দলের পলিটবুরো সদস্য এবং কেরালা রাজ্য কমিটির পূর্বতন সম্পাদক কমরেড ভি ভেনুগোপাল স্মরণে কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানে একটি সভা ১২ এপ্রিল কলকাতায় মৌলালি যুবকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন পলিটবুরোর প্রবীণ সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য। সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ইংরেজিতে মূল বক্তব্য রাখেন। সেটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হল।
এ কথা আপনারা সকলেই জানেন যে আমরা কোনও প্রয়াত নেতা অথবা কর্মীর স্মরণসভা করি শুধুমাত্র একটা আনুষ্ঠানিকতার জন্য নয়। আমাদের শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক, মহান মার্ক্সবাদী দার্শনিক ও চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা সেই কমরেডটি কী ভাবে তাঁর জীবনে প্রয়োগ করেছিলেন এবং সেই কমরেডটির জীবনসংগ্রাম থেকে আমরা কী শিখতে পারি তা জানার উদ্দেশ্যেই আমরা স্মরণসভার আয়োজন করি। আমরা সকলেই কমরেড শিবদাস ঘোষের ছাত্র এবং আমরা একে অন্যের থেকে শিখি। আমাদের দল একটি পরিবার। আমাদের এই কমরেডশিপ কমরেড শিবদাস ঘোষের দেওয়া বৈপ্লবিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধের ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত। ফলে আমাদের ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত বা অপরিচিত কোনও নেতা বা কর্মী যখনই প্রয়াত হন, তা আমাদের কাছে গভীর ব্যথা বহন করে আনে। বিশ্বের কোনও কমিউনিস্ট পার্টির কোনও নেতার প্রয়াণে বা কোনও কমিউনিস্ট পার্টির কোনও সমস্যা হলেও আন্তর্জাতিকতাবাদী হিসাবে আমরা একই রকম ব্যথা অনুভব করি।
কেরালাতে দলের কাজ কী ভাবে শুরু হয় এবং কী ভাবে কমরেড ভেনুগোপাল দলের সাথে যুক্ত হন ও কী ভাবে তিনি তাঁর জীবনসংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন– সেই সম্পর্কে আমি স্বল্প কয়েকটি কথা বলব। নচিকেতা মুখার্জী নামের যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একজন ছাত্র ডিএসও-র সাথে যুক্ত ছিলেন এবং আমাদের দলের সমর্থক ছিলেন। কেরালার কুইলন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে তিনি চাকরি পান। তিনি যখন কাজে যোগ দিতে যান, তাঁকে বলা হয় কমরেড শিবদাস ঘোষের কিছু পুস্তিকা নিয়ে যেতে যাতে সেখানে কিছু যোগাযোগ বের করে পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি করা যায়। সেই মতো তিনি তাঁর কলেজের সিনিয়র ছাত্রদের একটি গ্রুপের সাথে কথাবার্তা বলেন এবং তাঁরা কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্য পড়ে আমাদের দলের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন এই যোগাযোগগুলিকে আরও সংহত করার জন্য পার্টি কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তীকে কেরালাতে পাঠায়। সেখানে পার্টির কাজ শুরু করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এইভাবেই কেরালাতে পার্টির কাজ শুরু হয়।
এখানে আমি আমাদের সকলের শিক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের উপরে জোর দিতে চাইছি– কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাসম্বলিত পুস্তিকা কী অসাধ্য সাধন করতে পারে এবং তা আমাদের দলের অগ্রগতির ক্ষেত্রে কী অসাধারণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। পরবর্তীকালে সেখানে কমরেড শিবদাস ঘোষের একটি কর্মসূচি ঠিক করা হয়। কিন্তু অসুস্থতার জন্য তিনি যেতে পারেননি। দলের কেন্দ্রীয় অফিসে আপনারা কমরেড শিবদাস ঘোষের একটি হাতে আঁকা তৈলচিত্র দেখতে পান। কেরালায় পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রামে প্রথম যে ক’জন কমরেড এগিয়ে এসেছিলেন, তাদেরই অন্যতম সংগঠক ছিলেন কমরেড নটরাজন। তিনি সেই ছবিটি এঁকেছিলেন। শুরুর দিকে পার্টি গড়ে তোলার কাজে কমরেড নটরাজন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আকস্মিক অসুস্থতায় তিনি প্রয়াত হন। কেরালায় পার্টির ইনচার্জের দায়িত্ব নেন কমরেড জেমস। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি পার্টির চিন্তাধারা থেকে বিচ্যুত হন। তখন আমাদের দলের পলিটবুরোর প্রয়াত সদস্য এবং কমরেড নটরাজনের বন্ধু কমরেড সি কে লুকোস এই দায়িত্বভার গ্রহণে এগিয়ে আসেন।
