৯ আগস্ট আর জি কর মেডিকেল কলেজের নারকীয় ঘটনার পর এক মাস পেরিয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে শুধু কলকাতা নয়, এই রাজ্য, এমনকি বিশ্ব জুড়ে মানুষ এই নৃশংস ঘটনার বিচার চেয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। সর্বত্র দাবি উঠেছে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। এই আন্দোলনে মহিলারাও বিপুল সংখ্যায় অংশ নিয়েছেন। এই ঘটনা নিয়ে ইউটিউব চ্যানেল ‘সাম্যবাদী দৃষ্টিকোণ’-এর পক্ষ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর কিছু প্রশ্ন রাখা হয়েছিল এস ইউ সি আই(কমিউনিস্ট)-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের কাছে। প্রশ্নোত্তরে সেই আলোচনাটি আমরা গণদাবীতে প্রকাশ করলাম।
প্রশ্নঃ আর জি করের ঘটনায় শুরু থেকে রাজ্য সরকারের যে ভূমিকা তাতে সাধারণ মানুষের অভিমত যে, সরকার বোধহয় কিছু লুকোতে চাইছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
উত্তরঃ বোধহয় নয়, এটা বাস্তব সত্য। এই বর্বর ঘটনার পর প্রথম থেকেই সরকারের যে ভূমিকা তাতে অত্যন্ত পরিষ্কার যে সরকার কিছু ধামাচাপা দিতে চাইছে। এখানে বোধহয়ের কোনও জায়গা নেই। যে খবরগুলি প্রকাশ্যে এসেছে, যেমন, মৃতদেহ দেখার পর এফআইআর হল চোদ্দ ঘণ্টা বাদে। এটা কোনও গ্রামাঞ্চল বা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা নয় যে, থানা থেকে আসতে অনেক সময় লাগে। পাশেই থানা, তবু এত সময় লাগল কেন? ময়নাতদন্ত হল চালান ছাড়াই। সুপ্রিম কোর্টও এই প্রশ্নটা তুলেছে। পোশাক নিয়েও দু-রকম রিপোর্ট। যেখানে ঘটনাটা ঘটেছে, হাসপাতালের অন্য কোথাও নয়, তার পাশের অংশই ভেঙে ফেলা হল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সরকারি প্রশাসন কিছু চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। মৃতদেহ দাহ করার জন্য পুলিশ এত ব্যস্ততা দেখাল কেন? শেষ মুহূর্তে এমনকি বাবা-মাকেও না জানিয়ে মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানের দিকে রওনা হয়ে গেছে পুলিশ। বাবা-মা বার বার কাতর আবেদন জানিয়েছেন। তিন ঘন্টার বেশি তাঁদের মৃত মেয়ের মুখটা পর্যন্ত দেখতে দেয়নি। বাবা-মাকে টাকা অফার করা হয়েছে। কেন টাকা অফার করা হল? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বাবা-মা যদি মেয়ের স্মৃতিতে কিছু করতে চান তার জন্য। এটা একটা ছেঁদো যুক্তি। বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথম থেকে যা কিছু শোনা যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট, রাজ্য সরকার কিছু চাপা দিতে চেষ্টা করছে। ফলে জনসাধারণের মধ্যে এই যে ধারণা তৈরি হয়েছে তা খুবই স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত।
এনসিআরবি-র একটি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দেশে প্রতি ১৫ মিনিটে এক জন মহিলা ধর্ষিতা হচ্ছেন। এ রাজ্যেও তৃণমূল শাসনে কামদুনি সহ অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু এই রকম একটা গণবিস্ফোরণ, বিশেষ করে নারী সমাজের ভূমিকা– এমনটা কিন্তু আগে দেখা যায়নি। রাজ্য এবং দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। এটাকে আপনি কী ভাবে দেখছেন।
এ ক্ষেত্রে নারী সমাজের যে ভূমিকা তা ঐতিহাসিক এবং একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। স্বদেশি আন্দোলনের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত নারী আন্দোলনের এত ব্যাপকতা, গভীরতা, বলিষ্ঠতা দেখা যায়নি। তা ছাড়া পনেরো মিনিটে একজন ধর্ষিতা হচ্ছেন– এটা সরকারি হিসাব। বাস্তবে প্রতি মিনিটে কত ধর্ষণ হচ্ছে কোথাও না কোথাও– যার খবর সরকার জানে না, রাখে না, রাখার প্রয়োজনও মনে করে না। সংবাদমাধ্যমে এর সামান্য কিছু রিপোর্ট পাওয়া যায়। প্রতিবাদে যাঁরা সোচ্চার হয়েছেন সেই মহিলারা বা তাদের আত্মীয়রা অথবা পরিচিতরা অনেকেই ভুক্তভোগী– রাস্তায়-বাসে-ট্রেনে তাঁদের মর্যাদাহানি হয়, শ্লীলতাহানি হয়। ফলে একটা পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ ছিল, যার বিস্ফোরণ এটা।
পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সাধারণ মানুষের মধ্যেও আছে, নারী সমাজের মধ্যে বিশেষ ভাবে আছে। আর এটা একটা অত্যন্ত বীভৎস মর্মান্তিক ঘটনা। একজন চিকিৎসক, যিনি রোগীদের সেবা করেন, তাঁর হাসপাতালের মধ্যেই এ রকম একটা ঘটনা যে ঘটতে পারে, মানুষ সেটা ভাবতেই পারেনি। আমি যতদূর জানি, এর আগে কখনও হাসপাতালের মধ্যে মহিলা ডাক্তারের খুন-ধর্ষণের এমন ঘটনা ঘটেনি। ফলে এর বীভৎসতাটা, নারকীয়তাটা ভয়াবহ ভাবে মানুষের কাছে এসেছে। একটা আতঙ্ক তৈরি করেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এত দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। দীর্ঘ দিন ধরে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, খুন ঘটে চলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের জীবনের আরও নানা সমস্যা– মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, ছাঁটাই, নিরাপত্তার অভাব। সমস্ত ক্ষেত্রে প্রবল দুর্নীতি। নিরপেক্ষ প্রশাসন বলে কোনও কিছু নেই। সমস্ত ক্ষেত্রে দলীয় আধিপত্য, সরকারি দলের আধিপত্য। শুধু এখন বলে নয়, এখন তো বটেই, এই সব কুকীর্তি প্রতিটি শাসক দলের ক্ষেত্রেই মানুষ দেখেছে। কংগ্রেস দীর্ঘ দিন কেন্দ্রে-রাজ্যে শাসন করেছে। এখন বিজেপি করছে কয়েকটি রাজ্যে এবং কেন্দ্রে। অন্যান্য আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলিও বিভিন্ন রাজ্যে শাসন করেছে ও করছে। সিপিএম তিনটি রাজ্যে শাসন করেছে। এখন শুধু কেরালায় আছে। ঠিক এই মুহূর্তে কেরালায় সিপিএম শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ চলছে। চলচ্চিত্র অভিনেত্রীরা প্রথম বিদ্রোহ করেছেন। অভিযোগ উঠেছে, অভিনেত্রীদের শ্লীলতাহানির অভিযোগের তদন্তে গঠিত হেমা কমিটির রিপোর্ট কেরালা সরকার ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। হাইকোর্ট আজ রাজ্য সরকারকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছে যে, কেন এতদিন রিপোর্ট ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে! আরও একের পর এক অভিযোগ উঠছে। তা দেখে এ রাজ্যের টালিগঞ্জেও অভিনেত্রীদের একটি অংশ একই অভিযোগ তুলেছেন।
এ রকম ঘটনা ঘটেই চলেছে। যার ফলে একটা পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ ছিলই নারীসমাজের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে এবং এর কোনও প্রতিকার কোথাও দেখা যায়নি। আর জি করের ঘটনাটা একটা স্ফূলিঙ্গ হিসাবে কাজ করেছে। এর নারকীয়তাটা, বীভৎসতাটা মারাত্মক। এর সাথে এত দিনের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি ও পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরই বিস্ফোরণ ঘটেছে এ দেশে এবং বিদেশে। বাংলাদেশের আন্দোলনও এখানে অনুপ্রেরণার কাজ করেছে। বাংলাদেশে যে বিরাট আন্দোলন অত্যাচারী সরকারকে সরিয়ে দিল, সেখানেও নারীদের বিরাট ভূমিকা ছিল। মুসলিম নারীদের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকা– কেউ মানেনি। সবাই রাস্তায় নেমে গিয়েছিলেন। মেয়েরাও শহিদ হয়েছেন– মুসলিম মেয়ে, হিন্দু মেয়ে সবাই লড়াই করেছেন। এই ঘটনা সবাইকে খুবই অনুপ্রাণিত করেছে।
এই আন্দোলন আগামী দিনে গণআন্দোলনের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে?
এই ঘটনা আগামী দিনে গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। শাসক দলগুলো এটাকে কী চোখে দেখছে তারাই বলতে পারবে। কিন্তু নারী সমাজের এমন সক্রিয় অভ্যুত্থান, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এবং অত্যন্ত বেপরোয়া ভাবে যে তারা তাদের বিক্ষোভের প্রকাশ ঘটাল এটা আগামী দিনের গণআন্দোলনগুলিকে অনেকখানি অনুপ্রাণিত করবে, সাহায্য করবে।
এই আন্দোলনে একটা নতুন বৈশিষ্ট্য আমরা দেখছি যে, সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি, সরকারি দলগুলি–তাদের কারও প্রতি মানুষের কোনও ভরসা নেই।
তার কারণও আছে। এই সব রাজনৈতিক দলগুলিই সরকারে ছিল এবং আছে। এদের সবাইকে মানুষ দেখেছে। কংগ্রেসকে দেখেছে, বিজেপিকে দেখেছে, সিপিএমকে দেখেছে, এখন তৃণমূলকে দেখছে। প্রত্যেকটি সরকার সম্পর্কে মানুষের ধারণা– এরা জনগণের জন্য কিছু করে না। এরা শুধু মালিক শ্রেণি, পুঁজিপতি-ধনিক শ্রেণির স্বার্থেই দলীয় শাসন চালায়, পতাকা যা-ই হোক, স্লোগান যা-ই হোক। তাদের একটাই লক্ষ্য– বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থে কাজ করা। সাধারণ মানুষ অত্যাচারিত হচ্ছে, নিষ্পেষিত হচ্ছে, সংকটে জর্জরিত হচ্ছে। অথচ এই দলগুলি সব দুর্নীতিতে ডুবে রয়েছে– উপর থেকে নিচ পর্যন্ত। এদের সম্পর্কে মানুষের এটাই ধারণা। প্রত্যেকটি সরকারি দল সম্পর্কে মানুষ অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ।
পাশাপাশি দেখছি, আমরা এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) যখন জনগণের কাছে যাচ্ছি আমরা কিন্তু মানুষের অনেক ভালবাসা পাচ্ছি, সমর্থন পাচ্ছি। ১৪ আগস্ট রাতে আর জি করে আন্দোলনের উপর হামলা হল। কারা করল এটা পরিষ্কার। কারণ, আন্দোলনকারীদের উপর কে হামলা করবে? হয় পুলিশ, না হয় সরকারি দলের আশ্রিত সমাজবিরোধীরা। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাঝরাতে আমাদের দল এস ইউ সি আই (সি) সিদ্ধান্ত নিল– এর একটা প্রতিবাদ হওয়া দরকার। দল ১৬ আগস্ট রাজ্য জুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিল। ১৫ আগস্ট ছিল ছুটির দিন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দলের কর্মীরা প্রচার করেছে সারা রাজ্যে। সংবাদপত্রে প্রচারের কোনও সুযোগ হয়নি, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কিছু কিছু প্রচার হয়েছিল। কিন্তু এই ধর্মঘটে ছিল অভূতপূর্ব সাড়া। কলকাতায় সরকার বাস চালিয়েছে, রাজ্যে ট্রেন চালিয়েছে, কিন্তু যাত্রী বিশেষ ছিল না। আমাদের ডাকে মানুষ এ ভাবে সাড়া দিল। পাশাপাশি বিজেপি নবান্ন অভিযানের নামে একটা নকল-লড়াই করল। পরের দিন ধর্মঘট ডাকল। মানুষ কিন্তু সেই ডাকে বিশেষ সাড়া দেয়নি। জবরদস্তি কিছু করার চেষ্টা করেছে। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়– এই সব রাজনৈতিক দলগুলি সম্পর্কে জনগণের অনাস্থা এবং আমাদের দল সম্পর্কে একটা আস্থা এবং ভরসা গড়ে উঠেছে। দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। জনগণ বুঝতে পারছে বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেস আন্দোলনের নামে যা কিছু করছে, সবই আগামী ভোটের দিকে তাকিয়ে। আর আমরা করছি দাবি আদায়ের জন্য, আন্দোলনকে সফল করার জন্য।
৯ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট যা বলল তাতে মনে হচ্ছে কোর্ট কোথাও যেন এই আন্দোলনের রাশটাকে একটু টেনে ধরতে চাইছে। আপনি কী বলবেন?
