিতে কোনও কিছুই এমনি এমনি ঘটে না, প্রতিটি ঘটনার পেছনে কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে। প্রত্যেকটি ঘটনার দ্বারা অন্য ঘটনাগুলি প্রভাবিত হয। প্রকৃতি সর্বদা দ্বন্দে্বর মধ্যে অবস্থান করে এবং দ্বান্দ্বিকভাবে কাজ কবে। সমস্ত জীবজন্তুর মতো মানুষও তার অবস্থান ও কাজকর্মের দ্বারা এই প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করছে এবং দ্বান্দ্বিকভাবে এর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। যেখানে জীবজন্তুরা পরিবেশকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে প্রভাবিত করে, সেখানে মানুষ পরিকল্পনা মাফিক নিজের কাজের দ্বারা পরিবেশকে প্রভাবিত করে। কিন্তু চাইলেও মানুষ পুরোপুরি প্রকৃতিকে নিজের ইচ্ছেমতো চালিত করতে পারে না। মহান এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, যেমন করে একজন রাজা বা সম্রাট দেশকে শাসন করে, তেমন করে মানুষ প্রকৃতিকে শাসন করতে পারে না। মানুষ প্রকৃতির নিয়মাবলি সৃষ্টি করতে পারে না, বিজ্ঞানের সাহায্যে সে কেবলমাত্র এই নিয়মগুলিকে আবিষ্কার করতে পারে। একটি ক্ষতিকর প্রাকৃতিক নিয়মকে সে কেবলমাত্র সংযত করতে পারে, অন্য প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে এমনভাবে ব্যবহার করতে পারে যাতে তার উপকার হয়। এখনও আমরা প্রকৃতির গঠন ও ধরনের অন্তর্নিহিত নিয়মগুলিকে জানার চেষ্টা করে যাচ্ছি। প্রকৃতির মধ্যে বিভিন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়ার তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব কী হতে পারে এবং প্রকৃতির কার্যধারায় তা কীভাবে প্রভাবফেলছে– প্রতিদিনই আমরা এই নিয়মগুলিকে আরও সুন্দরভাবে বোঝারচেষ্টা করছি। তাই মহান মার্কস বলেছিলেন, ইতিহাস নিজেই প্রকৃতির ইতিহাসের একটি বাস্তব অংশ, প্রকৃতি থেকে মানুষ হয়ে ওঠার ইতিহাস।

মহান মার্কসের বিপ্লবী সহযোদ্ধা মহান এঙ্গেলস আজ থেকে ১৩৭ বছর আগে সতর্কবাণী দিয়েছিলেন, ‘‘প্রকৃতির উপরে মানুষের এই জয়লাভে আমরা যেন খুব বেশি আত্মপ্রসাদ লাভ না করি। কারণ এই রকম প্রতিটি জয়লাভের জন্য প্রকৃতিও আমাদের উপর প্রতিশোধ নেয়। এ কথা সত্য যে, প্রত্যেকটি জয়ের ফলাফল প্রথমে আমাদের ইপ্সিত আকাঙ্খা অনুযায়ী ঘটে, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্ষেত্রে এর ফলাফল সম্পূর্ণ পৃথক হয় এবং তা অপ্রত্যাশিত। প্রায়শই তা প্রথম ফলাফলকে ব্যর্থ করে দেয়। মেসোপটেমিয়া, গ্রিস, এশিয়া মাইনর এবং অন্যান্য জায়গায় একদিন মানুষ কৃষি উপযোগী জমি পাবার জন্য বনভূমিকে নির্মূল করে দিয়েছিল। তারা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি যে আজ এই দেশগুলির বিধ্বস্ত অবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে যাচ্ছিল। কারণ বনভূমি নির্মূল করার সঙ্গে সঙ্গে তা জলীয় বাষ্প সংগ্রহ ও ধারণ করার কেন্দ্রগুলিকে নিঃশেষ করে দেয়। আল্পসের দক্ষিণ ঢালের পাইন অরণ্যগুলিকে ইতালীয়রা যখন ধ্বংস করে ফেলল তখন তাদের এতটুকুও ধারণা হয়নি যে এর ফলে তারা পশুপালনের মূলেই কুঠারাঘাত করছে। এর ফলে তারা টেরই পেল না যে, বছরের বেশিরভাগ সময়ের জন্য পার্বত্য প্রস্রবণের জল পাওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়েগেল এবং ফলস্বরূপ বর্ষাকালে সমতলভূমি আরও ভয়ঙ্কর বন্যায় ভেসে যাবে। প্রতিটি পদক্ষেপে এইভাবে আমাদের স্মরণ করতে হবে যে, বিজেতা যেমন বিজিত জাতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে, আমরা কোনও অর্থেই সেভাবে প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করতে পারি না। বরং রক্ত, মাংস আর মস্তিষ্ক নিয়ে আমরা প্রকৃতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, প্রকৃতির মধ্যেই আমাদের অস্তিত্ব। প্রকৃতির উপর আমাদের যা কিছু প্রভুত্ব তার কারণ এই যে আমরা প্রকৃতির নিয়মগুলোকে আয়ত্ত করতে এবং নির্ভুলভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছি। …যে সমস্ত ব্যক্তি পুঁজিপতি উৎপাদন এবং বিনিময় ব্যবস্থার উপর আধিপত্য করে, তারা তাদের কার্যাবলির শুধুমাত্র প্রত্যক্ষতম উপযোগী ফলাফল নিয়ে ভাবতে সক্ষম। বস্তুত, সেই উপযোগী ফল বলতে উৎপাদিত ও বিনিময়কৃত দ্রব্যটির উপযোগিতার প্রশ্ন যা আসে তা পর্যন্ত এখন একেবারে পিছনে পড়ে যায়, এবং একমাত্র প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিক্রয়জনিত মুনাফা” (প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা)। তাঁর এই বক্তব্য কতটা সত্য তা আজ প্রমাণিত।

ফলে শেষ বিচারে লোলুপ বর্বর মুনাফা-প্রবৃত্তিই এই ভয়ঙ্কর ভাইরাসকে উন্মুক্ত করেছে। মৃত্যু-দামামা বাজিয়ে মানব সভ্যতাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শোষণ কত নির্মম, নৃশংস, অমানবিক, প্রতিক্রিয়াশীল, দুর্নীতিগ্রস্ত কোভিড-১৯ মহামারি তা আরও একবার প্রমাণ করল। এর নীতিই হল যেকোনও উপায়ে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা, শুধুমাত্র মেহনতি মানুষকে নৃশংসভাবে শোষণ করে নয়, সর্বতোভাবে প্রকৃতিকেও শোষণ করে। ফলে এই ধারাবাহিক মহামারির প্রকোপ এবং তার কারণে স্বাস্থ্যহানি, প্রাণহানির জন্য পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাকেই আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।