সকালবেলায় মনাদার চায়ের দোকানের বেঞ্চটায় বসতে গিয়ে দেখি পাশেই খবরের কাগজে চোখ রেখে বসে আছেন অসীমবাবু। পাড়াতেই থাকেন। মাঝেমধ্যেই নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। আমাকে দেখে বললেন, তরুণবাবু, ভালই হয়েছে আপনার সাথে দেখা হয়ে। আপনি তো খোঁজখবর রাখেন।
বোঝার চেষ্টা করলাম তিনি কীসের খোঁজ করছেন।
বললেন, কী বুঝছেন বলুন দেখি।
কীসের?
কীসের? এখন তো একটাই বিষয়– সরকার কারা গড়বে?
তারপর নিজেই খবরের কাগজটা দেখিয়ে অসীমবাবু বললেন, দেখছেন তো সব। ঘেন্না ধরে গেল মশাই রাজনীতির প্রতি। এর নাম রাজনীতি! ছ্যা, ছ্যা।
ভদ্রলোক কথাগুলো টানা বলে গেলেন। ভেতরে জমা রাগ, ক্ষোভ, অভিমান বেরিয়ে আসছিল যেন স্রোতের মতো।
আমি মৃদু হেসে বললাম, আমি আর আপনার প্রশ্নের কী উত্তর দেব? উত্তর তো আপনি নিজেই দিয়ে দিয়েছেন।
মনে হল ভদ্রলোক যেন একটু দম নিলেন। বললেন, কিন্তু সরকার তো কেউ না কেউ করবে। আমি জানতে চাইছি সেটা কে?
আমি বললাম, ঠিকই তো। সরকার তো নিশ্চয় কেউ না কেউ করবে। ভোট তো হয় সরকার গড়ার জন্যেই। আপনি বলুন না, আপনি কাকে চাইছেন?
অসীমবাবু যেন একটু থমকে গেলেন। বললেন, আমি?
বললাম, হ্যাঁ, আপনি।
একটু ভেবে নিয়ে বললেন, দেখুন, আমার কথা যদি বলেন, তবে আমি চাই এমন একটা সরকার, যে এইসব নোংরামি করবে না, জিনিসপত্রের দাম কমাবে, বেকার ছেলেমেয়েদের কাজের ব্যবস্থা করবে।
অসীমবাবুর এক ছেলে আর এক মেয়ে। দুজনেই ইউনিভার্সিটি পাশ করে বেকার বসে রয়েছে। বললাম, নোংরামি বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন? ভোটে দাঁড়ানোর জন্য এক দল থেকে রাতারাতি আর এক দলে যোগ দেওয়া, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, বিরোধীপক্ষকে লক্ষ্য করে গালিগালাজ করা, হুমকি দেওয়া– এইগুলো তো?
বললেন, একদম ঠিক। এইগুলোই।
বললাম, আপনিই বলুন না, এ দলগুলোর মধ্যে কে সরকার গড়লে এইসব করবে না?
বললেন, এই তো বেশ মুশকিলে ফেললেন। এদের মধ্যে তেমন কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না।
বললাম, তবু আপনি এদেরই কাউকে সরকারে দেখতে চান তো?
অসীমবাবু একটু কাঁচুমাঁচু হয়ে বললেন, উপায় কী বলুন, সরকার তো চাই!
আমি বললাম, কেন? এমন কি কখনও হয়েছে, ভোট হয়েছে অথচ সরকার হয়নি? ফলে সরকার হবেই। আপনি তা নিয়ে চিন্তা করছেন কেন? আপনার সমস্যাটা তো সরকার গড়া নিয়ে নয়। আপনি তো আসলে এমন একটা সরকার চান, যে সরকার স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ একটা প্রশাসন দেবে। আপনার জীবনের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবে। আপনার উপর মূল্যবৃদ্ধি কিংবা করের বোঝা চাপিয়ে দেবে না।
বললেন, হ্যাঁ, ঠিকই।
আমি বললাম, তা হলে এরা কেউই যদি তেমন সরকার দিতে না পারে তবে তো আপনার দায়িত্ব যারা ভোটে লড়ছে তাদের মধ্যে এমন কারও খোঁজ করা, যারা আপনাকে এমন একটা সরকার দিতে পারে।
অসীমবাবু আবার একটু যেন ভাবলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আপনারা কতগুলো প্রার্থী দিয়েছেন?
বললাম, ১৯৬টা। আরও কয়েকটা বাড়তে পারে।
আপনাদের তো জানি। আপনারাই একমাত্র মানুষের জন্য লড়াই করেন। আপনাদের কর্মীরা নিঃস্বার্থে কাজ করেন। কিন্তু আপনারা কি জিততে পারবেন? সরকার গড়তে পারবেন?
দেখুন, অনেকেই এই প্রশ্নটা করেন। অথচ আমি জানি, শুধু আপনি নন, আপনার মতো বেশির ভাগ মানুষই চান একটা স্বচ্ছ সরকার। আপনার মতো তাঁরাও সবাই যদি চান সৎ, নীতিবান, জনস্বার্থে লড়াকু প্রার্থীরা জয়ী হোক, তা হলেই আমার জিততে পারব। আর সরকার গড়ার জন্য তো দরকার ১৪৮ জন বিধায়ক। আমরা তো তার থেকে অনেক বেশি আসনে প্রার্থী দিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস জনগণ তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে সত্যটা ঠিক ধরতে পারবে এবং আমাদের সমর্থন করবে।
কিন্তু মিডিয়া তো ওই দু-তিনটে দলকে নিয়েই প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে!
ঠিকই তো। ওই দলগুলো যে শ্রেণির স্বার্থে কাজ করে সেই পুঁজিপতিরাই তো এই সব মিডিয়ার মালিক। তারা কেন জনগণের স্বার্থে লড়াই করা একটি দলের প্রচার দিতে যাবে! তারা ওই পেটোয়া দলগুলোর প্রচার দিয়ে, কারা ক’টি আসনে জিতবে তা পর্যন্ত বলে বলে মানুষের মধ্যে ওদের পক্ষে একটা সমর্থন গড়ে তুলছে। কিন্তু কোনও রকম বিচার না করে, শুধু প্রচারের ঢাকের আওয়াজে ভুলে ওই দলগুলোকে সমর্থন করলে দুর্নীতিগ্রস্ত, অসৎ, লোভী, ধান্দাবাজরাই জয়ী হবে, তারাই সরকার গড়বে। কিন্তু তাতে তো আপনার কোনও সুবিধা হবে না! তেমন সরকার তো স্বাধীনতার পর থেকে একটার পর একটা হয়েই চলেছে। তেমন সরকারের অভাব তো রাজ্যে কিংবা দেশে কখনও হয়নি। এ রাজ্যে কখনও কংগ্রেস, কখনও সিপিএম, কখনও তৃণমূল, রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি– প্রতিটি ভোটে তারাই কেউ না কেউ জয়ী হয়েছে, আর প্রতিটি ভোটেই আপনি হেরেছেন, আপনার মতো সব সাধারণ মানুষ হেরেছে। সেই একই ভুল কি চলতেই থাকবে?
অসীমবাবু ধীরে ধীরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, আসলে কী জানেন, হেরে যাওয়ার দলে থাকতে কখনও মন চায় না।
– ঠিকই তো পরাজিতের দলে কেন থাকবেন? থাকা উচিত নয় তো। কিন্তু যতবারই আপনি ভেবেছেন আপনি জয়ীর দলে আছেন, ততবারই শেষপর্যন্ত আপনি পরাজিতের দলেই থেকে গেছেন। আপনি আসলে ভেবে উঠতে পারেননি– আসলে কোনটা আপনার জয় আর কোনটা আপনার পরাজয়।
বললাম, মন শক্ত করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, এবার আর পরাজিতের দলে থাকবেন না। শুধু বুঝে নিন, আপনার কাছে কোনটা সত্যিকারের জয় আর কোনটা সতিকারের পরাজয়। যে দলটি সত্যিই আপনার হয়ে লড়াই করছে, তার জয়ই আসলে আপনার জয়, তার শক্তিবৃদ্ধিতেই আপনার শক্তিবৃদ্ধি। তার যদি একজন প্রার্থীও জয়ী হন তবে তিনি একাই এই সব দুষ্টশক্তির বিরুদ্ধে জনগণের স্বার্থ নিয়ে বিধানসভার ভিতরে বাঘের মতো লড়াই করবেন। অতীতে যেমন সুবোধ ব্যানার্জী করেছিলেন, দেবপ্রসাদ সরকার, প্রবোধ পুরকায়েত, তরুণ নস্কর, জয়কৃষ্ণ হালদাররা করেছিলেন। পার্লামেন্টে তরুণ মণ্ডল করেছিলেন।
অসীমবাবু চুপ করে রইলেন। মনে হল কথাগুলো তার এতদিনের চেনা ভাবনাটাকে ওলটপালট করে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে তিনি বললেন, এমন করে তো কখনও ভাবিনি। আমি বললাম, মনাদা, আর একবার দুটো চা দিন। সঙ্গে দুটো বিস্কুট।