Breaking News

এক দেশ এক ভোটঃ কেন্দ্রের হাতেই সব ক্ষমতা নিতে চায় বিজেপি

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই ‘এক দেশ এক ভোট’-এর পক্ষে প্রচার শুরু করেন। যদিও তিনিই প্রথম নন। ১৯৯৯ সালে বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর শাসনকালে বি পি জীবন রেড্ডির নেতৃত্বাধীন আইন কমিশন ‘এক দেশ এক ভোট’ প্রসঙ্গে আলোচনাকে সামনে তুলে ধরেছিল। ২০১৮ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে আইন কমিশন দেশ জুড়ে লোকসভা, বিধানসভা এবং তার নির্দিষ্ট একটা সময়সীমার মধ্যে পুরসভা ও পঞ্চায়েতের নির্বাচন একই বছরে আয়োজন করার প্রস্তাব দেয়। এর জন্য প্রয়োজনীয় নির্বাচনবিধি, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়। সেই উদ্দেশ্যে গত বছর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি গঠন করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। স্বভাবতই সেই কমিটির অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন বিজেপি ঘনিষ্ঠ। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে লোকসভা ভোটের ঠিক আগে সেই কমিটি সারা দেশে সমস্ত ধরনের ভোট একসঙ্গে করার সুপারিশ করে একটি বিশাল রিপোর্ট জমা দেয়।

১৭ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী এই প্রসঙ্গে লোকসভায় দুটি বিল পেশ করেন। প্রথমটি, লোকসভা এবং রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গে করা। দ্বিতীয়টি, লোকসভার সাথে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচেরি, দিল্লি, জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচন সম্পন্ন করা। কিন্তু এই বিলগুলিকে কার্যকর করতে হলে একদিকে ১৯৫০ ও ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের পরিবর্তন করতে হবে এবং অন্যদিকে সংশোধনের দ্বারা সংবিধানের ৮৩, ৮৫, ১৭২, ১৭৪ এবং ৩৫৬ ধারার পরিবর্তন করতে হবে। এইসব সংশোধন বা পরিবর্তন করতে গেলে লোকসভা ও রাজ্যসভার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। অথচ বিজেপি বা এনডিএ-র সে শক্তি এখন নেই। বর্তমানে সেই বিল যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর কথা হয়েছে। প্রশ্ন হল, এত কিছুর মধ্যে দিয়ে ‘এক দেশ এক ভোট’-এর ব্যবস্থা চালু করার উদ্দেশ্য কী এবং এত তৎপরতাই বা কী উদ্দেশ্যে?

বিজেপির যুক্তি

বিজেপির যুক্তি, এ দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন থেকে বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তখন যদি তা হয়ে থাকতে পারে এখন অসুবিধা কোথায়? দ্বিতীয়ত, বারবার নির্বাচনের ফলে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে, একত্রে নির্বাচন হলে তা কমানো সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, বারবার নির্বাচনের জন্য বারবার নির্বাচনী বিধি চালু করতে হয়। দীর্ঘদিন প্রশাসনের একটা অংশকে নির্বাচনের কাজে যুক্ত থাকতে হয় এবং সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকে, তাতে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়। চতুর্থত, বারবার নির্বাচনে নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়। পঞ্চমত, বারবার ভোট দিতে আসতে হলে পরিযায়ী শ্রমিকদের খুবই অসুবিধা হয়। অনেক শ্রম দিবস নষ্ট হয়।

যুক্তির অসারতা

 এ কথা ঠিক, প্রথম সাধারণ নির্বাচন থেকে কয়েকবার লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৫৭ থেকে কংগ্রেসী অপশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা তীব্র জনরোষের ফলে কেন্দ্রে এবং রাজ্যে ভিন্ন দলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কংগ্রেস সরকার তাদের সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে ভেঙে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার রাস্তা নেয়। এর ফলে হতে থাকে অন্তর্বর্তী নির্বাচন। পাশাপাশি কারও অকালমৃত্যু, পদত্যাগ, কিছু বিধানসভা সদস্যের লোকসভা বা রাজ্যসভায় নির্বাচিত হওয়া সহ নানা কারণেও নির্বাচন করতে হয়। এই অবস্থায় অবশ্যম্ভাবী রূপে বারবার নির্বাচনের প্রশ্ন আসেই। এই অন্তর্বর্তী নির্বাচনে যারা বিধানসভার ক্ষমতায় এল তাদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই লোকসভা নির্বাচনের সময় চলে আসে। বিভিন্ন রাজ্যের অন্তর্বর্তী নির্বাচনও হয় বিভিন্ন সময়ে। তাই একত্রে লোকসভা এবং সমস্ত বিধানসভা নির্বাচন সম্ভব হয় না। একবার একসাথে নির্বাচন করলেও পরবর্তী সময়ে আর একসাথে করা সম্ভব হয় না। এই অবস্থা কি বাস্তব নয়? কেন্দ্র ও রাজ্যের নির্বাচন একসঙ্গে করার বিধি চালু করার দ্বারা অন্তর্বর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজ্য সরকারের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করা হয় না কি?

