শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, চিকিৎসক, নার্স সহ বিভিন্ন পেশার কর্মচারীদের নিয়ে গড়ে ওঠা সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ কলকাতার শহিদ মিনারে একটানা ধর্না চালিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত কর্মচারীদের জন্য ন্যায্য হারে ডিএ, সরকারি সমস্ত দপ্তরে শূন্যপদে স্বচ্ছতার সঙ্গে স্থায়ী নিয়োগের দাবিতে তাঁদের এই আন্দোলনকে কটাক্ষ করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের চোর-ডাকাত বলে যে ভাষায় আক্রমণ করেছেন, তার প্রতিবাদে ৩০ মার্চ শহিদ মিনারে যেন জনজোয়ার দেখা যায়। তার আগে মহামিছিলে সামিল হন কর্মচারীরা।
ওই দিন শহিদ মিনারের সমাবেশে মঞ্চের নেতৃবৃন্দের আহ্বানে উপস্থিত হয়েছিলেন, এস ইউ সি আই (সি)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও প্রাক্তন বিধায়ক কমরেড তরুণকান্তি নস্কর। অন্যান্য বামপন্থী নেতৃবৃন্দও ওই দিন মঞ্চে উপস্থিত হন।
কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যের ভাষণের শুরুতেই শহিদ মিনার ময়দানের বিশাল জমায়েত তাঁর সাথে গলা মিলিয়ে স্লোগান তোলে– এই সংগ্রাম চলছে চলবে। কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেন, এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)-এর পক্ষ থেকে এ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছি আমরা। ১০ মার্চ আপনাদের ডাকা ধর্মঘট সফল করতে আমরা একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত প্রচার করেছি। কিন্তু এই মঞ্চে আমরা রাজনৈতিক প্রচার করতে আসিনি। গতকাল আন্দোলনকারী শিক্ষক, নার্স, সরকারি কর্মচারী সহ বিশিষ্ট মানুষজনদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তার পর আজ না এসে পারলাম না। একদিকে মুখ্যমন্ত্রীর এই আচরণের তীব্র প্রতিবাদ এবং নিন্দা করতে, আর একদিকে আপনাদের যে আন্দোলনকে এতদিন সমর্থন জানিয়ে এসেছি তা আরও বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপনাদের যে পরিকল্পনা, তার সঙ্গে গলা মেলাতে– আপনাদের মতো আমিও স্লোগান তুললাম।
স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে এই শহিদ মিনার ময়দানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিজলি জেলে বন্দিদের হত্যার বিরুদ্ধে মিটিং করেছিলেন। এই পশ্চিমবাংলায় শিক্ষকতার আদর্শ হিসেবে আমরা পেয়েছি বিদ্যাসাগরকে। আজও সমাজে শিক্ষকদের যে শ্রদ্ধা ভালবাসার আসন আছে তাঁদেরও ‘চোর’ বলে যারা অভিহিত করেন, তাদের কোনও ভাবেই আমরা ক্ষমা করতে পারি না। তাই আমরা গতকালই দাবি তুলেছি এর জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।
কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেন, সাধারণ মানুষ লড়াই করেই জেতে। অনেকে মনে করেন যেন ভোটের মধ্যে দিয়ে এক দলের বদলে অন্যকে জিতিয়ে দিলেই মানুষ জিতে যায়। না, মানুষ লড়াই করেই জেতে। বিগত দিনে শিক্ষা সহ অন্যান্য দাবিতে লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই মানুষ দাবি আদায় করতে পেরেছে। বলুন হ্যাঁ, কি না? বিশাল জনসমাগম সমস্বরে উত্তর দেয়– হ্যাঁ।