আমারও তাই মত। সুপ্রিম কোর্ট হতাশ করেছে জনগণকে। সুপ্রিম কোর্ট মামলাটাকে হাইকোর্টের থেকে টেক-আপ করেছিল। মানুষের একটা আশা জেগেছিল। যদিও নিউট্রালিটি বা নিরপেক্ষতা বলতে যা বোঝায় জুডিশিয়ারির সে নিউট্রালিটি এখন প্রায় নিছক কথার কথা হিসাবে দাঁড়িয়েছে। এটা মানুষের ধারণা, আমাদেরও ধারণা। এই যে সিবিআই, এক মাস হয়ে গেল, একজন দুষ্কৃতীকেও ধরতে পারল না, চিহ্নিত করতে পারল না। সিবিআইকে চালায় কে? কেন্দ্রীয় সরকার। এটাও তো বিস্ময়কর। তারা দুর্নীতি ধরেছে। ঠিকই আছে। কিন্তু দুর্নীতি একটা সাইড ইস্যু। মানে পূর্বতন অধ্যক্ষের যে দুর্নীতি-চক্র কাজ করত, তারা কী ভাবে অসৎ পথে টাকাপয়সা আত্মসাৎ করত, এগুলি প্রকাশ্যে আসছে। এটা ঠিক আছে। কিন্তু মূল যে দায়িত্ব, অপরাধীকে চিহ্নিত করা, কারা এর নেপথ্যে ভূমিকা পালন করেছে– এখন পর্যন্ত কিছু প্রকাশ্যে এল না। সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিস ডিলেইড। প্রবচনে আছে, জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড। সুপ্রিম কোর্টে ধীরগতির বিচার শেষ পর্যন্ত বিচারহীনতায় পরিণত হবে কি না তা ভবিষ্যতই বলবে। শুনানি যা হল তা খুবই হতাশাজনক। যার জন্য আমরা বলেছি, আন্দোলনকে তীব্র করতে হবে। আবার এ কথাও আমরা বলেছি, হয়তো অপরাধী কেউ ধরা পড়তে পারে, হয়ত শাস্তিও হতে পারে। অতীতে কিছু কিছু শাস্তি হয়েছেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়নি। যেখানে অপরাধী সরকারের আশ্রিত, সেখানে শাস্তি হয়নি। যেখানে সাধারণ লোক ধরা পড়েছে, সেখানে কিছু কিছু শাস্তি হয়েছে। কিন্তু শাস্তি হোক আর না হোক, এই কিডন্যাপিং, ইভটিজিং, রেপিং, মাস-রেপিং, মার্ডার– এগুলি চলছে, চলবে, বাড়বে। এগুলি আগে ছিল না। রামমোহন, বিদ্যাসাগরের সময় ছিল না। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র দেখেননি। নজরুল দেখেননি। স্বদেশি আন্দোলনের সময় এ-সব ছিল না। তখন ছাত্র-যুবকদের একটা নৈতিক মান ছিল। কারণ তখন দেশে নবজাগরণের আন্দোলন ছিল। নবজাগরণ একটা নৈতিকতা দিয়েছিল, মানবিক মূল্যবোধ দিয়েছিল। স্বদেশি আন্দোলনও একটা মূল্যবোধ দিয়েছিল, চরিত্র দিয়েছিল। ছাত্র-যুবকরা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
আর এখন দেশের অবস্থা কী? পুঁজিপতি শ্রেণি, তারা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা নিজেরাই নিজেদের সৃষ্ট আইন ভাঙে। আইন আইনের পথে চলে না, আইনকে যারা চালায়, সেই পথেই চলে। এমনিতে তো প্রচলিত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে আইনের পথে শোষণ চলছেই, মুনাফা লুটছেই, শ্রমিক বঞ্চিত হচ্ছে, শোষিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে। স্থায়ী কাজ উঠেই গেছে, চুক্তির ভিত্তিতে কাজ এখন। বেশির ভাগই পরিযায়ী শ্রমিক– বিদেশে চলে যাচ্ছে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। ইজরায়েলে চলে গেছে। কারণ, ওখানে আগে প্যালেস্টাইনের গরিবরা কাজ করত। এখন সেখানে এই দেশের গরিবরা কাজ করছে। দেশে-বিদেশে সর্বত্র মাইগ্র্যান্ট লেবাররা ছুটছে যা হোক কিছু রোজগারের জন্য। এ রকম ভয়াবহ অবস্থা গোটা দেশে। পুঁজিবাদী শোষণের ফলেই এই সব ঘটছে।
পুঁজিপতিরা নিজেরা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নেয়, টাকা শোধ করে না, সুদ দেওয়া তো দূরের কথা। ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করে দিচ্ছে, মানে সরকার মকুব করে দিচ্ছে। কালো টাকা বিদেশে সঞ্চয় করছে। এ সব তো ঘটছেই। গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই দুর্নীতিগ্রস্ত। সব দলের সরকারই আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। কাটমানি, ঘুষ ছাড়া কোনও কাজই হয় না। গোটা সমাজকেও তা দুর্নীতিগ্রস্ত করছে। তারা গোটা দেশে কী সংস্কৃতি নিয়ে এসেছে? ড্রাগের নেশা, মদের নেশা, জুয়া খেলো, সাট্টা খেলো, নারীদেহ নিয়ে নোংরা আলোচনা করো, ব্লু-ফিল্ম দেখো, আর ফিল্মস্টার, প্লেয়ারদের বিরাট কাহিনি থাকে খবরের কাগজে– সে সব পড়ো। খবরের কাগজে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নেই, বিদ্যাসাগর, ফুলে, শরৎচন্দ্র, সুভাষচন্দ্র প্রভৃতি বড় মানুষরা নেই। প্রতিদিন খবরের কাগজের দুটি-তিনটি পাতা জুড়ে থাকে খেলোয়াড় আর ফিল্মস্টারদের কাহিনি। তারা কী চরিত্র দেবে? এইভাবে যুব সমাজের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে।
কেউ তো ধর্ষক হয়ে জন্মায় না। মাতৃগর্ভ থেকে যে শিশু জন্মায়, সেই শিশু মূল্যবোধ কোথা থেকে পায়? মাতৃগর্ভ থেকে পায় না, পায় সামাজিক পরিবেশ থেকে। নবজাগরণ, স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগেও মানুষ সামাজিক পরিবেশ থেকে মূল্যবোধ পেয়েছিল। সেটা ছিল উন্নত মূল্যবোধ। এখন পরিবেশ ভিন্ন। এই পরিবেশ কিশোরদের, যুবকদের অমানুষ করছে, মনুষ্যত্বহীন, মূল্যবোধহীন করছে। যার জন্য বাবা মেয়েকে ধর্ষণ করছে, নাবালক ভাই নাবালিকা বোনকে ধর্ষণ করছে, পাঁচ বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করছে। ৮০ বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করছে, কেউ ভাবতে পারে এই জিনিস! কোথায় নিয়ে যাচ্ছে দেশকে! এর জন্য পুঁজিবাদ দায়ী। যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে, আর পুঁজিবাদের স্বার্থবাহী এই শাসক দলগুলি থাকবে, ততদিন এ সব চলতেই থাকবে, বাড়তেই থাকবে।
তা হলে কিছু করার নেই? না, অবশ্যই করার আছে। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে, লড়াই করতে হবে। সরকারকে বাধ্য করতে হবে দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়ার জন্য। আবার এটাই শুধু নয়। এর সাথে যেটা প্রয়োজন, আমরা জনগণকে বলি, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় পাবলিক কমিটি গড়ে তুলুন। সৎ যুবকদের নিয়ে ভলান্টিয়ার বাহিনী গড়ে তুলুন। যেখানেই এ সব জিনিস ঘটবে, সেখানেই তারা প্রতিরোধ করবে, বাধা দেবে। এটা প্রয়োজন। পুলিশের দিকে তাকিয়ে, সরকারের দিকে তাকিয়ে এর সমাধান নেই। যেমন করে আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছে মেয়েরা, পুরুষরাও নেমেছে, তেমনি করে সক্রিয় ভাবে পাড়ায় পাড়ায় নামতে হবে। সজাগ থাকতে হবে, কোথাও কিছু ঘটলে ছুটে যেতে হবে, ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। অত্যাচারীর শাস্তিবিধানে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। এটা প্রয়োজন।
আরেকটা হচ্ছে, বিকল্প একটা নৈতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। থ্রি-ফোর-ফাইভের ছেলেমেয়েরা সেক্স নিয়ে আলোচনা করে। সেক্সে ইনভলভড হয়ে যাচ্ছে। কোথায় সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে এই সব শাসক দলগুলি আর শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি? মানবিক মূল্যবোধ বলতে আর কিছু থাকছে না।
আর ঠিক একই কারণে বাবা-মাকে সম্পত্তির জন্য খুন করছে, ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে। পারিবারিক জীবন ভেঙে পড়ছে। স্নেহ-মায়া-দয়া-মমতা বলে কিছু থাকছে না। এ একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। মনুষ্যদেহী, মানবিক মূল্যবোধ বর্জিত একটা নতুন ধরনের জীব সৃষ্টি করছে। এক রকম বলতে গেলে, গোটা সমাজ প্রায় পচা-গলা বিকৃত শবদেহের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এত করেও মনুষ্যত্ব যে এখনও সবটা ধ্বংস করতে পারেনি তার প্রমাণ এই ঐতিহাসিক আন্দোলন।
আরেকটা জিনিস আমরা চাই। পাড়ায় পাড়ায় স্কুলের ছুটির দিন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে, কিশোর-যুবকদের নিয়ে খেলাধূলা, নাটক, গান করা– এগুলি চরিত্র গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। আর এ দেশের মনীষীদের নিয়ে–রামমোহন, বিদ্যাসাগর, জ্যোতিরাও ফুলে, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সি আর দাশ, সুভাষচন্দ্র, ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, সূর্য সেন, প্রীতিলতা– এঁদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে চর্চা হোক। ছোটরা জানুক। তার দ্বারা তারা উৎসাহিত হবে, অনুপ্রাণিত হবে। এই পরিবেশটা সৃষ্টি করতে হবে। একটা নতুন মূল্যবোধ দিতে হবে। এগুলি অত্যন্ত প্রয়োজন। এটা আমাদের মহান নেতা বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ খুব জোর দিয়ে বলে গেছেন। আমাদের দলের কর্মীদেরও বলে গেছেন– নবজাগরণের মনীষীদের থেকে, স্বদেশি আন্দোলনের মহান যোদ্ধাদের থেকে শেখো। এঁদের থেকে শিখে আরও এক ধাপ এগিয়ে তারপর কমিউনিস্ট চরিত্র অর্জন করতে হবে। আমাদের দলে এর সাধনা চলে।
দেশের পরিস্থিতি খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। কিন্তু হা-হুতাশ করে কোনও লাভ নেই। হতাশার দ্বারা কোনও সমাধান হবে না। এগিয়ে আসতে হবে– একদিকে পাবলিক কমিটি চাই, ভলান্টিয়ার বাহিনী চাই। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষকরা স্কুলে উদ্যোগ নিয়ে এগুলি গড়ে তুলুন। পাড়ায় যুবকরা গড়ে তুলুক। পুঁজিবাদী সংস্কৃতির বিকল্প সাংস্কৃতিক, নৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে ছোটদের শিক্ষার জন্য, যাতে তারা একটা নতুন মূল্যবোধ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে।
এই যে সামাজিক জাগরণ, যেটা ঘটেছে, এটা কি এ ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকা নিতে পারে? কীভাবে এটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন?
অবশ্যই পারে। যারা আজকে লড়াই করছেন, আন্দোলন করছেন, তাদের কাছে আমরা যে আবেদন করছি, তার ভিত্তিতে যদি তারা ক্রিয়া করেন, তা হলে অবশ্যই পারবে।