আপনারা প্রায় সকলেই জানেন, বিভিন্ন রাজ্যে আমাদের পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রামে যাঁরা সূচনায় এগিয়ে এসেছিলেন তাদের কী প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু কেরালার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন ও আরও কঠিন। পশ্চিমবাংলায় পার্টি গড়ে তোলার প্রথম যুগের কমরেডদের যেমন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কেরালাতেও যাঁরা পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিলেন, তাদেরও সিপিএমের প্রবল বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল। সেসময় কেরালাতে সিপিএম খুবই শক্তিশালী পার্টি ছিল। বিভিন্ন সময়ে তারা সরকারও চালিয়েছে। ফলে যে কমরেডরা পার্টি গড়ে তোলার কাজে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাদের সিপিআইএম-এর কঠিন বাধার মুখে পড়তে হয়। অন্য রাজ্যের কমরেডদের থেকেও তাদের অনেক বেশি কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাঁদের থাকার স্থায়ী কোনও জায়গা ছিল না। কখনও কখনও অভুক্ত অবস্থাতেও দিন কাটাতে হয়েছে। কিন্তু তাঁরা কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক শিক্ষায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার প্রতি পূর্ণ আস্থা নিয়ে তাঁরা ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং নির্ভীক। এই ছোট গোষ্ঠীটি স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটার মতোই এক সুকঠিন সংগ্রাম শুরু করেন। এই সময়েই কমরেড ভেনুগোপাল একজন মেডিকেল ছাত্র হিসাবে দলে যোগদান করেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা তাঁর হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল, তাঁর বিবেককে জাগ্রত করেছিল এবং তিনি পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রামে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করেন। যখন দল অনেক শক্তিশালী, তখন তাতে যোগ দেওয়া সহজ। কিন্তু দল যখন একেবারে গড়ে ওঠার স্তরে ছিল এমনকি তার নামও কেউ জানত না, তখন অত্যন্ত লোভনীয় মেডিকেল কেরিয়ারের সুযোগ সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দিয়ে পার্টি জীবন বেছে নেওয়া সহজ কথা ছিল না। কমরেড ভেনুগোপালকে বুঝতে হলে আপনাদের এই বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বুঝতে হবে। তাঁরা যখন কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা প্রচার করতেন, আমি শুনেছি যে যারাই কমরেড শিবদাস ঘোষের এই বক্তব্যের সংস্পর্শে আসতেন, তারা বলতেন এ এক নতুন ধরনের মার্ক্সবাদ। সিপিএম-এর মার্ক্সবাদ অন্য মার্ক্সবাদ। এক অর্থে কথাটা সত্য। সিপিএম মেকি মার্ক্সবাদী দল ছিল এবং এখনও আছে। তারা মার্ক্সবাদের বিপ্লবী সত্ত্বাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। কমরেড শিবদাস ঘোষ মার্ক্সবাদকে যেভাবে উপস্থাপনা করেছেন, তার মধ্যেই মার্ক্সবাদের বিপ্লবী প্রাণসত্ত্বা রয়েছে এবং এখানেই তাদের সাথে আমাদের মূল পার্থক্য। দল গড়ে তোলার এই সংগ্রামে কমরেড সি কে লুকোস নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেন এবং কমরেড ভেনুগোপাল তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধারূপে সর্বদাই তাঁর পাশে ছিলেন। বস্তুত, তাদের সম্পর্কের বাঁধন এমনই ছিল যে, কমরেড ভেনুগোপালের নাম কমরেড সি কে লুকোসের নাম থেকে বিচ্ছিন্ন করা যেত না, আবার কমরেড সি কে লুকোসের নামও কমরেড ভেনুগোপালের নাম থেকে বিচ্ছিন্ন করা যেত না।