দ্বিতীয়ত, বিপুল অর্থব্যয়ের যে কথাটি বিজেপি উত্থাপন করতে চাইছে তা আদৌ কি তথ্যসম্মত? তা বিচার করার আগে যে নৈতিক প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেয় সেটি হল, যে দল নির্বাচনে জৌলুস সৃষ্টি করতে, প্রচারে, ভোট কিনতে, অন্য দলের বিজয়ী প্রার্থীদের কোটি কোটি টাকা দিয়ে কিনে গদি দখলে সিদ্ধহস্ত, যারা নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা তোলে, তাদের মুখে নির্বাচনে খরচ কমানোর কথা কোনও ভাবেই মানায় কি! শুধু তাই নয়, যিনি এই ব্যবস্থার জন্য প্রবল উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন সেই প্রধানমন্ত্রী ঘনঘন বিদেশ যাত্রা আর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আত্মপ্রচারের জন্য জনসাধারণের কষ্টার্জিত রাজস্বের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছেন। অন্য দিকে পুঁজিপতিদের কর ছাড় দেওয়ার পরিমাণ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের দুই শতাংশেরও বেশি। এ কথাও তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একত্রে সমস্ত নির্বাচন পরিচালনা করতে গেলে যে সংখ্যক ইভিএম লাগবে তার জন্য সরকারি হিসাবেই খরচ হবে ৮ হাজার কোটি টাকা। তাই সবকিছুকে একত্রে বিচার করে দেখলে অর্থব্যয়ের যুক্তিটি একটি অজুহাত মাত্র।

তৃতীয়ত, বারবার নির্বাচনে উন্নয়ন থমকে যাবার কথাটি কি আদৌ সত্য? পাঁচ বছরে ক’বার নির্বাচন হয়? তিন বার। তাতে বড়জোর ৩-৪ মাস নির্বাচনী বিধি বলবৎ থাকে। বাকি সময়ে তো নির্বাচন থাকে না। তখন কি উন্নয়নের জোয়ার বয়? তা ছাড়া উন্নয়ন বলতে কী বোঝায়? রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, ফ্লাইওভারের উন্নয়ন, শিলান্যাস, এসবে তো ভোটের মরশুমে ঝড় বয়ে যায়। আর উন্নয়ন বলতে যদি জনগণের আর্থিক উন্নতি, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বোঝায় তা হলে তার সাথে নির্বাচনের সম্পর্ক কী? দেশবাসী কি জানে না যে, যতটুকু উন্নয়নের কাজ হচ্ছে, বাস্তবে কার উন্নয়ন ঘটছে? উন্নয়ন হচ্ছে তো বৃহৎ পুঁজি বা কর্পোরেট মালিকদের, বড় বড় ব্যবসাদারদের। জনসাধারণের জীবনে উন্নয়ন কোথায়? শতকরা এক শতাংশ মানুষের হাতে দেশের বেশিরভাগ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া এবং জনসাধারণের জীবনের হাহাকারই কি সেই উন্নয়নের মিথ্যা প্রহসনের বাস্তব চিত্র নয়?

চতুর্থত, একসাথে নির্বাচনে নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগের সুবিধা হবে, আলাদা আলাদা হলে তার অসুবিধা হবে– এর কোনও সারবত্তা নেই শুধু নয়, ঘটনা ঠিক তার বিপরীত। বরং একত্রে নির্বাচনে নিরাপত্তারক্ষীর উপযুক্ত সংখ্যায় নিয়োগ করাটাই অসুবিধাজনক। তাই এটি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে ‘যুক্তি’ উত্থাপনের কূট কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।

পঞ্চমত, পরিযায়ী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুরবস্থা, যেখানে তারা কাজ করতে বাধ্য সেখানে তাদের নিরাপত্তার বিষয় এবং লকডাউনের সময়ে তাদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের চরম নিষ্ঠুরতার ঘটনা দেশবাসী ভুলে যায়নি। করোনার সময় ফিরতে গিয়ে অসহায় ভাবে যাদের প্রাণ দিতে হয়েছে, অনিদ্রায় অনাহারে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে পড়তে হয়েছে, আব্রু বিসর্জন দিয়ে যাদের রাস্তায় সন্তানের জন্ম দিতে হয়েছে, যাদের মরদেহকে তাদের শিশুসন্তান ‘মা’ ‘মা’ বলে ব্যর্থ আর্তি জানিয়ে চলেছে একটু খাবারের জন্য, রেলের লাইনে যাদের ছেঁড়া শুকনো রুটি আর তাদেরই এক দলের ছিন্নভিন্ন দেহাংশ ছড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে– তাদের অসুবিধার কথা বলা বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের কৌশলী মিথ্যা ভাষণ ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে! এই যুক্তিটি আসলে বৃহৎ পুঁজিপতি এবং কর্পোরেট মালিকদের যুক্তির সঙ্গে একই সুরে উত্থাপিত। তারা এই অসুবিধাকে চিহ্নিত করেছে ‘পলিসি প্যারালাইসিস’ হিসাবে। এর পিছনে যে তাদের বিপুল মুনাফা অর্জনের প্রশ্নটি যুক্ত– এ কথা সকলেই সহজে বুঝতে পারবেন।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যাহত হবে

আসলে বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির আসল উদ্দেশ্যটি অন্যত্র নিহিত। তাঁরা ‘এক দেশ এক ভোট’ এর প্রশ্নটিই শুধু উত্থাপন করছেন তাই নয়, ‘এক দেশ এক ট্যাক্স, ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’, ‘এক দেশ এক সংস্কৃতি’ এবং সর্বোপরি ‘এক দেশ এক নেতা’ সহ আরও বহু বিষয় উত্থাপনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চূড়ান্ত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা সহজ কথায় দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার প্রবল প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। এর নিরিখে বিচার করতে হবে ‘এক দেশ এক ভোট’-এর বিষয়টিকে। প্রথমেই ভাবতে হবে, এই দেশ কি সত্যিই এক? দেশটি কি প্রধানত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত নয়? একদিকে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি, পুঁজিপতি, বড় বড় ব্যবসাদার, আর অপরদিকে গরিব কৃষক শ্রমিক নিম্নবিত্ত সহ কোটি কোটি জনসাধারণ। দু পক্ষের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী। ধনী গরিব বৈষম্য আজ চূড়ান্ত বাস্তব। শুধু এই বৈষম্যই নয়, আমাদের দেশ নানা ধর্ম, নানা বর্ণ, নানা সম্প্রদায়, নানা ভাষাভাষী জনসাধারণে বিভক্ত। অস্বীকার করা যায় না, দেশের নানা রাজ্যের মানুষের নানা ধরনের আঞ্চলিক সমস্যা, দাবি-দাওয়া, নানা ধরনের আচার-সংস্কৃতি বিদ্যমান। এগুলিকে ফরমান জারি করে এক রকম করা যায় না। এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য নিয়েই দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। এক দেশ এক ভোট ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আঘাত করবে।

এক দেশ-এক ট্যাক্স রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী করে তুলেছে

অন্য দিকে ‘এক দেশ এক ট্যাক্স’ (জিএসটি)-এর দ্বারা ট্যাক্সের কাঠামো সরলীকরণের নামে এই জিএসটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণের পথকেই প্রশস্ত করেছে। এটাই সকলের অভিজ্ঞতা। সকলেই জানেন, রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রের কতখানি মুখাপেক্ষী করেছে। ‘এক দেশ এক ট্যাক্সে’র দ্বারা রাজ্যগুলিকে ক্রমাগত আরও কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী বা নির্ভরশীল করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই আঘাত করা হচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলির বিশিষ্ট সদস্য শিববান লালা সাকসেনা সংবিধানের খসড়া তৈরির সময় ১৯৪৯ সালে বলেছিলেন যে, ‘আমাদের সংবিধানে সব নির্বাচনকে একসাথে করা হবে না– নানা রাজ্যে আস্থা ভোট সহ নানা কারণে বিভিন্ন সময় নির্বাচন করতে হবে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো তা হবে না।’ প্রসঙ্গত এ-ও উল্লেখ্য যে, বহুপূর্বে রাষ্ট্রপতি-প্রধান শাসনব্যবস্থার প্রশ্নটি উত্থাপিত হলেও তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের জন্য। তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন বিধানসভা এবং কেন্দ্রের নির্বাচন একসাথে করা সম্ভব নয়।’ অন্য আর এক বিশিষ্ট সদস্য আর কে সিদ্ধান্তও একই কথা বলেছেন। অথচ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং তার প্রধানমন্ত্রী এর সম্পূর্ণ বিপরীত কাজটি করতে উদ্যত হয়েছেন।

রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণ একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থেই

বাস্তবে দেশ জুড়ে বিজেপির একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের পথে বাধা হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে আঞ্চলিক এবং ছোট দলগুলি। আঞ্চলিক পুঁজিকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক দলগুলির অস্তিত্ব ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রীভবন ঘটানোর পথে অসুবিধা তৈরি করছে। এই অবস্থায় আঞ্চলিক দলগুলিকে নিশ্চিহ্ন করে একচেটিয়া পুঁজির অনুগত দুটি জাতীয় দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে বনেদি পুঁজিবাদী দেশগুলির মতো দ্বিদলীয় ব্যবস্থা কায়েম করাই এর উদ্দেশ্য।

বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভোট একসঙ্গে হলে, যেহেতু ভোটারদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক ভাবে অসচেতন, ভোটারদের লোকসভা ও বিধানসভায় একই দলকে ভোট দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। আবার ভোট একসঙ্গে হলে, প্রার্থীর নাম, জাতপাত, স্থানীয় বা জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি সবকিছুকে ছাপিয়ে মূলত রাজনৈতিক দলের চিহ্ন দেখে ভোট দিতে দেখা যায়।

একসঙ্গে ভোট হলে, ভোটের দিনের আগেই, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রচারের সময় মানুষ ঠিক করে ফেলেন কোন দলকে ভোট দেবেন। আলাদা সময়ে ভোট হলে ভোটাররা দলের চিহ্ন ছাড়াও আরও অনেক কিছু দেখে ভোট দিতে পারেন। আবার একই দলকে ভোট দিতে হলে কোনও সর্বভারতীয় দলকেই দিতে হবে, যেহেতু লোকসভায় আঞ্চলিক দলগুলি তত প্রাসঙ্গিক নয়, এই নিরিখে সর্বভারতীয় দলগুলিই এগিয়ে থাকবে এবং যে সর্বভারতীয় দল প্রচারে আর্থিক জোর এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ে এগিয়ে আছে, সেই দলই লাভবান হবে। এ ক্ষেত্রে বিজেপিই হল সেই দল। তাই একসঙ্গে ভোট করতে বিজেপির এত তৎপরতা। এ দেশে নির্বাচনের ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী দুটি দল বা দুটি জোটকে একদিকে আর্থিক অনুদান দিয়ে এবং অন্যদিকে এমনভাবে প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে, যার ফলে নির্বাচনের চূড়ান্ত মেরুকরণ ঘটছে। জনসাধারণের কাছে তৃতীয় কোনও বিকল্প থাকছে না। ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থার দ্বারা এদেশের শাসক শ্রেণি এবং তাদের স্বার্থরক্ষাকারী এই দল বা জোট বিপ্লবী দল ও অন্যান্য ছোট দলগুলির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পথকেও বন্ধ করার চেষ্টা করবে।

একসময় সামন্ততন্ত্রের অবসানে শিল্পবিপ্লবের প্রথম যুগ, যাকে পুঁজিবাদের বিকাশের যুগ বলা হয়, সেই সময় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরিকাঠামো হিসেবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে এবং তারই একটা স্তরে এসে একচেটিয়া পুঁজির জন্ম হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের জন্ম হয়েছে। তার প্রতিফলন হিসাবে রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকার খর্ব করার দ্বারা ফ্যাসিবাদের লক্ষণগুলি ক্রমাগত প্রকট হয়ে উঠছে। আমাদের দেশেও একইভাবে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দল মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে পুঁজিবাদের বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু ও মরণোন্মুখ যুগে ফ্যাসিবাদের এই লক্ষণগুলিকে বহু আগেই দেখিয়েছে। এরই ফলে দেশের মধ্যে বহুদলীয় গণতন্ত্রের উপর তারা আঘাত হানছে। ফলে, একত্রে নির্বাচন করার দ্বারা সেই সমস্ত পদক্ষেপগুলিকে আরও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছে বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার। ‘ডবল ইঞ্জিনে’র সরকার গড়বার স্লোগানও তারই পরিপূরক। কেন্দ্রের রাজ্যে একই দল বা জোটের সরকার হলে উন্নয়নের ধারা চলবে প্রবল গতিতে– এই প্রচারের দ্বারা জনমতকে বিভ্রান্ত করতে তারা উঠেপড়ে লেগেছে। আর যত প্রচার হচ্ছে তত দেখা যাচ্ছে ডবল ইঞ্জিনের তলায় পিষ্ট হচ্ছে আপামর জনসাধারণ। যদিও রাজ্যের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত অন্য দলগুলিও পুরসভা বা পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় একই দলের সদস্যদের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার কথা বলে। এ রাজ্যে অতীতে নির্বাচনে সিপিআইএম সেই প্রচারই করত। বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসও সেই প্রক্রিয়াই গ্রহণ করছে। ফলে পুরো প্রচেষ্টাটাই এদেশের বুকে ফ্যাসিবাদকে পাকাপোক্ত করবার উদ্দেশ্য নিয়ে। সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ গভীর প্রজ্ঞায় দেখিয়েছেন, বর্তমান যুগে উন্নত বা অনুন্নত সকল পুঁজিবাদী দেশেই পুঁজিবাদ তার শাসন শোষণকে দীর্ঘায়িত করার জন্য, এমন কি সংসদীয় রাস্তা বজায় রেখেই ফ্যাসিবাদের পথ নেবে। ফ্যাসিবাদের সুস্পষ্ট তিনটি লক্ষণকে তিনি পরিষ্কার করে দেখিয়েছিলেন, একদিকে যেমন সে অর্থনীতির চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ করে, অন্যদিকে প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একের পর এক পদক্ষেপ নেয়। এরই পাশাপাশি ফ্যাসিবাদ, বিজ্ঞানের কারিগরি দিকের সাথে অধ্যাত্মবাদের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এবং অন্ধ ধর্মীয় গোঁড়ামির দ্বারা মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতাকে ধ্বংস করে ‘মানুষ’ গড়ে তোলার প্রক্রিয়াতেই বাধার সৃষ্টি করে।

এক দেশ এক ভোট ফ্যাসিবাদের পথ প্রশস্ত করবে

ধর্মীয় অন্ধতাকে ভিত্তি করে ‘এক দেশ’-এর স্লোগান তুলে দেশের সাধারণ মানুষের দেশের প্রতি ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিবাদের পথকে সুদৃঢ় করতে বদ্ধপরিকর তারা। দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এই প্রচেষ্টা। কংগ্রেস শাসনেও সেই প্রচেষ্টা ছিল। বিজেপি সেই প্রচেষ্টাকে ব্যাপক রূপ দিতে চলেছে। সঙ্গে ‘এক দেশ এক নেতা’র স্লোগান। হিটলার-মুসোলিনির মতো সর্বশক্তিমান এক নেতার প্রতি মানুষের আবেগ ও বিশ্বাসকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা ফ্যাসিবাদের আরেকটি লক্ষণ। একসময় ইন্দিরা গান্ধীকে ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’ করে সেই প্রচেষ্টা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা বেশি দূর এগোয়নি। বর্তমানে বিজেপি নরেন্দ্র মোদিকে সামনে আনবার চেষ্টায় লিপ্ত। তাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হিসেবে তুলে ধরার কৌশলও গ্রহণ করেছে বিজেপি। সেই উদ্দেশ্য থেকেই একদিকে দেশ জুড়ে উগ্র হিন্দুত্বের উন্মাদনা গড়ে তোলা, এক সংস্কৃতির নামে তাকে সম্ভব করার প্রচেষ্টা এবং ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো।

‘এক দেশ এক ভোট’ এই প্রচেষ্টা শুধুমাত্র একটা আইন বা বিধি নয়। এর পেছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র। ফ্যাসিবাদকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করবার এই চক্রান্ত বা কৌশলকে পরাস্ত করতে হবে। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে যথার্থ শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই অপকৌশলের স্বরূপকে মানুষের সামনে উদঘাটিত করতে হবে। মানব সভ্যতার ঘৃণ্যশত্রু ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করার যে প্রচেষ্টা বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার ‘এক দেশ এক ভোট’ স্লোগানের মাধ্যমে করতে চাইছে তাকে প্রতিহত করা সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষের একটি অবশ্যপ্রয়োজনীয় দায়িত্ব।