এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের কোচবিহার জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য, অল ইন্ডিয়া কিসান খেতমজদুর সংগঠনের সর্বভারতীয় সহ সভাপতি এবং কোচবিহার জেলা সম্পাদক কমরেড দেবেন্দ্রনাথ বর্মন নিউমোনিয়া এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ১৮ জুলাই সকালে কোচবিহারের ডাঃ পি কে সাহা হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
তুফানগঞ্জ মহকুমার বালাকুঠি গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান কমরেড দেবেন্দ্রনাথ বর্মন ১৯৫০ সালে কোচবিহারের ভারতভুক্তির পর তাঁর কৈশোরেই নিজ এলাকায় বেনাম জমি-খাস জমি উদ্ধার ও গরিব চাষিদের মধ্যে বিলি করার মধ্য দিয়ে কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হন। এর মধ্য দিয়ে তিনি এলাকার বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম একজন সংগঠক হয়ে ওঠেন। সে সময় তিনি অবিভক্ত সিপিআই দলের সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তীকালে দল ভাগ হলে তিনি সিপিআইএম দলের কর্মী হিসাবে কাজ শুরু করেন। এলাকার জনসাধারণের নানা দাবি নিয়ে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং এলাকার জননেতায় পরিণত হন। তিনি রাজ্যসভার সাংসদ এবং বিধানসভার সদস্য হিসাবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৯৩-৯৪ সালে তুফানগঞ্জের একদল সিপিএম নেতা-কর্মী দলের অ-মার্কসবাদী নীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের রূপ দেখে ওই দল সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সঠিক বামপন্থী দল খুঁজতে গিয়ে এস ইউ সি আই (সি)-র সঙ্গে যুক্ত হন। এঁদের মধ্যে কমরেড আছরউদ্দিন আহমেদ, কমরেড মৃণাল আচার্য ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৫ সালে তাঁদের মাধ্যমে কমরেড দেবেন্দ্রনাথ বর্মনের সাথে এস ইউ সি আই (সি) দলের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। দলের তৎকালীন জেলা সম্পাদক ও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড সুব্রত চৌধুরীর সাথে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার পর তিনি এই আদর্শকে জীবনদর্শন হিসাবে গ্রহণ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই আদর্শে অবিচল ছিলেন।
এস ইউ সি আই (সি)-তে যুক্ত হওয়ার সময় তৎকালীন শাসক দলের একজন বিধায়ক এবং প্রাথমিক স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও তিনি দলের একেবারে সাধারণ কর্মী হিসাবে কাজ শুরু করেন। পরিষদীয় পদের মোহ এবং ক্ষমতার রাজনীতিকে তিনি হেলায় ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। এ ক্ষেত্রে কোনও দ্বিধা বা সংকোচ তাঁর ছিল না। এই প্রশ্নে তিনি চরিত্রের অত্যন্ত উন্নত মান প্রতিফলিত করেন। সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় তিনি দলের সদস্যপদ অর্জন করেন এবং ২০০৯ সালে তিনি জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। জেলা জুড়ে শিক্ষা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। জেলার বহু গণআন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ ক্ষেত্রে নিজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সদস্য সংগ্রহ, গ্রাম স্তরে প্রচার থেকে শুরু করে আন্দোলনের একেবারে তৃণমূল স্তরেরবহু কাজ নিজে হাতে করতেন। কোনও মিথ্যা অহং তাঁকে এ কাজে আটকায়নি। শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি পুরোপুরি কৃষক আন্দোলনে মনোনিবেশ করেন। ২০১২ সালে তিনি এ আই কে কে এম এস-এর কোচবিহার জেলা সম্পাদক এবং ২০১৬ সালে সংগঠনের সর্বভারতীয় সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ২০২০ সালে কৃষক লং মার্চ সংগঠনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও তিনি দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছেন।
সত্য জানার আকাঙক্ষা, সততা, নিষ্ঠা ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। দলের তত্তে্বর কথাগুলিকে তিনি অত্যন্ত সহজ করে উপস্থিত করতে পারতেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণের প্রশ্নে তিনি কোনও সংকীর্ণ চিন্তার গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিলেন না। জনজাতি, উত্তরবঙ্গের নানা সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে সর্বপ্রকার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর পরিবারকে তিনি বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন। তাঁর অনাড়ম্বর জীবন, চরিত্রমাধুর্য, সরলতা ও সর্বক্ষণ মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা মানুষকে আকর্ষণ করত। এর মধ্য দিয়ে তিনি বহুজনকে দলের বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন।
কমরেড দেবেন্দ্রনাথ বর্মনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে দলের কর্মী-সমর্থকরা হাসপাতালে সমবেত হন। ক্ষুদিরাম স্কোয়ারে তাঁর মরদেহ আনা হলে দলের জেলা সম্পাদক ও রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড শিশির সরকার সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান। ২ আগস্ট তুফানগঞ্জ কমিউনিটি হলে তাঁর স্মরণসভায় দলের কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি বহু সাধারণ মানুষ ও অন্য বামপন্থী দলের কর্মী-সমর্থকরা সমবেত হন। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও এআইকেকেএমএস-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর ঘোষ, দলের জেলা সম্পাদক কমরেড শিশির সরকার, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর প্রবীণ সদস্য কমরেড শঙ্কর গাঙ্গুলী এবং অন্যান্য বামপন্থী দলের নেতৃবৃন্দ সভায় বক্তব্য রাখেন।
কমরেড দেবেন্দ্রনাথ বর্মনের মৃত্যুতে দল হারালো এক বিশিষ্ট সংগঠককে, কোচবিহার জেলার বামপন্থী আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হারালো।
কমরেড দেবেন্দ্রনাথ বর্মন লাল সেলাম