কমরেড সলিল সেনের জীবনাবসান

এস ইউ সি আই (সি) কলকাতা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড সলিল সেন ২০ মে সকালে আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

কমরেড সলিল সেনের বাড়ি ছিল কলকাতার নিউ আলিপুর কলেজের খুব কাছে। ১৯৭০-‘৭১ সাল নাগাদ সেখানে এআইডিএসও ছাত্রদের নানা দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলছিল। কয়েকটি ঘটনাক্রমে এই সংগঠনের আন্দোলনকারী কর্মীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। সেই সূত্রেই দলের বেহালা লোকাল কমিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অল্প কিছুদিন কাজ করেন তিনি। সেই সময়ে পার্টির কলকাতা জেলা সম্পাদক ছিলেন কমরেড আশুতোষ ব্যানার্জী। তাঁর সংস্পর্শে এসে কমরেড সলিল সেন দলের সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে জীবন কাটাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদিনের মধ্যেই দলের নির্দেশে পার্টির প্রেসে কাজ শুরু করেন তিনি। সেই সময় ছাপার কাজ হত লেটার প্রেসে, অক্ষর সাজিয়ে। পার্টির মুখপত্র ও অন্যান্য পত্রপত্রিকার মেক-আপ সহ বিভিন্ন কাজ দ্রুত শিখে নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে করতে প্রেসের সমস্ত কাজে দ্রুত দক্ষতা অর্জন করেন কমরেড সলিল সেন।

সময়ের সঙ্গে প্রেসে কাজের পদ্ধতিতে একাধিক বার ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এই কমরেড প্রত্যেক বারই নতুন পদ্ধতিতে কাজের ক্ষেত্রে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। বর্তমানে প্রেসে কম্পিউটারভিত্তিক ছাপাছাপির যে কাজ হয়, তার সূচনা তাঁর হাত ধরেই। বস্তুত কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই ছাপাছাপি বিষয়ক কম্পিউটারের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় তিনি আয়ত্ত করেছিলেন।

গণদাবী প্রেসই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। পার্টির কাজ শুরু করার সময় থেকে, অসুস্থ হয়ে ঘরবন্দি হওয়ার আগে পর্যন্ত বছরের পর বছর প্রেসের চার দেওয়ালের মধ্যে নীরবে নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। দলের প্রচার এবং কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার প্রসারে মুখপত্র ও প্রেসের অপরিসীম গুরুত্বকে হৃদয়ঙ্গম করে তিনি এই আপাত নীরস একঘেয়ে কাজটিকেই বিপ্লবী সৃষ্টিশীলতায় গ্রহণ করেছিলেন। চিকিৎসকদের বারণ সত্ত্বেও তাঁর প্রেসে আসা ঠেকিয়ে রাখা ছিল অত্যন্ত কঠিন। নিজের কাজে বিপুল দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কখনও আত্মপ্রচার করেননি কমরেড সলিল সেন। দলের প্রয়োজনে বা কর্মী, শুভানুধ্যায়ী ও পরিচিত কারও অনুরোধে সব সময় বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের অকুণ্ঠ হাত।

পার্টি-অর্পিত দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠার নজির রেখে গেছেন কমরেড সলিল সেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন পার্টির প্রকাশনা বিভাগের অন্যতম স্তম্ভ। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বেরনো বন্ধ হয়ে গেলে টালিগঞ্জে যে বাড়িটিতে অন্য পার্টিকর্মীদের সঙ্গে তিনি থাকতেন, সেখানেই একটি কম্পিউটারের ব্যবস্থা করে কাজ শুরু করেন।

সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে সারা জীবনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দলের রুচি-সংস্কৃতি-নৈতিকতার উঁচু মান অর্জন করেছিলেন কমরেড সলিল সেন। বাইরের আপাত কঠোরতার আড়ালে তাঁর স্নেহকোমল হৃদয়টি ছিল অত্যন্ত উদার। কারও ব্যবহারে আঘাত পেলে কখনও প্রত্যাঘাত করেননি। জুনিয়র কমরেডদের প্রতি ছিল অপার স্নেহ। প্রেসে কাজ নিয়ে গেলে তাদের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কি না খোঁজ নিতেন, না হয়ে থাকলে জোর করে খাইয়ে দিতেন। কেউ অসুস্থ হলে নিয়মিত খোঁজ রাখতেন। পার্টির পুরনো কর্মী-সমর্থক, বর্তমানে যাঁরা দৈনন্দিন কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত নেই, কমরেড সলিল সেন নিয়মিত তাঁদের খোঁজখবর নিতেন। নতুন যে কর্মীরা প্রেসের কাজে যুক্ত হচ্ছেন, রাজনৈতিক চেতনা ও দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করে উপযুক্ত ভাবে তাঁদের গড়ে তোলার কাজটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে করে গেছেন তিনি।

২০ মে সকাল ছ’টা নাগাদ বারবার ডেকেও অর্ধচেতন কমরেড সলিল সেনের সাড়া না পাওয়ায় কমরেডরা অ্যাম্বুলেন্সে দ্রুত তাঁকে ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে নিয়ে যান। সেখানে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। দলের কেন্দ্রীয় দফতরে মরদেহ আনা হলে দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসু, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির উপস্থিত সদস্যরা সহ রাজ্য ও জেলা নেতৃবৃন্দ পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে কেওড়াতলা ¬শানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

কমরেড সলিল সেন লাল সেলাম

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা