পাঠকের মতামতঃ ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন একমাত্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তির

কলকাতা

ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে এক বছর হয়ে গেল। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। ইউক্রেন আমেরিকান নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ জোট ন্যাটোর সদস্য হতে চেয়েছিল। ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি এবং রাশিয়াকে ঘিরে ন্যাটোর শক্তিবৃদ্ধি রাশিয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা বিপদ। এই বিষয়টি সামনে রেখেই রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান করে। এর পরেই ইউক্রেন আমেরিকা সহ নানা শক্তিধর ইউরোপীয় রাষ্টে্রর সাহায্য চায়। তারা বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ায়। এই যুদ্ধ দৃশ্যত রাশিয়া বনাম ইউক্রেন হলেও বাস্তবে এই যুদ্ধ রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদ বনাম আমেরিকা সহ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহের দ্বন্দ্বের পরিণাম। ইউক্রেনকে শিখণ্ডী করে ছায়া যুদ্ধ চলছে দুই যুদ্ধবাজ শিবিরের।

এই যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখনই গণদাবী পত্রিকা লিখেছিল, একদা যুদ্ধবিরোধী শান্তির অতন্দ্র প্রহরী সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্র ছেড়ে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্টে্র পরিণত হয়ে আজ যুদ্ধের ফেরিওয়ালা। বর্ষপূর্তিতে যতদূর দেখা যাচ্ছে যুদ্ধ বন্ধের কোনও লক্ষণ নেই। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত যতটুকু খবর পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের সর্বত্র মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠছে মানুষ চায় না তবু কেন যুদ্ধ হয়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এই সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করার নামে আমেরিকা ও পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি যা করছে ইউক্রেনকে যেভাবে বিপুল অস্ত্র সম্ভার এবং অর্থ দিয়ে যুদ্ধের উন্মাদনায় ঘি ঢালছে, তাতে শান্তি উদ্যোগের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। মরছে দু’দেশের মানুষ। লাখে লাখে উদ্বাস্তু হচ্ছে। দুই দেশেরই হাজার হাজার সেনার প্রাণ যাচ্ছে এই অন্যায় যুদ্ধে। কত শিশু অনাথ হচ্ছে, কত মা সন্তান হারাচ্ছে তার শেষ নেই। কত শহর নগর বন্দর গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যারা বেঁচে আছে তারাও খাদ্য সহ নানা সংকটে জর্জরিত। তারাও প্রাণ হাতে করে দিন গুনছে কবে এই যুদ্ধের শেষ হবে।

রাশিয়ার সাধারণ মানুষও এই যুদ্ধের পক্ষে নয়। যুদ্ধে নেমে রুশ প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন জয়ের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা প্রবল ধাক্কা খেয়েছে। এখন পুতিনকে ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে এই যুদ্ধে দেশের কী কী লাভ হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি মস্কোর ফেডারেল অ্যাসেম্বলিতে ১০৫ মিনিটের ভাষণে পুতিন বলেন, ইউক্রেনকে করায়ত্ত করতে পারলে বাণিজ্যের নয়া দিগন্ত খুলে যাবে। ভারত, ইরান, পাকিস্তান সহ পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক সহজ হবে, অনেক পথ কমে যাবে। তিনি বলেন, রাশিয়া কৃষ্ণ সাগরে একটি বন্দর নির্মাণ করবে, আজভ সাগরে বন্দর নির্মাণ করবে, নর্থ-সাউথ ইন্টারন্যাশনাল করিডোর গড়ে তুলবে। ৭২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথ বহুমুখী বাণিজ্যের রাস্তা খুলে দেবে। শুধু এশিয়ার দেশগুলিই নয় ইউরোপের নানা দেশের সঙ্গেও বাণিজ্যিক পথ সহজ হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে এতে তো একচেটিয়া পুঁজিপতিদের ব্যবসার স্বার্থ, তাদের মুনাফার স্বার্থ পূরণ হবে। এর মধ্যে সাধারণ মানুষের স্বার্থ কোথায়? বরং যুদ্ধের অজুহাতে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে। একই প্রশ্ন উঠছে আমেরিকাতেও। সেখানে যুদ্ধে মারণাস্ত্র সরবরাহ করতে সাধারণ মানুষের উপর বিপুল ট্যাক্স চাপানো হচ্ছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি ইউক্রেন সফরে গিয়ে শেষ ইউক্রেনবাসীকেও যুদ্ধে নামার যে কথা বলে এসেছেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে আমেরিকার ভিতরে। প্রশ্ন উঠছে এ ভাবে কামানের সামনে দাঁড়ানোর জন্য পশ্চিমি দেশগুলি প্ররোচিত করতে পারে কি? সন্দেহ দানা বাঁধছে এই যুদ্ধ ইউক্রেনকে বাঁচাতে, নাকি যুদ্ধকে সামনে রেখে নিজ নিজ দেশের অস্ত্রভাণ্ডার খালাস করতে? বাস্তবে যুদ্ধকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের ধুয়া তুলে অর্থনীতিকে সামরিক অস্ত্রসম্ভার উৎপাদনের দিকে আরও বেশি করে জড়িয়ে ফেলছে। পুতিন তো খোলাখুলি বলে দিলেন বাণিজ্যের প্রয়োজনে তার এই যুদ্ধ। অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিও একই বাণিজ্যিক স্বার্থে বিশ্ব রাজনীতিতে ছড়ি ঘোরাতে এই যুদ্ধে জ্বালানি জোগাচ্ছে। এইসব সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রনায়কদের কাছে যুদ্ধ পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনিবার্যতা। যুদ্ধ ছাড়া আজ পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ বাঁচতে পারে না। সমস্ত পুঁজিবাদী দেশই কমবেশি মন্দায় আক্রান্ত। কোথাও শিল্পায়নের জোয়ার নেই। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। বন্ধ হচ্ছে শ্রমিক প্রধান শিল্প। নতুন যা সামান্য শিল্প গড়ে উঠছে তা এত উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর যে শ্রমিকের প্রয়োজন খুবই কম। এই অবস্থা মন্দাকে তো আরও গভীরতর করবেই। করছেও। কমছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এই অবস্থায় অর্থনীতিতে সামান্য হলেও গতি আনতে সামরিক উৎপাদনকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্র নিজেই ক্রেতা হিসেবে এগিয়ে আসছে। এই যে অর্থনীতির সামরিকীকরণ, এর পরিণাম কী? এই যে এত মারণাস্ত্রের উৎপাদন, এর ব্যবহার হবে কোথায়? আবার এইসব সমরশিল্পে যদি তেজিভাব ধরে রাখতে হয় তা হলে অস্ত্রের বাজারকে চাঙ্গা রাখাও জরুরি। যুদ্ধ, সংঘর্ষ, সীমান্ত যুদ্ধ ইত্যাদির পরিবেশ তৈরি করাও জরুরি। কারণ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির কাছে শান্তি মানে অর্থনীতির বিপদ। তাই ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর জন্য কোনও পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রচেষ্টা নেই।

গত বছর সেপ্টেম্বরে ইউএন-এর সভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘এটা যুদ্ধের যুগ নয়’ বলে প্রবল হাততালি পেলেন। কিন্তু যুদ্ধের বিরুদ্ধে তিনি কী ভূমিকা নিয়েছেন? ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ সহ আরও যাঁরা এই কথা সমর্থন করেছিলেন, যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁরাই বা কী ভূমিকা নিয়েছেন? সম্প্রতি সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের নবীন সদস্য চিন এই যুদ্ধ বন্ধের জন্য মধ্যস্থতার কথা বললেও এবং ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি চিনের প্রস্তাবে কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে বললেও, চিনের লক্ষ্য রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে নিজের ক্ষমতা বাড়ানো। শান্তির লক্ষ্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির কারওরই নেই।

এ প্রশ্ন উঠছে পাঁচের দশক ছয়ের দশকের মতো যুদ্ধ বিরোধী শান্তি মিছিলের সেই প্রাবল্য আজ নেই কেন। আমেরিকা যখন ভিয়েতনাম আক্রমণ করল তখন ‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম’ স্লোগান দিয়ে ছাত্র যুব শক্তি, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় রাস্তায় নেমে এসেছিল। গোটা বিশ্বেই তখন যুদ্ধবিরোধী মিছিল। আজ তার প্রাবল্য কম। কারণ সেদিন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ জোটের বিরুদ্ধে শান্তির শক্তি সমাজতান্ত্রিক শিবির মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর বিশ্বে যুদ্ধ-শান্তির ভারসাম্য যুদ্ধের দিকে হেলে যায়। ফলে যুদ্ধের বিপদ অনেক বেড়ে যায়। ১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পুঁজিবাদী রাশিয়ায় অধঃপতনের পর বিশ্ব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) বলেছিল, এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শান্তি আন্দোলন জোরদার করা জরুরি। এই লক্ষে্যই দলের উদ্যোগে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মঞ্চও গড়ে তোলা হয়। আজ দেখা যাচ্ছে এই সিদ্ধান্ত কত সঠিক ছিল। পরিস্থিতি আরও দেখাচ্ছে শান্তি রক্ষার জন্য সমাজতন্তে্রর শক্তি বৃদ্ধি কত জরুরি। লেনিন বলেছিলেন, ‘ইম্পিরিয়ালিজম জেনারেটস ওয়ার’। বিগত দশকগুলিতে একের পর এক যুদ্ধ এই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করছে। যুদ্ধের ধবংসলীলা থেকে মানব সভ্যতাকে বাঁচাতে হলে এর উৎসে আঘাত করতে হবে, সমাজতান্ত্রিক সমাজের গোড়াপত্তন করতে হবে। এ কাজ যতই কঠিন হোক এটাই যুদ্ধ বন্ধের একমাত্র সঠিক পথ।

ধীমান দেবনাথ, আলিপুরদুয়ার