কৃষক আন্দোলনের জোয়ারে কাঁপছে গোটা ইউরোপ। ব্রিটেন, পোল্যান্ড থেকে স্পেন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড থেকে রোমানিয়া, গ্রিস, বেলজিয়াম সর্বত্র হাজার হাজার কৃষক পথে নেমেছেন। ট্রাক্টর মিছিল করে তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন রাজধানীর দিকে। প্যারিস, ব্রাসেলসের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে ঢোকার রাস্তা অবরোধ করছে অসংখ্য ট্রাক্টর। রাষ্ট্রীয় ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে যাচ্ছে অন্নদাতাদের ট্রাক্টরের আঘাতে। গত কয়েক মাসে আন্দোলনের তীব্রতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলি পিছু হটতে শুরু করেছে। ফরাসি, গ্রিক, স্প্যানিশ সরকার বাধ্য হয়েছে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে। ইউরোপের শাসকশ্রেণিকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে কৃষক আন্দোলনের জোয়ার। ফ্রান্স সরকার বদ্ধপরিকর ছিল ডিজেল ট্যাক্স বাড়ানোর বিষয়ে। আন্দোলনের জোয়ারে সেই সিদ্ধান্তও প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ইউরোপের চলমান কৃষক আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছে অনেকগুলি কারণ। তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। কৃষকরা দাবি করছেন, সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের এলাকা দখলের লড়াই তাঁদের পেটে লাথি মারছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি কুফল যেমন এই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম কারণ, তেমনই জলবায়ু বিপর্যয় ঠেকানোর নামে নানা সরকারি বিধিনিষেধও কৃষকদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কৃষকরা কৃষি থেকে লাভ করতে পারছেন না। তাঁরা এর জন্য দায়ী করছেন তাঁদের দেশের ক্ষমতাসীন সরকারগুলি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে।
ইউরোপের সার্বিক পরিস্থিতি মোটেই সুবিধার নয়। ২০২৩ সালে খাবারের ক্রয়মূল্য বেড়েছে ৭.৫ শতাংশ, কিন্তু কৃষকরা যে দামে ফসল বিক্রি করেন তা কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ। অর্থাৎ পরিস্থিতি একদমই ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার মতো। সেই সঙ্গে সুদের হার বেড়েছে অনেকখানি। তার ফলে কৃষিঋণ পরিশোধ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে কৃষকদের জন্য। ভর্তুকির ৮০ শতাংশ এমনিতেই যায় ২০ শতাংশ সবচেয়ে ধনী কৃষকের কাছে। ফলে সবথেকে বেশি সংকটে পড়ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকরা। রাজপথে নেমে আসা ছাড়া তাঁদের অন্য উপায় নেই।
কৃষিসংক্রান্ত ভর্তুকি পাওয়ার বিষয়টিও জটিলতর হয়ে উঠছে। ভর্তুকি পাওয়ার জন্য দেখাতে হয় যে কৃষিপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের বেঁধে দেওয়া নানা রকম বিধিনিষেধ ঠিক ভাবে মানা হচ্ছে। এই সমস্ত বিধিনিষেধ, যেমন কীটনাশক বা রাসায়নিক সার ব্যবহার না করা বা খুব সীমিত পরিমাণে করা– মানার ফলে একদিকে কমছে কৃষকদের আয়, অন্য দিকে বিধিনিষেধ না মানতে পারা বা কাগজপত্রে সে সব যথাযথভাবে দেখাতে না পারার ফলে ভর্তুকি পাওয়ার প্রক্রিয়াটি কঠিন হয়ে পড়ছে। ইউরোপের অনেক জায়গাতেই সরকারি কাজে বিপুল পরিমাণ কাগজপত্র লাগে, প্রচুর ফর্ম দাখিলের ব্যাপার থাকে এবং কাজও হয় ঢিমে তালে– বিশেষত দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতে। কাজে অনেক সময় হিসাবরক্ষক বা উকিলের পরামর্শ লাগে। ভর্তুকি এবং করছাড় তুলে নেওয়ার ফলে ডিজেলের দাম বেড়েছে, যে কারণে জার্মানি ও ফ্রান্সের কৃষকরা প্রবল অসন্তুষ্ট। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের গ্রিন ডিল তাদের পক্ষে খুবই অলাভজনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ইউক্রেনে সাম্রাজ্যবাদীদের দুই শিবিরের যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন থেকে উৎপাদিত সামগ্রী আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক তুলে দেওয়া হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিধিনিষেধ না মানা ইউক্রেনের সস্তার খাদ্যদ্রব্যে (বিশেষত রুটিজাতীয়) ইউরোপের বাজার ছয়লাপ, যার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ইউরোপের কৃষকরা এঁটে উঠতে পারছেন না। কারণ বিধিনিষেধ মেনে এত সস্তায় উৎপাদন তাঁদের পক্ষে সম্ভব না। কৃষকদের দাবি, ইউক্রেনের সস্তা খাদ্যদ্রব্য আমদানির ফলে শুধু ২০২৩-এই খাদ্যপণ্যের মূল্য পড়েছে প্রায় চল্লিশ শতাংশ।
পোল্যান্ডের কৃষকরা চাইছিলেন আমদানি রোখার জন্য ইউক্রেনের সঙ্গে পোল্যান্ডের সীমান্ত আটকে দিতে। তাঁদের আন্দোলনের মুখে পড়ে সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইউক্রেন থেকে আমদানির ঊর্ধ্বসীমা কমাতে বাধ্য হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ শহরের পাশাপাশি বন্দরগুলিও অবরোধ করা হচ্ছে। বেলজিয়ামের কৃষকরা সম্প্রতি ডাচ সীমান্ত আটকে দিয়েছিলেন। পোলিশ কৃষকরা ৩০ ঘণ্টা অবরোধ করেছিলেন ইউক্রেনের সীমান্ত। বিক্ষোভ আছড়ে পড়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের বাইরেও। অজস্র ট্রাক্টরের ব্যারিকেড ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ঘিরে ফেলেছিল। কৃষকরা টায়ার জ্বালিয়ে পথ অবরোধ করেন। বহু মূর্তি ভেঙে ফেলেন। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের দিকে পাথর ও ডিম বৃষ্টি হয়।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই আন্দোলনের নিশানায় আছে বড় বড় কর্পোরেট সুপারমার্কেট এবং হোলসেল একচেটিয়া ব্যবসায়িক চক্রও। বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সে সুপারমার্কেটের বাইরে প্রবল বিক্ষোভ হয়েছে। প্যারিসের ৫৭০ একরের একটি হোলসেল মার্কেট ঘেরাও করে রেখেছিলেন কৃষকরা। স্পেনের কাটালুনিয়ার কৃষকরা বার্সেলোনায় ইউরোপের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট হোলসেল মার্কেট অবরোধ করেছেন।
কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ আন্দোলন তাঁদের ‘রক্ষণশীল’ এবং ধনী নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফরাসি কৃষক সংগঠন এফএনএসইএ-র ধনকুবের নেতারা আতঙ্কিত হয়ে আর্তনাদ করেছেন, ‘আমরা কৃষকদের শান্ত হতে বলছি। বিবেচকের মতো আচরণ করার পরামর্শ দিচ্ছি। কিন্তু তাঁরা সে কথা কানে তুলছেন না।’ ইউরোপের সর্বত্র রাষ্ট্রযন্ত্রেরও কার্যত পা কাঁপছে। কৃষক বিদ্রোহ ঠেকাতে ১৫ হাজার পুলিশ মোতায়েন করেছিল ফরাসি সরকার। তার প্রেক্ষিতে ফ্রান্সের পুলিশ ইউনিয়ন সরকারকে জানিয়েছে, গায়ের জোরে কৃষক আন্দোলন দমন করতে গেলে সমাজের অন্য অংশগুলিকেও আন্দোলনে টেনে আনা হবে। তার ফলে সৃষ্টি হবে বিস্ফোরক পরিস্থিতি। গোটা ব্যবস্থাই বিকল হয়ে পড়বে।
এই গোটা আন্দোলনের সুফল তোলার চেষ্টা করছেন অতি দক্ষিণপন্থীরা। কিন্তু জার্মানির অল্টারনেটিভ ফর জার্মানির মতো অতি দক্ষিণপন্থী দলের নীতিও কৃষকদের পক্ষে নয়। ফলে এই আন্দোলন অমিত সম্ভাবনাময়। এখনও পর্যন্ত কোনও নির্দিষ্ট মতাদর্শের রাজনৈতিক শক্তি কৃষক আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। বিপ্লবী কমিউনিস্ট শক্তি বা বামপন্থী প্রগতিশীলরা চেষ্টা করছেন সর্বতোভাবে এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে। তাঁদের সেই চেষ্টা কতখানি সফল হয় তার উপরে বহু কিছু নির্ভর করছে।
তবে দুটি কথা অত্যন্ত স্পষ্টঃ প্রথমত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দেশে দেশে বুর্জোয়া সরকারগুলির ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছেন কৃষকরা, দ্বিতীয়ত, আন্দোলনের ময়দানে সক্রিয়ভাবে থেকেই কমিউনিস্টরা অতি দক্ষিণপন্থীদের প্রতিহত করতে পারবেন। আন্দোলনের ময়দান থেকে দূরে বসে কেবলমাত্র বিচার বিশ্লেষণ করলে দক্ষিণপন্থীদের খোলা মাঠ ছেড়ে দেওয়া হবে। নেদারল্যান্ড বা জার্মানিতে কৃষকরা জনসংখ্যার ১ শতাংশ, ফ্রান্সে ২.৫ শতাংশ। তা সত্ত্বেও তাঁদের ট্রাক্টর মিছিলের সামনে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে এ সব দেশের সরকার। এর থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণির। কৃষকরা দেখাচ্ছেন আন্দোলন যদি গণসমর্থনে গতিবেগ পায় এবং ছকে বাঁধা পথ পরিত্যাগের সাহস দেখায়, তা হলে বহু কিছুই ঘটা সম্ভব।