জ্বর ‘ডেঙ্গু ভাইরাস ঘটিত’– এ কথা লেখা চলবে কি না তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসককুলই থরহরি কম্প৷ কারণ, রাজ্য সরকারের আদেশ বা উপদেশ এ রাজ্যে সরকারি পরিসংখ্যানে ডেঙ্গু নেই বললেই চলে৷ কিন্তু কলকাতা শহর থেকে অজ গ্রাম, সর্বত্র ডেঙ্গুর থাবায় রাজ্যবাসী আতঙ্কগ্রস্ত৷ ইতিমধ্যে এই ভয়ঙ্কর রোগ বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে৷ রোগ গোপন এবং গুরুত্ব লঘু করার জন্য শেষবিচারে ক্ষতি হচ্ছে জনসাধারণেরই৷ তাঁরাও মশার কামড় এবং রোগের ভয়াবহতা ও ব্যাপকতাকে ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না৷ সরকারই যখন ঘোষণা করেছে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম এবং তা নিয়ন্ত্রণে, তখন এ বিষয়ে স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মীদের কী রকম গা–ছাড়া ভাব হতে পারে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে যেহেতু এখনও শুধু প্রতিরোধই ভরসা, তাই মশা নিয়ন্ত্রণ তথা নিধনের দায়িত্ব যে সব দপ্তরের, তারা সরকারি প্রশ্রয়ে কীরকম উদাসীন থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷
তা ছাড়া, গত দু’বছরের অভিজ্ঞতায় যে হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও চিকিৎসকরা ডেঙ্গু লিখে যার পর নাই হয়রানির শিকার হয়েছেন তাঁরা কেন আবার খাল কেটে কুমির আনবেন তাই সরকারি হাসপাতাল শুধু নয় বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোম, ল্যাবরেটরি, চিকিৎসক সকলেই ডেঙ্গু হলে বড় জোর ‘ডেঙ্গু লাইক ফিভার’, ‘ফিভার উইথ শক,’ ‘ফিভার উইথ হেমারেজ,’ ‘ফিভার উইথ শক সিনড্রোম’ লিখে কর্তব্য পালন করছেন এবং সরকারি বিষদৃষ্টি এড়িয়ে চলছেন৷ এর বাইরে কেউ সাহস করে ডেঙ্গু লিখে ফেললে, স্বাস্থ্য দপ্তর তথা স্বাস্থ্য ভবন তাঁদের নথিপত্র চেয়ে ব্যাপক চাপে ফেলছে৷
রাজ্যে চিকিৎসার মান ভাল– এটা বোঝাতে সরকার তথা প্রশাসন অসুখের প্রকৃত কারণ যেভাবে আড়াল করছে তা রাজ্যবাসীর পক্ষে বিপজ্জনক৷ ডাক্তাররা বিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে কী লিখবেন আর কী লিখবেন না, তা কি কোনও সরকার নির্ধারণ করে দিতে পারে?
এ কথা কেউ মনে করে না ডেঙ্গুর বাড়–বাড়ন্তের জন্য রাজ্য সরকারের অবহেলাই শুধুমাত্র দায়ী৷ তবে স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে রাজ্য প্রশাসন দায়বদ্ধ হলে এবং দায়িত্ব পালন করলে এর আক্রমণ অনেক কমানো সম্ভব৷ তার জন্য প্রথম দরকার বিশ্বে স্বীকৃত ডেঙ্গুবৃদ্ধির প্রাথমিক কারণগুলির বিষয়ে সচেতন হওয়া৷ কারণগুলি হল– ক) অবাধ নগরায়ণ বা নির্মাণ কাজের সময় কোনও না কোনও ভাবে জল জমে থাকা, খ) মশক নিয়ন্ত্রণ তথা নিধন কর্মসূচি ঠিক মতো না করা৷ এগুলি দূর করা জরুরি প্রয়োজন৷ দ্বিতীয় প্রয়োজন, সরকারিভাবে রোগনির্ণয়, ভর্তি, চিকিৎসা এবং জটিল রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজ্যব্যাপী নিবিড় ব্যবস্থা৷ অথচ রাজ্যের সুপার স্পেশালিটি থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলিতে বর্তমানে চিকিৎসার যে হাঁড়ির হাল, তাতে রাজ্যবাসীর আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই৷
ভারতবর্ষের বিশেষ কয়েকটি ডেঙ্গু কবলিত রাজ্যের অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ৷ প্রতিবেশী বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার প্রভৃতি দেশ ডেঙ্গুর ‘এনডেমিক জোন’ অর্থাৎ মহামারী প্রবণ এলাকা হিসাবে চিহ্ণিত৷ তা হলে ‘ডেঙ্গু’ স্বীকারে রাজ্য সরকারের লজ্জা কীসের ডেঙ্গুর যেহেতু উপসর্গভিত্তিক নিরাময় ছাড়া, বিশেষ কোনও চিকিৎসা নেই, তাই ভাইরাসবাহী মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি৷ এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা বরং লজ্জার কারণ হতে পারে৷ পরিবেশ, পয়ঃপ্রণালী আবর্জনা থেকে শুরু করে মশককূল নিধনের যে ‘বর্ষব্যাপী যজ্ঞ’ চিকিৎসাবিজ্ঞানে নথিবদ্ধ, তার কোনও প্রয়োগ এ রাজ্যে চোখে পড়ছে না৷ মশার ডিম, লার্ভা থেকে শুরু করে পূর্ণাঙ্গ মশা মারার কাজে শহরে বা গ্রামে কোনও উদ্যোগ বা তৎপরতা নেই৷ যতটা আছে পূজো প্যান্ডেলে স্বাস্থ্যবিধি টাঙানো কর্তাদের সরকারি পুরস্কার বিতরণে৷
ডেঙ্গুর মশা গড়ে ২ সপ্তাহবাঁচে৷ শুধুমাত্র ‘স্ত্রী’ প্রজাতির এডিস–ইজিপ্ঢাই গোত্রের মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয় যদি পরিবেশে ডেঙ্গু ভাইরাস থাকে ও তার দ্বারা সেই মশা সংক্রমিত হয়৷ তাছাড়া সব ডেঙ্গু সংক্রমণই উপসর্গ নিয়ে ফুটে বের হয় না৷ মশার যে কামড় থেকে ‘ডেঙ্গু’ উপসর্গ বা অসুখ হয় তা সামগ্রিক সংক্রমণের শতকরা এক ভাগ৷ তার মধ্যে মারাত্মক ডেঙ্গু অর্থাৎ ‘ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার’ ও ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’ যা প্রাণঘাতী হতে পারে তা শতকরা একজনের হয়৷ আর তার মধ্যে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে মৃত্যু হয় শতকরা ৩–৪ জনের৷ যদি সব প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রী মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহনে সক্ষম হত এবং তারা সকলেই মারাত্মক প্রকৃতির ডেঙ্গু হত, তা হলে এ রাজ্যে কত মানুষ যে অকালে মারা পড়ত তা কল্পনাতীত৷ এ রাজ্যে সরকারের যা দায়বদ্ধতা তাতে হয়ত সরকারি বিবৃতিতে বলা হত, ‘গত বছরের তুলনায় এবার মৃত্যু কম’, ইত্যাদি ইত্যাদি কিন্তু মৃত্যুর হিসাব কি শুধু সংখ্যা দিয়ে হয়!
সচেতন নাগরিক আন্দোলন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অংশগ্রহণ, বছরভর মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম হচ্ছে কি না তার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি৷ সব পঞ্চায়েত থেকে কলকাতা মহানগরী পর্যন্ত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থার পর্যাপ্ত আয়োজনের নিশ্চয়তাই রাজ্যবাসীকে ডেঙ্গুর কবল থেকে মুক্ত করতে পারে এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাফল্য নিশ্চিত করতে পারে৷
(৭১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা ২৩ – ২৯ নভেম্বর, ২০১৮)