করোনাতে গত এক বছরে ভারতে বন্ধ হয়েছে ১০ হাজার সংস্থা, কাজ হারিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সব মিলিয়ে ভারতে গৃহস্থ পরিবারগুলি মোট ১৩ লক্ষ কোটি টাকার আয় হারিয়েছে করোনা ও লকডাউনে (ইউবিএস সিকিউরিটিজ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট)। বিপরীত চিত্রটি হল শুধুমাত্র গত এপ্রিল-জুলাই– এই চার মাসে ভারতের ডলার বিলিওনেয়ারদের (শত কোটি ডলারের মালিক) সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। দেশের ১০০ জন বিলিওনেয়ারের যে পরিমাণ সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে তা দিয়ে ভারতের দরিদ্রতম ১৪ কোটি মানুষের পিছনে ৯৪ হাজার টাকা করে খরচ করা যেত (অক্সফ্যাম রিপোর্ট)। অর্থাৎ সম্পদের এমন কেন্দ্রীকরণ না ঘটালে, সমবন্টনের ব্যবস্থা থাকলে ১৪ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে অর্থনীতিতে একটা গতি আসতে পারত। কিন্তু ব্যক্তি-মালিকানা ভিত্তিক বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমবণ্টন পুঁজিবাদীরা মানবে কেন! তারাই তো সমাজের সমস্ত সুফল ভোগ করছে।
লকডাউনের সময়ে বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির রোজগার বেড়েছে প্রতি ঘণ্টায় ৯০ কোটি টাকা হিসাবে (ইকনমিক টাইমস সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০)। মার্চ-অক্টোবরের় মধ্যে তাঁর সম্পদ দ্বিগুণ হয়েছে। বিশ্বের চতুর্থ ধনীতম ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন তিনি। ওই তালিকার পরের পাঁচ জনের মোট সম্পদের থেকেও বেশি সম্পদ আম্বানির। গৌতম আদানির সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬১ শতাংশ। দ্রুত গতিতে সম্পদ বৃদ্ধির হারে গৌতম আদানি পিছনে ফেলে দিয়েছেন বিশ্বের এক নম্বর বেজোস, এশিয়ার এক নম্বর আম্বানি সকলকেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের মুনাফার হার দাঁড়িয়েছে ৯০ শতাংশ (ব্লুমবার্গ বিলিয়োনেয়ার ইনডেক্স, ১২ মার্চ ২০২১ আবাপ)। করোনা অতিমারির ৬ মাসে নতুন বিলিওনেয়ার হয়েছেন ১৫ জন। কাদের কল্যাণে এই ধনস্ফীতি? মোদি সরকার এই ধনকুবেরদের বিপুল সুবিধা দিতেই কর্পোরেট কর কমিয়েছে, দিয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ। পরিণামে কর আদায় কমেছে রেকর্ড হারে। ফলে সরকার শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান সহ নাগরিক জীবনের অপরিহার্য খাতে এ বারের বাজেটে বরাদ্দ কমিয়েছে অথবা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে।
পুঁজিবাদের ‘স্বর্গরাজ্য’ আমেরিকার অবস্থা কী? সেখানে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন, চার লক্ষ ২০ হাজার মারা গেছেন (২৬ জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত)। ১ কোটি ২০ লক্ষ চাকরীজীবী চিকিৎসা বিমা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ২৬ আগস্ট ২০২০ থেকে। প্রায় তিন কোটি মানুষের ঘরে গত ডিসেম্বর থেকে প্রচণ্ড খাদ্যাভাব চলছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ১ কোটি ২০ লক্ষ শিশু অর্ধাহারে-অনাহারে রয়েছে। ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না ডিসেম্বর থেকে। অন্য দিকে এ সময়ই সেখানকার ধনকুবেরদের সম্পদ বেড়েছে ৪০ শতাংশ। সংখ্যাতেও ধনকুবের বেড়েছে। করোনার আগে সেখানে ধনকুবের ছিল ৬১৪ জন, ৪৬ জন যুক্ত হয়ে বর্তমানে ৬৬০ (ফোর্বস রিপোর্ট)। এই হল পুঁজিবাদের স্বর্গরাজ্য আমেরিকায় বৈষম্যের উৎকট চেহারা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন করোনা আবহে জাতীয় বিপর্যয়ের জন্য ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। আর ধনকুবের যাদের ৪০ শতাংশ সম্পদ বেড়েছে তারা এই সময়ে ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ বাড়িয়ে নিয়েছে। আয়ের পরিমাণটা লক্ষ করার মতো। নিচের দিকে থাকা অর্ধেক আমেরিকাবাসীর (১৬ কোটি ৫০ লক্ষ) মিলিত সম্পদের থেকে ৬৬০ জন বিলিওনিয়রের সম্পদ ৬৬ শতাংশ বেশি। জেফ বেজোস, এলন মাসক, মার্ক জুখেরবার্গ এবং বিল গেটস– প্রত্যেকের সম্পদ গত দশ মাসে অভাবনীয় হারে বেড়েছে (তথ্যসূত্র : ইনইকোয়ালিটি.অর্গ)। এই বৈষম্য অর্থনীতিতে ভারসাম্যের সঙ্কট সৃষ্টি করছে।
ভারতের ধনীতম ১ শতাংশ মানুষের উপর যদি নূন্যতম ২-৩ শতাংশ কর ধার্য করা যেত তা হলে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা আদায় হত সরকারের। করোনা অতিমারিতে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষকে কিছুটা রেহাই দেওয়া যেত। কিন্তু একচেটিয়া পুঁজির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে কাজ করা বিজেপি সরকার তা করেনি। বাস্তবে বিজেপি-কংগ্রেস ও আঞ্চলিক নানা ক্ষমতালোভী দলগুলি ক্ষমতার গদিতে টিকে থাকতে আম্বানি-আদানি সহ একচেটিয়া পুঁজিপতিদেরই সেবা করছে। আর ভোট এলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আমরা গরিবদের উন্নয়ন করব। তেমনই আমেরিকায় ট্রাম্প কিংবা বাইডেন ধনকুবের বেজোস, জুখেরবার্গদের স্বার্থই দেখছে। কারণ তারা পুঁজিপতি শ্রেণিরই রাজনৈতিক ম্যানেজার। নিজেদের স্বার্থরক্ষায় ম্যানেজারদের কোনও অপদার্থতা দেখলেই বরখাস্ত করে দেবে পুঁজিপতি শ্রেণি। যে বদল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনসমক্ষে আসে। ‘গণতান্ত্রিক’ ঠাটবাটের মোড়কে নির্বাচনের মাধ্যমে এক দলকে সরিয়ে আরেক দলকে আনে তারা। তাই জনগণের ‘সেবা’ করার নামে পুঁজিমালিকদের ‘সেবা’ করার প্রতিযোগিতায় ছুটে চলেছে পুঁজিবাদের সেবক এই দলগুলি।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্র বা ব্যক্তিমালিকের হাতে থাকা উৎপাদন প্রক্রিয়ার লক্ষ্য অধিক মুনাফা হওয়ার জন্য শ্রমিক শোষণ তীব্র হতে থাকে। ফলে আমেরিকা কিংবা ভারত সমস্ত পুঁজিবাদী দেশেই গরিব আরও গরিব হয়, ধনী হয় আরও ধনী। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য পুঁজিবাদী অর্থনীতির অবশ্যম্ভাবী ফল। করোনা এই বৈষম্যের ভয়াবহ চেহারাটাকে প্রকাশ্যে এনেছে।