দরবার বসছে৷ ডিএম, এসডিও, বিডিও সহ জেলা প্রশাসনের নানা স্তরের কর্তাব্যক্তিরা হাজির৷ হাজির জেলার বিধায়করা, জেলাপরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতির কর্তারা– এমনই আরও অনেকে৷ সভার মধ্যমণি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং৷ তিনি খোঁজখবর নিচ্ছেন– কোন এলাকায় কতখানি উন্নয়ন হয়েছে, কতখানি ঘাটতি, কেন ঘাটতি, ইত্যাদি ইত্যাদি৷
মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং জেলায় দরবার বসিয়ে উন্নয়নের হাল–হকিকতের তত্ত্বতল্লাশ করছেন! এ কি সোজা কথা! উন্নয়নের প্রতি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কী গভীর কমিটমেন্ট বৈদ্যুতিন প্রচারমাধ্যমগুলোর ক্যামেরা পুরো ঘটনাবলী গিলছে এবং টিভির পর্দায় উগরে দিচ্ছে ‘লাইভ টেলিকাস্ট’৷ জেলাবাসী তথা রাজ্যবাসী তা প্রত্যক্ষ করছেন৷
সদ্য ২৭ ফেব্রুয়ারি উত্তর ২৪ পরগণার জেলা সদর বারাসতের রবীন্দ্রভবনে অনুষ্ঠিত জেলা দরবারেও রাস্তা, স্টেডিয়াম, জলসরবরাহ কেন্দ্র, ব্রিজ সহ উন্নয়নের কত কথাই না হল৷ কিন্তু যেই না জেলা দরবার শেষ হল, অমনি দরবারের বিস্তর ফাঁকি ধরা পড়ে গেল একেবারে আমজনতার দরবারে৷
সংবাদে প্রকাশ, বারাসতের বিধায়ক চিরঞ্জিত চক্রবর্তী ঐ সভায় মুখ্যমন্ত্রীকে তুষ্ট করতে ফ্রান্সের রানির বিলাসিতা এবং তাঁর রুটি–কেক সংক্রান্ত গল্পটি সকলকে শোনাবার পর পরিশেষে বললেন, ‘‘এ রাজ্যের ‘রানি’ কুঁড়ে ঘরে থেকেও সকলের হাঁড়ির খবর রাখেন’’৷ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে খুশি করবার পক্ষে মন্দ নয়৷ কিন্তু দরবার শেষে চিরঞ্জিতবাবু যেই রবীন্দ্রভবন থেকে বের হলেন, অমনি সংলগ্ন ইন্দিরা কলোনির মানুষজন তাঁকে ঘিরে ধরে যে সব প্রশ্ন তুললেন, তাতে জেলা প্রশাসনের ফোলানো বেলুনটি একেবারে চুপসে গেল৷ চিরঞ্জিতবাবুর হাসি–হাসি মুখটাও কেমন ফ্যাকাসে লাগল নিজের এলাকার বাসিন্দাদের প্রশ্নের সামনে৷
কলোনির মানুষজন তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘রুটি–কেকের কথা তো অনেক শোনালেন৷ আমাদের ঘরে সামান্য বৃষ্টিতেই যে জল জমছে, সে কথাটা কি বলতে ভুলে গেলেন?’ ‘স্টেডিয়াম, আর্ট গ্যালারি নিয়ে না বলে শৌচালয় নিয়ে ভোগান্তির কথাটা তো দিদির কানে তুলতে পারতেন৷’ অভিনেতা–কাম–বিধায়ক চিরঞ্জিতবাবু কোনওক্রমে কলোনিবাসীদের এড়িয়ে গাড়িতে উঠে দ্রুত প্রস্থান করলেন৷
উন্নয়নের রহস্য এখানেই– ঠাটবাট, চাকচিক্য, জৌলুস উপর উপর– ভিতরে নয়৷ হাসপাতালের বিশাল অট্টালিকা, কিন্তু ভাল চিকিৎসা নেই, প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার–নার্স নেই৷ ঘটি–বাটি বেচে মানুষকে বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ছুটতে হয় সে ক্ষমতা না থাকলে সরকারি হাসপাতালের দরজায় মাথা ঠোকো, নয়ত জলপড়া তেলপড়ার আশ্রয় নাও৷ হাসপাতালে দামি দামি মেসিন বসছে রোগীদের পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য ঘটা করে তার উদ্বোধনও হয়৷ কিন্তু সেগুলি চালাবার লোক নেই৷ অতএব বাইরে কোনও বেসরকারি ডায়াগনাস্টিক সেন্টারে রোগীকে ছুটতে হয়৷ আর কোথাও বা এক–দুটি মেসিন চালু থাকে, আর বিরাট সংখ্যক রোগীর জন্য ছ’মাস এক বছর পর পরীক্ষা করবার দিন পড়ে৷ ততদিন যদি রোগীরা বেঁচে থাকে তো তাহলেই হাসপাতালে পরীক্ষা হবে৷ স্কুল–কলেজেরও বাড়ি পেল্লাই৷ কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই৷ শিক্ষার মান ক্রমাগত নিম্নমুখী৷ কেবল ফি গুণে দিয়ে বোর্ড কাডন্সিল বা ইডনিভার্সিটির খাতায় নামটা তুলে রাখার জন্যই যেন স্কুল–কলেজের প্রয়োজনীয়তা৷
প্রাণহীন জৌলুসের পিছনে যাঁরা ছুটবেন এবং সেটাকেই উন্নয়ন বলে দেখাতে চাইবেন, তাঁদের কাছে স্টেডিয়াম, আর্ট গ্যালারি, ব্রিজ ইত্যাদির কদর অনেক বেশি৷ গরিব মানুষের ঘরে জল ঢুকে ভাসিয়ে দেয় কি না, তাদের শৌচালয়ের বেহাল দশায় তারা কতটা বিপন্ন, কিংবা তাদের আর পাঁচটা সঙ্কট–যন্ত্রণা কী এবং সেগুলির সমাধান কীভাবে করা যায়– ইত্যাদি নিয়ে ভাববার সময় তাঁদের কোথায় ভোটের সময়ের গালভরা প্রতিশ্রুতি মন্ত্রী–এমএলএদের ওসব অনেক দিতে হয়, যেমনটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরাও দেন৷ কিন্তু পরে সেগুলি পূরণ করার দাবি এলে মোদিজির লেফটেন্যান্ট অমিত শাহ জানিয়ে দেন– ও সব তো ‘জুমলা হ্যায়’ ভাই, অর্থাৎ ওসব ভোটের আগে তো বলতেই হয় ভাই৷ চিরঞ্জিতবাবুরা অবশ্য এখনও সে কথাটি উচ্চারণ করে বলেননি বটে, কিন্তু নিজেদের আচরণ দিয়ে যা বোঝানোর তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন৷