আশার আলো ক্রমশ কমে আসছে। এই প্রতিবেদন তৈরি হওয়ার সময় পর্যন্ত কেটে গেছে ন’টা দিন, উত্তরাখণ্ডের সিল্কিয়ারার কাছে নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গ ধসে আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিককে উদ্ধার করা যায়নি। ধ্বংসস্তূপে পাইপ ঢুকিয়ে তার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের বের করে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু কাজ শুরু হতেই সুড়ঙ্গের ভিতরে আরেকটি বড়সড় ধস নামায় দুর্ঘটনার ছ’দিনের মাথায় সেই প্রচেষ্টায় ক্ষান্ত দিতে হয়েছে উদ্ধারকারী বাহিনীকে। ধসে পড়া সুড়ঙ্গের অন্ধকারে পাইপ দিয়ে পাঠানো অক্সিজেন ও সামান্য খাদ্য-পানীয় সম্বল করে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন ৪১ জন অসহায় শ্রমিক। আর ধ্বংসস্তূপের বাইরে ভিড় করে থাকা পরিজনদের আশঙ্কা-উদ্বেগ দিনে দিনে সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
উত্তরাখণ্ডে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত চারধাম হাইওয়ে প্রকল্পের অংশ হিসাবে তৈরি হচ্ছিল এই সুড়ঙ্গটি। দুর্ঘটনার পর থেকে সুড়ঙ্গের সামনে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাদের ভিড়, বৈঠকের পর বৈঠক, নতুন নতুন পরিকল্পনা, সেনার উপস্থিতি সত্ত্বেও উদ্ধারকার্যের বেহাল দশা থেকে এ কথা পরিষ্কার যে, কাজ চলার সময়ে দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকদের জীবন রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তার কোনও আগাম পরিকল্পনাই কর্তৃপক্ষের ছিল না। তা যে ছিল না, তার আরও একটি স্পষ্ট প্রমাণ প্রকাশ্যে এসেছে। সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য তিন কিলোমিটারের বেশি হলেই আপৎকালীন রাস্তা তৈরির নিয়ম আছে, যাতে দুর্ঘটনা ঘটলে সেই রাস্তা দিয়ে শ্রমিকদের বের করে আনা যায়। এই সুড়ঙ্গটি সাড়ে চার কিমি লম্বা হওয়া সত্ত্বেও এবং নকশায় আপৎকালীন রাস্তার কথা থাকলেও বেআইনি ভাবে সে সব বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য বিজেপি শাসনে শ্রমিকদের জীবনের মূল্য এর চেয়ে বেশিই বা কী আশা করা যায়!
শুধু প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনের প্রশ্ন নয়, এই বিপর্যয়ে আরও বহু প্রশ্নের বর্শামুখ ঘুরে রয়েছে নির্লজ্জ কায়েমি স্বার্থে বিজেপি সরকারের বেপরোয়া পদক্ষেপের দিকে। ভূতাত্ত্বিক, পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন তুলেছেন, উত্তরাখণ্ডের মতো বাস্তুসংস্থান ও ভূতত্ত্বগত দিক দিয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চলে এই ধরনের কাজ করতে গেলে দীর্ঘ সময় ধরে ভূতাত্ত্বিক ও ভূ-প্রযুক্তিগত পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যে রিপোর্ট নির্মাণ-কোম্পানিকে দিতে হয়, তা কোথায়? ইসরো-র এক প্রাক্তন বিজ্ঞানীর প্রশ্ন— সেই রিপোর্ট যদি থেকেই থাকে, তা হলে তার ভিত্তিতে দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য কী কী ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ নিয়েছে, সরকারের তা জনগণের কাছে তুলে ধরা উচিত। উত্তরাখণ্ড ইউনিভার্সিটি অফ হর্টিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রির চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, সুড়ঙ্গ খননে যে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে, সিল্কিয়ারার এই দুর্ঘটনার পিছনে সেটিও একটি বড় কারণ। তাঁর বক্তব্য, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, চারধাম হাইওয়ে প্রকল্পে ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ আদৌ গুরুত্ব দিয়ে করা হয়নি। সবচেয়ে বড় বোমাটি ফাটিয়েছেন রবি চোপরা— চারধাম প্রকল্পের পরিবেশগত মূল্যায়নের জন্য সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, এই অঞ্চলে এমন বিশাল প্রকল্প শুরুর আগে যে ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ ও সামগ্রিক ভৌগোলিক পরিবেশ গভীর ভাবে খতিয়ে দেখা দরকার ছিল, সরকার তা করেনি। সরকার চেয়েছে তাড়াহুড়ো করে প্রকল্পের কাজ সেরে ফেলতে। ফলে যা ঘটার তাই ঘটেছে। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নিভতে বসেছে ৪১টি প্রাণ।
পরিবেশবিদ, ভূতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা ও নিষেধ অগ্রাহ্য করে সমুদ্রতল থেকে সাড়ে তিন হাজার মিটার ওপরে, হিমালয় সংলগ্ন উত্তরাখণ্ডে নরেন্দ্র মোদি সরকারের রূপায়ণ করতে চলেছে ১২ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প— ‘চারধাম পরিযোজনা’। এই প্রকল্পে ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ হাইওয়ে জুড়বে গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, বদ্রিনাথ ও কেদারনাথ— চার তীর্থস্থানকে। এর জন্য ধ্বংস করা হচ্ছে মাইলের পর মাইল বনভূমি। কেটে ফেলা হচ্ছে হাজার হাজার গাছ। বহু ছোট নদী ও ঝর্ণার স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। মারা পড়ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী ও কীটপতঙ্গ। একের পর এক জোরালো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে তৈরি হচ্ছে টানেল।
সব মিলিয়ে হিমালয় সংলগ্ন এই অঞ্চলের সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্র বিপর্যস্ত করে, গোটা পরিবেশ ও সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনে বিপর্যয় ঘটানোর পরিকল্পনা পাকা করে ফেলেছে মোদি সরকার। শুধু তাই নয়, পরিবেশ সংক্রান্ত আইন থেকে বাঁচতে চালাকির আশ্রয় নিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। যেহেতু আইন অনুযায়ী ১০০ কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যের হাইওয়ে নির্মাণে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে না, তাই প্রায় ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ চারধাম প্রকল্পের হাইওয়ে নির্মাণ প্রকল্পকে কৌশলে তারা ৫৩টি ভাগে ভাগ করিয়ে নিয়েছে রাস্তা পরিবহণ ও হাইওয়ে মন্ত্রককে কাজে লাগিয়ে। প্রতিটি অংশের দৈর্ঘ্য রাখা হয়েছে ১০০ কিমির কম।
সরকারের এই চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ফলে গত কয়েক বছর ধরে পাহাড়ি এই এলাকায় একের পর এক ধস, হড়পা বানের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে চলেছে। এ বছরের গোড়ার দিকেই যোশীমঠ শহরটির ধীরে ধীরে ভূমিগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার সূচনা কাঁপন ধরিয়েছে মানুষের বুকে।
প্রশ্ন হল, পরিবেশবিদ-বিজ্ঞানীদের শত নিষেধ উপেক্ষা করে ভয়াল প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ঘটনা ও ব্যাপক জীবনহানির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও কীসের তাড়নায় চারধাম প্রকল্প হাতে নিল মোদি সরকার? এক কথায় এর উত্তর হল, নিতান্তই ভোট ও পুঁজির স্বার্থে— পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রের যে দুটি বিষয় আবার পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। দেশ জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যবৃদ্ধি ও বেকার সমস্যার সামান্য সমাধানও করতে না পেরে আগামী নির্বাচনে বিজেপির একমাত্র হাতিয়ার উগ্র হিন্দুত্ববাদ। চারধাম হাইওয়ে প্রকল্প আসলে সেই হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডারই অঙ্গ। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে চার তীর্থস্থানকে হাইওয়ে দিয়ে জুড়ে দিতে পারলে আরও একবার নিজেকে হিন্দু ধর্মের ‘মসীহা’ বলে ঢাক পেটানোর সুযোগ মিলবে নরেন্দ্র মোদির। তাছাড়া উত্তরাখণ্ডের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে চিনের। প্রকল্প শেষ হলে চওড়া হাইওয়ে দিয়ে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহণের সুযোগও মিলবে। ফলে দেশের কোটি কোটি মানুষের খাবার জুটুক না-জুটুক, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান যতই নাগালের বাইরে থাক, ভোটের আগে বহিঃশত্রুর আক্রমণের আতঙ্ক ছড়িয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের হিড়িক তুলতেও সাহায্য করবে এই চারধাম প্রকল্প। তাই দ্রুত এই প্রকল্প শেষ করা বিজেপির নিতান্ত প্রয়োজনে। তাতে গরিব-গুরবো কয়েকজন শ্রমিকের প্রাণ না হয় বলি-ই পড়ল! মসনদ-লোভীদের তাতে কতটুকু আসে যায়!
চারধাম প্রকল্প রূপায়ণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুঁজিপতিদের মুনাফার স্বার্থও। অর্থনীতির এই মন্দা দশায় এমনিতেই পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুঁজে খুঁজে হয়রান হতে হচ্ছে ধনকুবের পুঁজিমালিকদের। উত্তরাখণ্ডের সৌন্দর্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশে চারধাম প্রকল্পের মাধ্যমে যদি যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো যায়, তাহলে পর্যটন ব্যবসার রমরমা ঘটতে পারে। দেশি-বিদেশি ধনীপর্যটন ব্যবসায়ীদের হাতে মুনাফা লুঠের সেই সুযোগ তুলে দেওয়ার প্রবল বাসনাও কাজ করছে প্রকল্প দ্রুত শেষ করতে মোদি সরকারের উদগ্র আগ্রহের পিছনে। পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় এইসব ধনপতিদের আশীর্বাদের হাত দলের মাথায় না থাকলে সরকারি ক্ষমতায় যে টিকে থাকাই যাবে না! ফলে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যায় যাক, দুর্ঘটনায় শ্রমিকের প্রাণ বলি হয় হোক, এলাকার নিরীহ বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয় হোক, চারধাম প্রকল্প গড়ার লক্ষ্যে অটল নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকার। তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন উত্তরাখণ্ডের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীও। বলেছেন, সিল্কিয়ারার এই দুর্ঘটনার পরে রাজ্যের সমস্ত সুড়ঙ্গ তৈরির প্রকল্প খতিয়ে দেখা হবে, কারণ এ রকম সুড়ঙ্গ আমাদের আরও দরকার, ইত্যাদি ইত্যাদি।
কায়েমি স্বার্থে মুনাফাবাজ মালিকদের তুষ্ট করতে নির্বিচারে পরিবেশের উপর এভাবেই অত্যাচার চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর চরম জনস্বার্থবিরোধী বিজেপি সরকার। তাদের নির্লজ্জ লোভের বলি এই ৪১ জন নিরুপায় শ্রমিক যারা অন্ধকার সুড়ঙ্গে একটুখানি অক্সিজেনের আশায় প্রাণপণে শ্বাস টেনে চলেছে। সুড়ঙ্গের বাইরে ভিড় করে থাকা তাঁদের পরিজনদের সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশের মানুষ আজ আকুল হয়ে ভাবছে— উন্নয়নের নামে নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস আর সাধারণ মানুষের জীবনকে বলি দেওয়া আর কত দিন চলবে!