কমরেড ভেনুগোপাল বিবাহিত ছিলেন। তাঁর দুটি পুত্রও আছে। কিন্তু তিনি কখনওই পারিবারিক জীবন যাপন করেননি। তাঁর স্ত্রীও কেরালা রাজ্য কমিটির সদস্য। দুই সন্তানও পার্টির সঙ্গেই যুক্ত। বরাবর তিনি পার্টি সেন্টারেই থেকেছেন। পার্টির সঙ্গে যুক্ত সকল শিশু এবং অল্পবয়স্ক কমরেডদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই আবেগের। তিনি পার্টি কমরেডদের সন্তানদের কার্যত পিতা হয়ে উঠেছিলেন। ছোটরা তাঁকে আদরের ভেনুমামা বলে সম্বোধন করত। তিনি তাদের অত্যন্ত যত্ন করতেন, তাদের পার্টি কর্মী হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন। এদের মধ্যে অনেকেই বর্তমানে দলের নেতৃস্থানীয় কমরেড হিসাবে কাজ করছেন।
কমরেড ভেনুগোপাল নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাপ্ত পদমর্যাদার নেতা ছিলেন না। কমরেডদের হৃদয় জয় করার মধ্য দিয়ে তিনি নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর উন্নত আদর্শগত-সংস্কৃতিগত মান এবং সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য সকল কমরেডের কাছেই অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র ছিলেন। তিনি সকল কমরেডের যত্ন নিতেন। যখনই কোনও কমরেড সমস্যা বা বাধার সম্মুখীন হতেন, সঠিক পথনির্দেশ পেতে তাঁরা সবসময়ই কমরেড সি কে লুকোস অথবা কমরেড ভেনুগোপালের কাছে ছুটে যেতেন। সমগ্র কেরালা রাজ্যে পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বহু গণআন্দোলনও সংগঠিত করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপনারা কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রদ্ধার্ঘ্যে শুনেছেন, কেরালা রাজ্যের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মহলে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি তাঁদের অনেককেই আন্দোলনে সম্পর্কিত করেছিলেন এবং গণআন্দোলন গড়ে তোলা ও নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ‘জনকিয়া প্রতিরোধ সমিতি’ নামে একটি গণসংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। ঠিক যেভাবে অনেকটা পশ্চিমবাংলায় আমাদের দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক কমরেড নীহার মুখার্জীর গাইডেন্সে পলিটবুরোর প্রয়াত সদস্য কমরেড মানিক মুখার্জী শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ডঃ সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সন্তোষ ঘোষ, ডঃ নীহার রঞ্জন রায়, ডঃ সুশীল মুখার্জীর মতো বহু বুদ্ধিজীবীকে কমরেড মানিক মুখার্জী শিক্ষা আন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন। একই ভাবে কমরেড সি কে লুকোসের গাইডেন্সে কমরেড ভেনুগোপালও জাস্টিস ভি আর কৃষ্ণ আইয়ার, প্রফেসর এন এ করিম সহ কেরালার বহু শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদেরও আন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন। আপনারা ইতিমধ্যেই শুনেছেন জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের সাথে কমরেড ভেনুগোপালের কী ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ার তাঁকে সন্তানের মতো মনে করতেন। এটা সম্ভব হয়েছিল কমরেড ভেনুগোপালের উন্নত আদর্শগত-সংস্কৃতিগত-চারিত্রিক মান এবং সুগভীর দায়িত্ববোধের জন্য। জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ার আমাদের দলের কর্মসূচিতে কলকাতাতেও এসেছেন। তিনি আমাদের দলের লাইনকেও অনেক ক্ষেত্রে সমর্থন করতেন।