তিনি বলেন, লড়াই হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী। আপনারা যত চলেছেন, লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। সরকারের হাতে যতই পুলিশ থাকুক, মানুষ সংগঠিত হলে পুলিশ প্রশাসন পেছনে চলে যায়। দাবি মানতে সরকার বাধ্য হয়। তাই দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের জন্য আপনাদের কাছে আবেদন করব। আপনাদের এই সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ আজ আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছে। পশ্চিমবাংলার সকল মানুষের সমর্থন পেয়েছেন। আপনারা এই মঞ্চকে রক্ষা করুন। এর যে তরঙ্গ তাকে রক্ষা করুন। জেলায় জেলায়, ব্লকে ব্লকে সংগঠিত শক্তি গড়ে তুলুন, যাতে সরকারের পুলিশ প্রশাসন আন্দোলন ভাঙার কোনও রকম সুযোগ পেতে না পারে। বেকারত্ব দূর করা সহ বিভিন্ন দাবিতে লড়াইকে শক্তিশালী করতে গেলে উপরের আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল স্তরে সংগঠিত শক্তি চাই।
শিক্ষক মহাশয়দের এই অপমান– আমাদের দেশের নবজাগরণ, রামমোহন থেকে নজরুল সকল মনীষীর প্রতি অবমাননা। সরকারি কর্মচারী যারা সরকারকে টিকিয়ে রাখে, যারা শিক্ষিত বিদ্বজ্জন, নার্স বা ডাক্তার যারা, আপনাদের সঙ্গে যে সমস্ত মানুষ বা কর্মচারীবৃন্দ যুক্ত হয়েছেন, তাদের অসম্মান করার অধিকার কারও নেই। মুখ্যমন্ত্রীর এত রাগ কেন? রাগ প্রকাশের মধ্যেই রয়েছে– তিনি ভয় পেয়েছেন, দুর্বল হয়েছেন। তিনি দেখতে পাচ্ছেন চোখের সামনে মানুষের মধ্যে এক প্রবল বিক্ষোভ।
আবার বলব, বিক্ষোভকে আপনারা দীর্ঘস্থায়ী রূপ যেমন দিচ্ছেন, তেমনি তাকে পাশাপাশি জেলায়, ব্লকে ছড়িয়ে দিন। তবেই সত্যিকারের মর্যাদা রক্ষা পাবে, অন্যায়ের প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই মনুষ্যত্বের আলো জ্বলে। যারা মনে করেন লড়াই করা, আন্দোলন করা হচ্ছে গণ্ডগোল।
আমরা মনে করি সে কথা মিথ্যে, সে কথা ভুল। সে কথা শাসকেরা বলে। ব্রিটিশ সরকার থেকে পরবর্তী আমলের যারা শাসক, তারা সকলেই এ ভাষাতেই কথা বলে। লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের শক্তি জাগে। মনুষ্যত্বের প্রদীপ জ্বলে। আজকের মাস্টারমশাইরা যে উদাহরণ রেখে গেলেন, তা দেখে ১৯৫৪ সালের শিক্ষক আন্দোলনের কথা মনে পড়ে। সরকার সেই আন্দোলনকে ভাঙতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। আজ সরকার মাস্টারমশাইদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে, কিন্তু তাতে আরও বেশি মানুষ মাস্টারমশাইদের শ্রদ্ধা করছেন।
কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেন, আপনাদের সামনে রয়েছে সাতশো দিনেরও বেশি ধর্না চালিয়ে যাওয়া চাকরিতে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েও বঞ্চিত সেই যুবক-যুবতীরা, যাদের বঞ্চিত করে, লুটপাট করে শিক্ষায় দুর্নীতি চলেছে। সরকারের মন্ত্রী বলেছেন, এঁরা তো চাকরি করেন। তাহলে এঁদের আবার ডিএ দেব কেন? সাধারণ মানুষকে দেব। আমি এই প্রশ্ন করতে চাই, সাধারণ মানুষ কি এই তৃণমূল সরকারের কাছ থেকে কিছু পেয়েছে? মাস্টারমশাইরা পাননি, সরকারি কর্মচারীরা পাননি, চাষি মজুর পাননি। তার সাথে সাথে বলব সাধারণ মানুষও পাননি। সব টাকা চলে গিয়েছে কোথায়? তা আপনারা সকলেই প্রত্যক্ষ করছেন।