‘স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি নেই৷ নেই কোনও ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স৷ শুধু দলের নির্দেশ মাথা পেতে নিয়ে লোকসভায় প্রার্থী৷’ অবাক হয়ে গেছেন সাংবাদিক৷ তমলুকের মধুসূদন বেরা, পুরুলিয়ার রঙ্গলাল কুমার, বীরভূমের আয়েষা খাতুনের মতো আরও অনেকের পরিচয় পেয়ে তাঁর বিস্ময় বাঁধ মানে না৷ লিখেছেন, ‘আর্থিক অনটন যাঁদের নিত্যসঙ্গী, তাঁদের কাছে ভোটের প্রচারে অর্থাভাব নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই৷’ (বর্তমান, ৩০ এপ্রিল ২০১৯)৷ ভোট মানেই যেখানে টাকার স্রোত, টাকা দিয়ে দল ভারি করা, পোস্টার মেরে দিলে টাকা, মিছিলে গেলে টাকা, মন্ত্রী–এমপি–এমএলএ শত কোটি এমনকী হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পত্তি, সেখানে ভোট ময়দানে লড়তে এসে, মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা সংগ্রহ করে ভোটের যাবতীয় খরচ মেটাচ্ছেন– এঁরা কারা? এঁদের পরিচয় জানেন এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ– এঁরা সকলেই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের পক্ষে লোকসভা ভোটের প্রার্থী৷ দিন আনা দিন খাওয়া নিরুপায় দরিদ্র থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের জীবন–যন্ত্রণা নিয়ে সর্বদা সোচ্চার যে এঁরাই৷
খবরের কাগজ কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলের চোখে এঁরা ‘অন্যরকম প্রার্থী’৷ যেমন ৪ মে, ২৪ ঘন্টা চ্যানেল দেখিয়েছে অন্য দলগুলির তথাকথিত গ্ল্যামার আর টাকার জোরের পাশে যাদবপুরে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)–এর প্রার্থী দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজাতা ব্যানার্জীর একমাত্র সম্বল আদর্শ৷ সেটাই আকর্ষণ করছে বিরাট সংখ্যার মানুষকে৷ এই প্রসঙ্গে বারবার উঠে আসছে প্রয়াত নেতা শ্রদ্ধেয় সুবোধ ব্যানার্জীর কথা৷ উঠে আসছে তাঁর সংগ্রামী জীবনের প্রসঙ্গ৷ জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী মৎস্যজীবী ও কৃষক আন্দোলনের নেতা জয়কৃষ্ণ হালদার৷ মনোনয়ন পেশ করতে গেছেন, অবাক সমস্ত আধিকারিকরা৷ প্রায় কপর্দকশূন্য একজন মানুষ, দিনের পর দিন নিজের জন্য কিছুই না ভেবে জনগণের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেন কী করে? বিশিষ্ট চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হয়েও উত্তর কলকাতার প্রার্থী ডাক্তার বিজ্ঞান বেরা কেন বেশিরভাগ সময়টা ব্যয় করেন দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বস্তুত, সেই উত্তরবঙ্গ থেকে সুন্দরবন –রাজ্যের ৪২টা কেন্দ্রে শুধু নয়, দেশের ১১৯টি কেন্দ্রেই এমন প্রার্থীর দেখা পাওয়া গেছে৷ সাধারণ মানুষ এঁদের চেনেন, জানেন, তাঁরা বলেন এটাই তো এস ইউ সি আই (সি)৷
বিস্মিত হচ্ছেন সাংবাদিকরা৷ কারণ তাঁরা বেশ ভাল জানেন, ভোট মানে টাকার মোচ্ছব৷ এই ২০১৯ সালে আমেরিকার মুদ্রা ডলারের নিরিখে টাকার দাম যতই তলানিতে ঠেকুক না কেন, ডলারের দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রকাশ্যে যত খরচ হয়েছিল তাকে ছাপিয়ে গেছে ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রকাশ্য ব্যয়৷ ‘প্রকাশ্য’ কথাটা বলা দরকার, কারণ দেশের প্রায় সকলেই জানে পর্দার পিছনের খরচটাই আসল৷