কমরেড ভেনুগোপাল দরিদ্র মৎস্যজীবী, কৃষক খেতমজুর ও সাধারণ মানুষেরও বন্ধু ছিলেন। তিনি একই সঙ্গে বুদ্ধিজীবী এবং নিপীড়িত সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। এটা একটা লক্ষণীয় গুণ। তিনি তাদের নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলনও সংগঠিত করেছিলেন। গরিব মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থেকেই তাদের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার জন্য তিনি আম্বালাপুঝাতে সূর্য হাসপাতাল গড়ে তোলেন। রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড ডাঃ গোদাকুমার এখনও গরিব মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টাই ওই হাসপাতালে অতিবাহিত করেন। কমরেড ভেনুগোপালের বাবা তাঁকে মেডিকেল প্র্যাকটিস শুরু করার জন্য ১ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ টাকাটাই তিনি এই হাসপাতাল গড়ে তোলার জন্য দিয়ে দেন। তত্ত্বগত-সাংগঠনিক-রুচি-সংস্কৃতিগত দিক দিয়ে কমরেড ভেনুগোপাল অত্যন্ত উন্নত মানের একজন কমরেড ছিলেন।
কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে কমরেড ভেনুগোপাল সাধারণ মানুষের কাছেও সহজভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। তাঁর উপস্থিতি, তাঁর আচরণ বহু মানুষকে আকর্ষণ করত। কমরেডদের সমস্যা-সঙ্কটের সময়ে কমরেড ভেনুগোপালের উপস্থিতিই তাদের কাছে এক জীবন্ত প্রেরণা ছিল। নতুন কমরেড বা জুনিয়ারদের থেকেও তাঁর শেখার মন ছিল। তিনি যখন কোনও কমরেডকে সমালোচনাও করতেন, সেই কমরেডটি কোনও দুঃখ বা যন্ত্রণা অনুভব করত না। বরং তারা অত্যন্ত আনন্দের সাথেই তাঁর সমালোচনা গ্রহণ করত। তাঁর সমালোচনা করার ধরনটাই ছিল এ রকম। তিনি কোনও আলোচনায়, বডি মিটিংয়ে মতপার্থক্য হলে খুব অল্প ক্ষেত্রেই উত্তেজিত হতেন বা রেগে যেতেন। তিনি খুবই শান্ত, ধীরস্থির কিন্তু সহজবোধ্য ও দৃঢ় যুক্তিপূর্ণভাবে তাঁর মতামত রাখতে পারতেন। তার চরিত্রের ধরনটাই ছিল এমন।
কমরেড ভেনুগোপাল অত্যন্ত গুণী কমরেড ছিলেন। তিনি উন্নত মানের বিপ্লবী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন যা সকলের কাছেই অনুসরণীয়। সারা দেশের সমস্ত কমরেডদেরই তাঁর জীবনের এই বিরল গুণগুলি সম্পর্কে ভালভাবে জানা এবং বোঝা দরকার। আমাদের দলে কেউ দলের নেতা, আবার কেউ জনগণের নেতায় পরিণত হন। কিন্তু তাঁর মধ্যে এই দুই গুণেরই প্রকাশ হয়েছিল। একত্রে এই দুটি গুণ আয়ত্ত করা খুবই কঠিন বিষয়। কমরেড ভেনুগোপাল সর্বদাই কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে কনস্ট্যান্ট কমন অ্যাসোসিয়েশন, কনস্ট্যান্ট কমন ডিসকাশন, কনস্ট্যান্ট কমন অ্যাক্টিভিটির অনুশীলন করে গেছেন। তিনি সর্বদাই পার্টির অভ্যন্তরে যৌথ কর্মপদ্ধতির উপরে জোর দিতেন। তিনি পার্টির অভ্যন্তরে ও জনগণের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে কখনই আত্মপ্রচার, অহঙ্কার বা আত্মসন্তুষ্টির প্রকাশ ছিল না। একবার একটি খুবই সংবেদনশীল বিষয়ে তিনি পার্টির সিদ্ধান্ত খুশি মনে মেনে নিতে পারছিলেন না, আবার সেটি অস্বীকারও করতে পারছিলেন না। এ নিয়ে তিনি খুবই দ্বন্দে্বর মধ্যে ছিলেন। আমি সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব নিরসনের ভার আমি তাঁর উপরেই ছেড়ে দিই। কিছুকাল পর তিনি চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এলে আমার সাথে দেখা করেন এবং সেই মিটিংয়ে কমরেডস অমিতাভ চ্যাটার্জী এবং সুভাষ দাশগুপ্তকেও তিনি থাকতে বলেন। সেখানে তিনি বলেন যে কমরেড আমি একটা ভুল ধারণা নিয়ে চলছিলাম। এখন আমি বুঝতে পারছি যে পার্টির সিদ্ধান্তই উপযুক্ত এবং সঠিক ছিল। কতটা সত্যনিষ্ঠ ছিলেন তিনি! সেই তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা। কমরেড ভেনুগোপালের প্রয়াণে দলের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। এটা শুধুমাত্র কেরালা রাজ্যের ক্ষতি নয়, গোটা দেশের পার্টির ক্ষেত্রেই এটা একটা বিরাট ক্ষতি। তাঁকে অন্য রাজ্যের কাজকর্ম দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কর্ণাটক যাওয়া শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ক্রমেই অক্ষম হয়ে যান। ফলে কেন্দ্রীয় পার্টি তাঁর মূল্যবান ভূমিকা থেকে বঞ্চিত হয়।
