এই রাত স্মরণে থাকবে আমাদের, এই রাতকে মনে রাখবে গণআন্দোলনের ইতিহাস। আজথেকে বহু বছর পরে কোনও বর্ষীয়ান মানুষ ২০২৪ এর এই রাতকে মনে করে গভীর আবেগে শিহরিত হবেন, নাতি-নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে পরম তৃপ্তিতে বলবেন, ‘জানো তো, সেই রাতে আমরা সবাই মিলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলাম।’
মনে পড়ে যায় ডিকেন্স এর উপন্যাসের বিখ্যাত লাইন– ‘ইট ওয়াজ দ্যা বেস্ট অফ টাইমস, ইট ওয়াজ দ্যা ওয়ার্স্ট অফ টাইমস’। সত্যিই এক দিক থেকে এ এক ভয়ংকর দুঃসময়– যখন শহর কলকাতার বুকে অন্যতম প্রধান সরকারি হাসপাতালের মধ্যেই কর্তব্যরত অবস্থায় পাশবিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন চিকিৎসক তরুণী। অন্য দিকে, এ এক উজ্জ্বল সুসময়– যখন বহুদিনের স্থবিরতা, জড়ত্ব, আত্মকেন্দ্রিকতার ঘেরাটোপ ভেঙে মানুষ হাত রাখে পাশের মানুষের হাতে, অন্যের যন্ত্রণা নিজের বুকে বহন করে শাসকের বিরুদ্ধে এমন করে সোচ্চার হয় গোটা সমাজ।
এক উজ্জ্বল, মেধাবী, সম্ভাবনাময় সেই মেয়ে, প্রতিদিনের মতোই সেদিনও মা-বাবার স্নেহে ঘেরা গৃহকোণ থেকে বেরিয়ে এসেছিল তার প্রিয় প্রতিষ্ঠানে, যেখানে দিনের পর দিন সে পীড়িত মানুষের চিকিৎসা করেছে, মানুষকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে সুস্থ নীরোগ জীবন। সেই পরম নির্ভরতার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালেই তার জীবনের এমন মর্মান্তিক পরিসমাপ্তি ঘটল! এই ঘটনা আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজের গালে চড় মেরে দেখিয়ে দিয়ে গেল, কোন বিষাক্ত নরকে আমরা বাস করছি! আবার একই সঙ্গে এই মৃত্যু আমাদের ঘুমিয়ে পড়া মনকে, চেতনাকে যেন চাবুকের ঘায়ে জাগিয়ে দিল। নিজেদের অপদার্থতা এবং দায় আড়াল করতে ঘটনার পরপরই আর জি কর-এর অধ্যক্ষ বলেছিলেন, রাতে একা চলাফেরা করা ওই মেয়েটির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। এই নির্লজ্জ মন্তব্যের প্রতিবাদে শহর জুড়ে মেয়েরা গর্জে উঠলেন, চলো রাত দখল করি, দলে দলে জোট বেঁধে ছড়িয়ে পড়ি গলি থেকে রাজপথ, সোচ্চারে ধিক্কার জানাই এই জঘন্য মন্তব্যকে, ধিক্কার জানাই পুলিশ-প্রশাসনের অপদার্থতাকে, ধিক্কার জানাই সেই সব নেতা-মন্ত্রীদের, ক্ষমতার গদিতে বসে যারা আড়াল করছেন খুনি ধর্ষকদের, জনগণের ভোটে জিতে রক্ষক এর বদলে হয়ে উঠছেন ভক্ষক। ডাক এলো– এসো ফিরিয়ে আনি অধিকার, দখল করি রাত। ১৪ আগস্ট এর রাত জ্বলে উঠল হাজার সূর্যের আলো নিয়ে। সত্তরের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েরা রাতের শহরে মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যার বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন ‘রিক্লেম দ্য নাইট’ আন্দোলন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাতাত্তর বছর পেরিয়ে ১৪ আগস্টের রাত নতুন করে ইতিহাস তৈরি করল। প্রথমে যে উদ্যোগ সীমাবদ্ধ ছিল কলকাতার তিন চারটি স্থানে, দ্রুত তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। ২০০-২৫০টি আলাদা আলাদা জায়গায় নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে রাত দখলের কর্মসূচি নিয়েছেন সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলায় ছিল এই গণউদ্যোগ। কলকাতার বাইরে শহরতলি-মফস্সলেও মানুষ সামিল হয়েছেন এমন একাধিক উদ্যোগে। দমদম থেকে যাদবপুর, শ্যামবাজার থেকে বেহালা, বারাসাত থেকে কলেজ স্ট্রিট, রাতের আকাশ কাঁপিয়ে আওয়াজ উঠেছে, ‘আমার বোনের বিচার চাই, ধর্ষক-খুনির শাস্তি চাই, মহিলাদের নিরাপত্তা চাই।’ শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে বছর দুয়েকের শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এক মা। ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা। মাইক হাতে নিয়ে ধরা গলায় বললেন, ‘আজ যদি প্রতিবাদ না করি, নিজের চোখেই ছোট হয়ে যাব। এসেছি ওই চলে যাওয়া মেয়েটার জন্য, এসেছি নিজের সন্তানের জন্য।’ এক মধ্যবয়স্কা নার্স ফেটে পড়লেন রাগে, ‘আমি নিজের পেশাকে ভালোবাসি, সম্মান করি। এমন বর্বরতা কেন ঘটবে সভ্য সমাজে? আমরা বারবার এ ভাবেই প্রতিবাদ করব। যে দল, যে সরকারই এমন কাণ্ড ঘটাক তার বিরুদ্ধে বলব।’ মধ্য কলকাতার এক কলেজ ছাত্রী যেতে চাইছিলেন এই জমায়েতে, কিন্তু মা-বাবার অনুমতি চাওয়ার সাহস হচ্ছিল না তার। তাকে অবাক করে দিয়ে মা বলেছেন, ‘আজ রাতের জমায়েতে তোর সাথে আমিও যাব। আজ ঘরে বসে থাকলে তোকেও রক্ষা করতে পারব না।’ এমন করেই যাবতীয় সংকোচ-ভয়-দ্বিধা কাটিয়ে সেদিন প্রথম পথে নামলেন নানা বয়সের অসংখ্য মহিলা-পুরুষ, প্রথম মুষ্টিবদ্ধ হাত তুললেন আকাশে। পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে ছড়িয়ে গেল পথে নামার আহ্বান। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদের এক অপূর্ব রাত দেখল এই শহর, এই রাজ্য– যেখানে বছর চারেকের ছোট্ট মেয়ে অক্লান্ত হাঁটতে হাঁটতে কচি গলায় স্লোগান তুলল– ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। বয়সের ভারে ন্যুব্জবৃদ্ধা ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটলেন, কোথাও অসুস্থ মহিলা হাঁটলেন ক্রাচ, ওয়াকার নিয়ে।
সমগ্র নারীসমাজের পাশাপাশি অপমানিত অবমানিত সকল মানুষের, সবলের অত্যাচারে উৎপীড়িত দুর্বলের দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ অপমান-অসম্মান-বঞ্চনা এই রাতে বাঁধভাঙা জলের মতো নেমে এসেছে রাস্তায়। উঠে এসেছে স্বপ্নদ্বীপের নাম, কিছুদিন আগেই যে কিশোর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে ভয়াবহ র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। শুধু নারীদের আন্দোলন হিসেবেই যা শুরু হয়েছিল, স্বাভাবিক ভাবেই তার অংশ হতে চেয়েছেন, পা মিলিয়েছেন অসংখ্য পুরুষ, যারা সুস্থ-সুন্দর সমাজ চান, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে যারা মহিলাদের সম্পত্তি হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে, সহনাগরিক হিসেবে দেখতে চান। যে কোনও ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন যে ভাবে চরিত্র, মূল্যবোধ তৈরি করে এ রাতও তার স্বাক্ষর দেখেছে মানুষের হাঁটায়, কথায়, প্রত্যয়ে। বাংলাদেশের আন্দোলনকারী ছাত্ররা স্বৈরাচার বিরোধী লড়াইয়ে নেমে শেখ হাসিনার নামাঙ্কিত হলের নাম পাল্টে বিপ্লবীদের নামে রেখেছেন শান্তি-সুনীতি হল, প্রীতিলতা হল, ইলা মিত্র হল। আর কলকাতার এই আন্দোলন থেকে স্লোগান উঠেছে, ‘মাতঙ্গিনী, প্রীতিলতার কসম খেয়ে বলছি ভাই– মধ্যরাতে রাস্তা দখল, স্বাধীনতার দখল চাই।’ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ ভাবেই মিলে গেছে দুই বাংলার প্রতিবাদী কণ্ঠ।
বিপুল আবেগ এবং স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়েই মানুষ এই রাত দখলের আন্দোলনে পা মিলিয়েছেন কোনও দলীয় রাজনীতির পতাকা ছাড়াই। কিন্তু একে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সঠিক রাজনৈতিক চেতনা যে দরকার, সে কথাও উঠে এসেছে আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকেই। এক মহিলা সাংবাদিকের উপলব্ধি– ‘এই আন্দোলন কখনওই অরাজনৈতিক নয়, আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব রাজনৈতিক মত আছে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে কেউ যেন নিজেদের দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণ স্বার্থে এই আন্দোলনকে ব্যবহার না করতে পারে।’ এই খেয়াল রাখতে পারা এবং আন্দোলনকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক চেতনার প্রশ্নটি জরুরি। আর জি করের বিচার চাওয়ার সময় আমাদের যেন মনে থাকে ওই কলেজেরই ছাত্র সৌমিত্র বিশ্বাসের কথা।
২০০১-এ তৎকালীন শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ‘সেক্স ব়্যাকেট’ সহ নানা চক্র ধরে ফেলায় যাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিলহোস্টেলের মধ্যেই। মনে রাখতে হবে স্কুলশিক্ষক বরুণ বিশ্বাসের কথা, সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীদের ভয়াবহ অত্যাচার প্রতিরোধে যিনি সুটিয়ায় গড়ে তুলেছিলেন ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ, প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকেও। যেন মনে থাকে কাঠুয়া, হাথরস, কামদুনি, পার্ক স্ট্রিট, দিল্লি, হায়দ্রাবাদের ধর্ষিতাদের কথা। যেন মনে থাকে, দেশ জুড়ে প্রত্যেক পনেরো মিনিটে একজন করে যে নারীরা ধর্ষিতা হয়ে চলেছেন, তাঁদের চোখের জলের কথা। এই আন্দোলন চলতে চলতেই উত্তরাখণ্ডে ডিউটি সেরে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষিত হয়ে খুন হলেন এক তরুণী নার্স। আর জি করের মতো মেয়েদের মরণফাঁদ ছড়িয়ে আছে সারা দেশেই। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় বসে বড় বড় সংসদীয় দলগুলো ধর্ষকদের অপরাধীদের আড়াল করেছে। নেতা-মন্ত্রীরা নির্যাতিতাদের সম্বন্ধে অসংবেদনশীল মন্তব্য করেছেন। এই সব দলের হাত মাথায় থাকায় জঘন্য অপরাধ করেও ছাড়া পেয়ে গেছে কত দুষ্কৃতী। কাজেই আজ তারা মুখে যতই বড় বড় প্রতিবাদের কথা বলুক, মানুষ জানে, কোনওদিন এই গণজাগরণের যথার্থ অংশীদার তারা হতে পারেন না। কিন্তু জানাটুকুই যথেষ্ট নয়।
এ লড়াই যাদের বিরুদ্ধে, তাদের পরিচয় একটাই– তারা শাসক। মনে রাখতে হবে তারা কিন্তু সংঘবদ্ধ। নানা দলের পতাকা নিয়ে নানা রঙের উর্দি পরে সাধারণ মানুষের ঐক্যকে তারা ভাঙতে চাইবে, আন্দোলনকে বিপথগামী করতে চাইবে। এক দিকে ক্ষমতায় বসার জন্য সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দেবে, অন্য দিকে মদের ঢালাও লাইসেন্স দিয়ে, পর্ন-সাইট খুলে দিয়ে সমাজবিরোধী ধর্ষক তৈরিও করবে মানুষকে মেরুদণ্ডহীন অমানুষ করে রাখার জন্য। ক্ষমতার রাজনীতির এই দুষ্টচক্রকে শুধুমাত্র স্বতঃস্ফূর্ততা দিয়ে শেষ পর্যন্ত আটকানো যাবে না, চাই সংগঠিত প্রতিরোধ। রাত দখলের আন্দোলন ডাক দিয়েছে, ‘ঘুমিয়ে বন্ধু পাবে না কখনও জাগবার অনুভূতি, আজকে রাতের এই জাগরণ আগামীর প্রস্তুতি।’ ১৪ আগস্ট রাতের কলকাতা প্রতিবাদের যে অপূর্ব নজির তৈরি করল, তাকে রক্ষা করার, এ অসুস্থ সমাজের বদলে নতুন সমাজ আনার লড়াইতে পরিণত করার দায় এবং দায়িত্ব আমাদের সকলের।