এই বছর ভারতের নির্বাচনে ইতিমধ্যেই কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে বিজেপি, কংগ্রেস সহ বড় বড় দলগুলি, ডলারের হিসাবে যা দাঁড়ায় ৭০০ কোটি৷ যেখানে বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে খরচ হয়েছিল ৬৫০ কোটি ডলার৷ কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস নামে একটি মার্কিন সমীক্ষা সংস্থা গবেষণা করে দেখিয়েছে, ভারতে মাথাপিছু গড় আয় যেখানে ২০০ টাকারও কম, সেখানে ভোটের জন্য ব্যয় মাথাপিছু গড়ে ৫৬০ টাকা৷ সমীক্ষকদের হিসাবে ২৩ মে নির্বাচন শেষ হতে হতে এই খরচ ছাড়িয়ে যাবে ৭০ হাজার কোটি টাকারও বেশি৷ কিন্তু এটা কেবলমাত্র বৈধ ব্যয়৷ অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস, সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের মতো কিছু সংস্থার করা সমীক্ষা দেখাচ্ছে এই টাকা আসলে গোপন ব্যয়ের সাড়ে তিন শতাংশ মাত্র৷ খুব রক্ষণশীল হিসাবেও পিছনের দরজা দিয়ে একা বিজেপির খরচ ২ লক্ষ কোটি টাকার কম নয়৷ বাকি দলগুলিও কিছু কম যাবে না (মানি কন্ট্রোল ডট কম, ২ এপ্রিল, ২০১৯)৷
প্রধানমন্ত্রী, বিজেপি সভাপতি, তাঁদের ছোটবড় নেতারা অসংখ্য প্লেন–হেলিকপ্টারে ছুটে বেড়াচ্ছেন৷ কংগ্রেস সভাপতি কিংবা সদ্য নেতৃত্বের তকমা পাওয়া প্রিয়ঙ্কা গান্ধীও কম যাচ্ছেন না৷ এত বিমান–হেলিকপ্টারের বিপুল টাকা জোগাচ্ছে কারা? এর মধ্যেই নির্বাচন সামলানোর জন্য দিল্লিতে বিজেপির নতুন অফিস তৈরি হয়েছে৷ তাতে খরচ নাকি ৭০০ কোটি টাকা বলে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন৷ বিজেপিও নীরব থেকে সে কথার সত্যতা মেনে নিয়েছে৷ নির্বাচন কমিশন যেখানে লোকসভা আসন পিছু ৭০ লক্ষ টাকা খরচ বেঁধে দিয়েছে, সেখানে মোদিজির বেনারসের একটা সভার জন্যই খরচ হয়েছে ১ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা৷
কলকাতার ব্রিগেডে নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক সভার পর কাগজে ছবি বেরিয়েছিল, সভা ভরাতে শুধু বাস–ট্রেন নয়, বিরিয়ানি থেকে ঢালাও মদের বোতল– সব ব্যবস্থাই ছিল৷ বলাই বাহুল্য, ছিল মাথা পিছু টাকার টোপও৷ প্রধানমন্ত্রী বা সর্বভারতীয় সভাপতি স্তরের নেতাদের সভা ভরাতে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি থেকে লোক আনার জন্য এইরকমই বিপুল খরচ করে চলেছে বিজেপি৷ কংগ্রেস–তৃণমূলও এই বাবদ খরচ করছে কোটি কোটি টাকা৷ সভায় গেলে যে টাকা দেওয়া হয়, তা এখন গোপন কিছু নয়৷ সম্প্রতি তেলেঙ্গানার খাম্মামে তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতির (টিআরএস) এক নির্বাচনী সভার বাইরের রাস্তায় শতাধিক মহিলা–পুরুষ ধর্নায় বসেছিলেন৷ কারণ মিটিংয়ে আসার জন্য যত টাকার প্রতিশ্রুতি ছিল, স্থানীয় নেতারা তার থেকে কম দিচ্ছিলেন (ইন্ডিয়া টুডে, ৫ এপ্রিল ২০১৯)৷ পরিস্থিতি এমন যে, মানুষ হিসাব করে, কোন দলের টাকা খরচের ক্ষমতা বেশি– সেই জিতবে৷ সরাসরি টাকা দিয়ে ভোট কেনা, মদের বোতল দিয়ে ভোট কেনা, টিভি, ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোন বিলি, এসব তো জলভাত হয়ে গেছে৷ এমনকী মিছিলে যুবকদের আনার জন্য ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রে মোটরবাইক বিলি করেছে বিজেপি৷ কংগ্রেস, তৃণমূল ইত্যাদি দলও, যার যেখানে শক্তি একই কাজ করে চলেছে৷
এই বিপুল পরিমাণ টাকা আসে কোথা থেকে? দেশের কোটি কোটি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তো আর এই টাকা জোগান না৷ এ টাকা জোগায় দেশের মালিক শ্রেণি৷ নানা রঙের দলের পিছনে তারা টাকা ঢালে৷ যাতে প্রয়োজনের সময় সুদে–আসলে তা উসুল করে নিতে পারে৷ বিজেপি সরকার চালু করেছে ‘নির্বাচনী বন্ড’৷ যে কেউ ১ হাজার থেকে ১ কোটি টাকার বন্ড কিনে রাজনৈতিক দলকে দিতে পারে৷ তাদের নাম গোপন থাকবে৷ দেখা যাচ্ছে ২০১৮ সালে যে ২ হাজার কোটি টাকার বন্ড বিক্রি হয়েছে, তার ৯০ শতাংশই এক কোটি টাকা মূল্যের৷ বোঝাই যায়, কোনও সাধারণ মানুষ নয়, কিনেছে বড় বড় শিল্পপতি গোষ্ঠী৷ যার অধিকাংশটাই পেয়েছে বিজেপি, দ্বিতীয় স্থানে আছে কংগ্রেস (ব্লুমবার্গ ডট কম ১৬ মার্চ ২০১৯)৷ সুপ্রিম কোর্টে সম্প্রতি এই সংক্রান্ত মামলায় নির্বাচন কমিশন অর্থদাতাদের নাম প্রকাশ্যে আনার জন্য সওয়াল করলেও কেন্দ্রীয় সরকার দাতাদের নাম প্রকাশ না করতে বদ্ধপরিকর৷ কেন আপত্তি? কারণ ধনকুবের কর্পোরেট সংস্থাগুলি ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায় করার জন্যই টাকা ঢালে৷ নাম প্রকাশ্যে এলে জনসাধারণ জানতে পারবে কোন কোন ধনকুবেরকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে পকেট ভরিয়েছে শাসকদল৷ এবারের ভোটে সবচেয়ে বেশি বিদেশি অনুদান নিয়ে স্বদেশিয়ানার চ্যাম্পিয়ন সেজেছে বিজেপি৷ আইন এমনভাবে পাল্টানো হয়েছে যাতে যে কোনও বিদেশি সংস্থা কিছু ভারতীয় অংশীদারকে দেখাতে পারলেই অক্লেশে এ দেশের ভোটে টাকা ঢালতে পারে৷ কেন তারা টাকা ঢালতে এত আগ্রহী, সে কথা কি ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে?
লিখিতভাবে ২ হাজার কোটি টাকা মোট অনুদান নিয়ে প্রায় ৯ লক্ষ কোটির বেশি খরচ করছে কী করে দলগুলি? এ প্রশ্নের উত্তরও ভারতের জনগণ জানেন৷ কালো টাকার থলিই আজ তথাকথিত গণতন্ত্রের আসল নির্ণায়ক৷ তার জোরেই মানি–মাসল–মিডিয়া এই তিন শক্তিকে কেনে ভোটবাজ দলগুলি৷ তার জোরেই হয় ভোটের প্রহসন৷ সাধারণ মানুষের কণ্ঠ তাতে চাপা পড়ে যায়৷ আর ভোটে যারাই জিতুক মালিকদের স্বার্থে তারা জনসাধারণকে শোষণ করে ছিবড়ে করে দেয়৷ ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা দুর্বল দেশেও লুঠের কারবার চালানোর সুযোগ পায়৷ তাই পছন্দের দলকে জেতাতে টাকার থলি উজাড় করে দিতে পুঁজিমালিকদের কোনও কার্পণ্য নেই৷
এই পরিস্থিতিতে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) প্রার্থীরা যখন ঘোষণা করেন, আমাদের সম্বল মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার মতো মহান আদর্শ– মানুষ প্রথমটা অবাক হয় রাজনীতির জগতে আজও আদর্শকেই পাথেয় করে চলার মানুষ তাহলে আছে তারপর ঘরের দাওয়ায় আসনটা পেতে দেয় রোদে পোড়া সেইসব ঘর্মাক্ত যোদ্ধাদের জন্য৷ জনগণ নাড়ি দিয়ে বোঝে, এখানেই আছে তার আসল ভরসা৷ তাই ঘরে যা জোটে তাই খেতে দেয় এই মানুষগুলিকে, নিজের জমানো ক’টা টাকা উজাড় করে দিয়ে বলে জেতো হারো পরের কথা– লড়াই ছেড়ো না তোমরা৷ সারা দেশে একই অভিজ্ঞতা এস ইউ সি আই (সি) নেতা–কর্মীদের৷ মানুষের এই সমর্থনের মধ্য দিয়েই তৈরি হচ্ছে আগামী দিনের গণআন্দোলনের জমি৷