মোদি সরকারের দাবি, উন্নত থেকে উন্নততর দেশ হয়ে ওঠার পথে এগোচ্ছে ভারত। দেশের পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছনো শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাদের এই দাবি যদি সত্য হয় তা হলে অর্থনীতিতে এগোনোর সাথে সাথে তো দেশের মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়ার কথা।শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, কেনার ক্ষমতা, সুস্থির পরিবেশ– সব কিছুরই অগ্রগতি ঘটার কথা। কিন্তু দারিদ্র, অনাহার, শিশু ও প্রসূতি মৃত্যুর মতো সূচকগুলিতে বিশ্বের নানা দেশের নিরিখে ভারত ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে কেন?
আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডে’, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, গ্লোবাল হেলথ কেয়ার সিকিউরিটি ইনডে’ এবং গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে দেখা যাচ্ছে, কর্মসংস্থান, ক্ষুধা, প্রসূতি ও শিশুমৃত্যু এবং শান্তি-সম্প্রীতির হারে ভারত রয়েছে পিছনের দিক থেকে এগিয়ে।গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১২৫টি দেশের মধ্যে ১১১তম স্থানে রয়েছে ভারত। ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, প্রতি মিনিটে দেশে এক জন করে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ২০২১ সালে গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি ইনডেক্সে ভারত ১৯৫টি দেশের মধ্যে ছিল ৬৬তম স্থানে।
সম্প্রতি নীতি আয়োগের গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, মাল্টি-ডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স অনুযায়ী ভারতে ২০১৩-১৪ সালের ২৯.১৭ শতাংশের তুলনায় ২০২২-২৩ এ বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক কমে দাঁড়িয়েছে ১১.২৮ শতাংশে। দারিদ্র যদি সত্যই এত বিপুল সংখ্যায় কমে থাকে, তবে প্রধানমন্ত্রীকে নতুন করে ৮০ কোটি মানুষের জন্য রেশন ঘোষণা করতে হল কেন? তবে কি তিনি তা অপ্রয়োজনেই ঘোষণা করলেন? অর্থাৎ যারা তাঁদের বিচারে দরিদ্র নয়, তাদের জন্যই এ ‘অপচয়’ করছেন? আর যদি তা না হয়, তা হলে কি ভোটের দিকে তাকিয়েই এই ঘোষণা করছেন তিনি? প্রধানমন্ত্রী কি এ প্রশ্নের জবাব দেবেন কেন মানুষের জীবনমানের উন®য়নের পরিবর্তে মন্দির নির্মাণকে সরকারের সাফল্য হিসাবে দেখাতে হচ্ছে?
বাস্তবে সাধারণ মানুষের নয়, পর্বতপ্রমাণ উন্নয়ন হয়ে চলছে আম্বানি-আদানিদের মতো একচেটিয়া পুঁজিপতিদের। প্রধানমন্ত্রী যে উন্নয়নের কথা বলছেন তা পুঁজির পাহাড়ে বসে থাকা ওই একচেটিয়া পুঁজিপতিদেরই। সেটা দেখিয়েই নেতা-মন্ত্রীরা দেশের উন্নয়নের বিজ্ঞাপন দেন! এটাই সরকারের দেখানো বেশিরভাগ খালি একটি গ্লাসের নামমাত্র ভর্তি অংশ। গ্লাসের খালি অধিকাংশটা হল সাধারণ মানুষ, যাদের জীবনে উন্নয়নের ছিটেফোঁটা নেই। আর সরকারের স্ট্যাম্প গায়ে মেরে নীতি আয়োগও ঘোষণা করেছে, কারও বাড়িতে শৌচালয় থাকলে বা বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেই তাকে আর গরিব বলে ধরা হবে না। এই হাস্যকর মানদণ্ডে বিচার করলে দেশে গরিব খুঁজে পাওয়াই যাবে না। নীতি আয়োগের এই অবান্তর রিপোর্টকে দেখিয়ে সরকার যে দারিদ্র কমছে বলে দাবি করছে, তা যে কত অন্তঃসারশূন্য তার প্রমাণ অক্সফ্যাম রিপোর্ট। ২০২৩-এর অ’ফ্যাম রিপোর্ট বলছে, মাত্র ৫ শতাংশ নাগরিকের হাতে জমা হয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৬০ শতাংশ। আর নিচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষের জন্য জুটেছে তার মাত্র ৩ শতাংশ।
তা হলে দেশের কোটি কোটি শ্রমিক-কৃষক প্রতিদিন তাদের শ্রম দিয়ে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ সৃষ্টি করে চলেছে, সে সব যাচ্ছে কোথায়? শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রমে তৈরি সেই সম্পদ আত্মসাৎ করছে পুঁজিপতিরা।সেই সম্পদ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির ভাণ্ডারে জমা হয়ে আকাশচুম্বী হচ্ছে। পুঁজিপতিদের এই সম্পদবৃদ্ধি যাতে অবাধ হয় তার জন্য আইনি ও বেআইনি সব রকম ভাবেসাহায্য করছে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারগুলি।সেজন্য সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র– তেল, গ্যাস, খনি, ব্যাঙ্ক, বিমা, রেলকে বেচে দিচ্ছে শিল্পপতির কাছে।সম্প্রতি দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের রিপোর্ট এই বিষয়টিকে সত্য প্রমাণ করে বলেছে, সকলের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। গরিব ও নিম্নবিত্তরা থেকে যাচ্ছে উন্নতির বাইরে।
যতই মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির উন্নয়নকে ‘দেশের উন্নয়ন’ হিসাবে দেখান প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা, তাতে কোনও ভাবেই চাপা দেওয়া যাচ্ছে না বেকারি, দারিদ্র, অনাহারে পিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণাকে।