‘‘মনে রাখবেন, ভারতবর্ষের বিপ্লবী আন্দোলনের সামনে প্রতিক্রিয়ার বিভিন্ন শেড রয়েছে। এই প্রতিক্রিয়ার বিভিন্ন শেড সম্বন্ধে বলতে গিয়ে যা বলতে চেয়েছি, তা হল– কংগ্রেস যেমন প্রতিক্রিয়াশীল, স্বতন্ত্রও তেমন প্রতিক্রিয়াশীল, আবার তেমনি চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হল জনসংঘ। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এ কথা বোঝা যাবে, কংগ্রেসের চেয়েও জনসংঘ অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল। অথচ, অদ্ভূত দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব! আজ পর্যন্ত কোথাও সিপিআই, আর কোথাও কোথাও সিপিআই-সিপিএম, কোথাও কোথাও এসএসপি-পিএসপি আন্দোলনে নেতৃত্ব করছে। কিন্তু তারা এমন ভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রাজনৈতিক চেতনার মানটিকে গড়ে রেখেছেন যে, সাধারণ মানুষ প্রতিক্রিয়াশীল বলতে শুধু কংগ্রেসকে মনে করে। আর, অ্যান্টি কংগ্রেসিজমের সঙ্গে এই সমস্ত দলগুলো ও জনসংঘের মিল হয়ে যাওয়ার ফলে এমনকি জনসংঘকেও সাধারণ মানুষ গ্রহণ করছে প্রতিক্রিয়াশীল কংগ্রেসের বিকল্প প্রগতিশীল শক্তি হিসাবে। কিন্তু ভাবছে না, এটা কি বেটার অল্টারনেটিভ? না কি ওয়ার্স্ট অল্টারনেটিভ? বুঝতে হবে, অল্টারনেটিভটা কোন দিকের? তাই প্রতিক্রিয়ার বিভিন্ন ধারাগুলিকে খানিকটা তুলনামূলক ভাবে দেখালাম।
প্রতিক্রিয়ার এই ধারাগুলির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, সেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে বুঝে বা বিশেষ একটা প্যাটার্ন বা ছুৎমার্গতার মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত না হয়ে বাস্তবে আমাদের সেই দ্বন্দ্বের স্বরূপ নির্ধারণ করতে হবে। এই উপলব্ধি এমন হবে, যাতে তাদের কন্ট্রাডিকশন এবং কনফ্লিক্টের সুযোগ নিয়ে চরম প্রতিক্রিয়াকে পর্যুদস্ত করার মধ্য দিয়ে অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকেও খতম করে দিতে পারি এবং তার মধ্য দিয়ে প্রগতি ও বিপ্লবের রাস্তা খুলে দিতে পারি। তাই শুধু ভাসাভাসা ভাবে প্রতিক্রিয়া বললে চলবে না। প্রতিক্রিয়ার এই ভ্যারাইটি এবং এর মধ্যে স্তরে স্তরে ভাগ এবং এই পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কোনটি অপেক্ষাকৃত কম প্রতিক্রিয়াশীল সেটা দেখতে হবে। কখনও অবস্থা বিশেষে চরম প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে আর একটা অপেক্ষাকৃত কম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ব্যবহার করার প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে। এ কথাটা আজই হয়তো বাস্তব নয়। আজ রুলিং পার্টি হিসাবে কংগ্রেস দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দুদিন বাদেই কংগ্রেস রুলিং পার্টি থেকে নেমে এলে এবং জনসংঘ বা ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি রুলিং পার্টি হিসাবে অপারেট করতে থাকলে এ হয়তো একটা বাস্তব রাজনীতি হয়ে দেখা দিতে পারে। যদিও সাথে সাথে এ কথাও মনে রাখতে হবে, তা যেন সুবিধাবাদের দ্বারা এবং নিছক নির্বাচনসর্বস্ব রাজনীতির কিছু ডিভিডেন্ড পাওয়ার স্বার্থে পরিচালিত না হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবে যে কন্ট্রাডিকশনগুলি রয়েছে তাকে বিশ্লেষণ করে বিপ্লবীরা যদি এগোতে চায়, কেবলমাত্র মনগড়া তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে না চায়, তা হলে তাদের এই কন্ট্রাডিকশনগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। আর, এই সমস্ত প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করতে হলে চাই আদর্শের জয়ডঙ্কা অর্থাৎ আন্দোলনের উপর আদর্শগত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং জনতার মধ্যে সুদৃঢ়ভাবে রাজনৈতিক স্থির লক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই রাজনৈতিক স্থির লক্ষ্য এবং আদর্শবাদ প্রতিষ্ঠার সামনে আজ প্রধান বাধা হল তারাই, যারা আদর্শকে গুলিয়ে দিচ্ছে, প্রগতির আদর্শকে যারা গুলিয়ে দিচ্ছে, বিপ্লবের কথা বলতে বলতেই যারা বিপ্লব থেকে জনতার মানসিকতাকে অন্য দিকে ডাইভার্ট করে দিচ্ছে– এদেরকেই আমরা বলি, ফোর্সেস অফ কমপ্রোমাইজ বিটুইন লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী শক্তি এবং প্রতিক্রিয়ার শক্তির মধ্যে আপসমুখী শক্তি– যারা মুখে বিপ্লবের কথা বলে, কিন্তু আসলে শ্রমিকশ্রেণি বা বিপ্লবী জনসাধারণের আন্দোলনটাকেই বিভ্রান্ত করে দেয়। খেয়াল রাখতে হবে, তারা কিন্তু প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে কাজ করে না, মূলত কাজ করে বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে থেকেই। এটাকেই ফোর্সেস অব কমপ্রোমাইজ বলেছেন লেনিন।
মার্কসবাদী আন্দোলনে দেখা গেছে সোসাল ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় যাবার আগে পর্যন্ত প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে কাজ করে না, ক্ষমতায় গিয়েও প্রথম প্রথম করে না। তারপর জনতার কাছ থেকে যত বাতিল হতে থাকে, তত তারা প্রতিক্রিয়ার দিকে যায়। তাদের প্রধান কর্মকাণ্ড হয়ে দাঁড়ায় আপসের মাধ্যমে বিপ্লবী শক্তির মধ্যে ভাঙন ধরানো। আবারও বলছি, তারা আপসকামী শক্তি হিসাবে কাজ করে। সেইজন্য এর নাম দেওয়া হয়েছে ফোর্সেস অ্যান্ড পার্টিজ অব কমপ্রোমাইজ। এ দেশে সিপিএম এবং সিপিআই এই দুটি পার্টি হল নানা ধরনের সোসাল ডেমোক্রেসির মধ্যে সবচেয়ে সুসংহত পার্টি। এইরকম দুটি দুর্ধর্ষ সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, কমিউনিজমকে মুখোশ বানিয়ে, ফোর্সেস অফ কমপ্রোমাইজ হিসাবে রেভলিউশনারি মুভমেন্টের মধ্যে কাজ করছে। এরা ভিতর থেকে মজুরশ্রেণির বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করে এবং তাকে বিপ্লবের পথ থেকে বিভ্রান্ত করে বিপ্লবেরই বুলির আড়ালে। এরাই শোধনবাদী। আগেই এদের সম্পর্কে আলোচনা করেছি। তা হলে জনতাকে যদি প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে শেষ সংগ্রামের দিকে সংহত অবস্থায় নিয়ে যেতে হয়, তা হলে আদর্শগত সংগ্রামের ক্ষেত্রে এই শোধনবাদকে আমাদের সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করতে হবে। যদি আমরা তা করতে না পারি, তা হলে শেষ লড়াইতে আমরা জিততে পারব না। অর্থাৎ জনতাকে একটা রাজনৈতিক শক্তিতে আমরা পর্যবসিত করে বিপ্লব সম্পন্ন করতে পারব না।
এ কথা ঠিক, জনতা সবসময়েই সংগ্রামের শক্তি। কিন্তু সংগ্রাম এসে গেলেই সেই জনতা রাজনৈতিক শক্তিতে আপনাআপনি পর্যবসিত হয় না। জনতা যখন রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তিতে নিজের নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, তখনই সে পরিণত হয় একটা রাজনৈতিক শক্তিতে। তার আগে পর্যন্ত জনতা রাজনৈতিক শক্তিগুলির দ্বারা ইনস্ট্রুমেন্ট হিসাবে উলুখাগড়ার মতো ব্যবহৃত হয় এবং নানা ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো তার দ্বারা ফয়দা ওঠায়।
তাই জনসাধারণকে যদি একটা দৃঢ় রাজনৈতিক শক্তিতে পর্যবসিত করতে হয়, তা হলে প্রতি মুহূর্তে শোধনবাদের বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশ ও নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। শোধনবাদের বিরুদ্ধে আদর্শ ও তত্ত্বগত, কর্মধারা ও কর্মসূচিগত, আন্দোলন পরিচালনার কৌশলগত লড়াই এড়িয়ে গিয়ে আমরা কোনও ভাবেই শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হতে পারি না। প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইতে যদি আমরা জয়যুক্ত হতে চাই, তা হলে আদর্শগত সংগ্রামের ক্ষেত্রে এই শোধনবাদীদের রাজনৈতিক চরিত্র এবং আদর্শগত চরিত্র উদঘাটন না করে আমরা তা কিছুতেই করতে পারি না।”
(‘সোসাল ডেমোক্রেসিকে পরাস্ত করেই বিপ্লবী দলকে এগোতে হয়’ বই থেকে । ১৯৬৯ সালে প্রদত্ত ভাষণ)