কমরেডস, আমরা সকলেই কমরেড শিবদাস ঘোষের ছাত্র। মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা অনুযায়ী অনেক নেতা-কর্মীই উন্নত কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জনের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের একে অপরের থেকে শেখা উচিত। কমরেড ভেনুগোপাল শ্রেণি, দল এবং বিপ্লবের সাথে একাত্ম হওয়ার সংগ্রামে বহু দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। এই সংগ্রাম সারা দেশের কমরেডদের সামনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাঁর অনুপস্থিতি কেরালা রাজ্য পার্টিতে একটা শূন্যতার সৃষ্টি করবে আমি জানি। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কমরেড জয়সন জোসেফের নেতৃত্বে দলের কেরালা রাজ্য কমিটি যৌথভাবে কঠোর সংগ্রাম পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে নিজেদের আরও উন্নত করার পথে এই শূন্যতা পূরণে সক্ষম হবে। আমি কেরালা রাজ্যের যুব কমরেডদের কাছে আবেদন করব আপনারা এগিয়ে আসুন এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের আরও যোগ্য করে তুলুন। এই আবেদন রেখেই আমি শেষ করলাম।
কমরেড ভেনুগোপাল লাল সেলাম
সভাপতি কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের ভাষণ
আপনারা এতক্ষণ আমাদের প্রিয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের আলোচনা শুনলেন, যাঁর নেতৃত্বেই কমরেড ভেনুগোপাল ছাত্রজীবনে এআইডিএসও-র কর্মী ও নেতা হিসাবে দীর্ঘকাল কাজ করেছেন। তাঁর এই অকালমৃত্যু, দেশে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের বিকাশ ও উন্নতিতে তাঁর অবদান থেকে পার্টিকে বঞ্চিত করল। কমরেড সি কে লুকোস এবং কমরেড ভেনুগোপাল এই দুই প্রথম সারির নেতার খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে জীবনাবসান পার্টির উপর নিঃসন্দেহে এক বিরাট আঘাত। কমরেড ভেনুগোপাল ও অন্যান্য কয়েকজন কমরেড কী ভাবে শিবদাস ঘোষের চিন্তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কেরালায় পার্টির কার্যকলাপ শুরু করেছিলেন, তার কিছুটা বর্ণনা আপনারা কমরেড প্রভাস ঘোষের আলোচনায় পেয়েছেন। তাঁরা সকলেই লোভনীয় কেরিয়ারের হাতছানি উপেক্ষা করে বিপ্লবের স্বার্থে সর্বস্ব নিবেদন করার পথ গ্রহণ করেছিলেন।
আমি ঠিক জানি না, কমরেড ভেনুগোপাল কখনও কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে সাক্ষাৎ করতে পেরেছিলেন কি না। অন্যদের সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং সেটাই তাঁদের মধ্যে নতুন বিপ্লবী জীবন শুরু করার প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল। খুব অল্পদিনের মধ্যেই তাঁরা কেরালায় শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। বিপ্লবী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা একটি সংগ্রামের প্রক্রিয়ার ফসল। আমাদের দলে বিপ্লবী সংগ্রামের এই প্রক্রিয়াটি জীবন্ত আছে। যে কারণেই তা এই ধরনের চরিত্রের নেতা-কর্মীর জন্ম দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কমরেডরা নিজেদের ভাল সংগঠক, জননেতা এমনকি শক্তিশালী পার্টি-নেতায় পরিণত করছেন। গভীর শোকের সময় কী ভাবে আচরণ করতে হবে, সেই শিক্ষাও কমরেড ঘোষ আমাদের দিয়ে গেছেন। আমি জানি, কমরেড ভেনুগোপালের মৃত্যু কেরালা পার্টির কাছে একটা বিরাট আঘাত। কিন্তু আমি তাদের এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, তাদের এই গভীর শোকের সময় সমগ্র পার্টি তাদের পাশে আছে। এই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাঁরা দল পরিচালনা করলে একই প্রক্রিয়ায় তাঁরা আরও অনেক নেতা ও কর্মীর জন্ম দিতে পারবেন এবং সেটাই হবে কমরেড ভেনুগোপালের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা।