প্রত্যেক পরিবারেরই মাসিক খরচ এক লাফে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে সাম্প্রতিক ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধিতে। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, এক ছোট ব্যবসায়ীর খরচ বেড়েছে মাসে ৩৫০০ টাকা। এক বেসরকারি সংস্থার কর্মীর মাসিক খরচ বেড়েছে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা। অন্য পরিবারেরও খরচ অনুরূপভাবে বেড়েছে। তাঁরা পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন কীভাবে? খরচে কাটছাঁট করে। কেউ মাংস কেনা কমিয়েছেন, কেউ ফল। কোনও পরিবারে ওষুধেও কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এর পরিণাম কী? অপুষ্টি। যথাযথ চিকিৎসা না হওয়া। শেষ পর্যন্ত অকালমৃত্যু। তাই বলা হয় মূল্যবৃদ্ধি একটি নিঃশব্দ ঘাতক।
সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি মানুষের সহনসীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গত দু’সপ্তাহে বারো বার বাড়ল পেট্রল-ডিজেলের দাম। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভোজ্য তেল সহ সব খাদ্যদ্রব্যের দাম। রান্নার গ্যাস হাজার টাকা। সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছুর দাম। সরকার কী ভূমিকা পালন করছে? সরকারের দাবি ভারত-শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো ডুবন্ত অর্থনীতির দেশ নয়, দেশের কোষাগারে নাকি প্রচুর অর্থ মজুত আছে। দেশ নাকি ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু মানুষ এগোচ্ছে কোন দিকে?
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির ভুয়ো তত্ত্ব
সরকারে যে-ই থাক পেট্রোপণ্যের দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। কেন এমন মূল্যবৃদ্ধি? সরকারি বয়ান– আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে তাই দেশের বাজারে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ছে। সরকারের কিছু করার নেই, এখন বাজারই দাম নিয়ন্ত্রণ করে। এই বক্তব্য কি সঠিক? বিচার করে দেখা যাক। আন্তর্জাতিক বাজারে সারা বছর ধরে অপরিশোধিত তেলের দাম ওঠানামা করে। তাই গড় দাম ধরে আলোচনা করা যুক্তিযুক্ত। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন ক্ষমতায় বসেন তখন আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৯৩.১৭ ডলার। অর্থাৎ নয় বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি ব্যারেল প্রতি ১.৬৫ ডলার। বৃদ্ধির হার ২ শতাংশের কম।
প্রতি লিটার পেট্রলে ডিলার কমিশন ও ভ্যাট ছাড়াও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বিপুল পরিমাণে ট্যাক্স চাপায়। পশ্চিমবঙ্গে ১০০ টাকার পেট্রলে কেন্দ্র ও রাজ্য যথাক্রমে ৩১ টাকা ও ২৫ টাকা আর ডিজেলে যথাক্রমে ৩৪ টাকা আর ১৭ টাকা ট্যাক্স চাপায়। অর্থাৎ পেট্রলে প্রতি ১০০ টাকায় ৬৫ টাকাই হল কেন্দ্র ও রাজ্যের ট্যাক্স। আর ডিজেলে ১০০ টাকার মধ্যে ৪২ টাকাই হল সরকারের ট্যাক্স। তাহলে দাম কে বাড়াচ্ছে? বিশ্ববাজার, না ভারতের সরকার?
সরকার চালাতে ট্যাক্স অবশ্যই দরকার। কিন্তু তা জনগণের উপরই চাপানো হবে কেন? দেশের সিংহভাগ সম্পত্তি যাদের হাতে সেই পুঁজিপতিরা পাবে ট্যাক্স ছাড়, কোটি কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ, পুঁজিপতিদের ফেরত না দেওয়া ঋণের দায় বইছে সরকার, ট্যাক্সের টাকায়। আসলে তা বইছে জনগণ? এই যদি অবস্থা হয় তাহলে মূল্যবৃদ্ধি কিভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকবে!
পেট্রল ও ডিজেল শুধুমাত্র গাড়িতে ব্যবহৃত হয় না। পণ্যবাহী ট্রাক, ট্রেন চলে ডিজেলে। কৃষিক্ষেত্রে সেচের কাজে ডিজেল ব্যবহৃত হয়। শুধু পেট্রল-ডিজেলের দাম বেড়েছে তা তো নয়, জমিতে ব্যবহৃত ট্রাক্টর, তার প্রতিটি যন্ত্রাংশ, টায়ার, সার, বীজ, কীটনাশক, বিদ্যুৎ, সব কিছুর দাম প্রভূত পরিমাণে বেড়েছে। ফলে চাষের খরচ বেড়েছে, কিন্তু কৃষক ফসল বেচে দাম পাচ্ছে না। সরকারও এমএসপি বাড়াচ্ছে না। ফলে ঋণগ্রস্ত কৃষক, অভাবী কৃষকের আত্মহত্যার মিছিল বাড়ছে। অথচ বাজারে সবজি তরকারি আলু পেঁয়াজ তেল মাছ মাংস ডিম ফল সহ সমস্ত খাদ্যদ্রব্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
কতটা মূল্যবৃদ্ধি
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় বসার সময় মানুষ যে টাকায় এক কিলো আটা কিন্তু আজ সেই টাকায় পাওয়া যাবে মাত্র ৪৫০ গ্রাম। এক কিলো চাল কিনতে তখনযে টাকা লাগতো আজ সেই টাকায় পাওয়া যায় মাত্র ২২৫ গ্রাম চাল । ১ কেজি আলু বা পেঁয়াজ কিনতে তখন যত টাকা লাগত সেই টাকায় এখন পাওয়া যাবে মাত্র ৫০০ গ্রাম। আচ্ছে দিন আনার কথা বলেমোদী যখন ক্ষমতায় বসছেন তখন একটা গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ছিল ৪১০.৫০ টাকা। আর এখন তার দাম প্রায় হাজার টাকা। স্কুল ফি-ও বেড়েছে ১০৫ শতাংশ, কলেজে ফি বেড়েছে ৩০০ শতাংশ। এছাড়া পড়াশোনার অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি তো আছেই। বিদ্যুতের খরচও ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। তার উপরে অতি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ৮০০টি অতি প্রয়োজনীয় ও জীবনদায়ী ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিল। প্রায় প্রতিদিন একটু একটু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা জিনিসের দাম বাড়তে বাড়তে আজ প্রায় ১০৫ শতাংশ থেকে ৩৫০ শতাংশ বৃদ্ধিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে পুঁজিবাদী আর্থিক সংস্কার ও লকডাউনের জেরে বেশিরভাগ মানুষের আয় তলানিতে। প্রতিদিন বেকারত্বের গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। যারা কাজ করছে তাদের কখন কাজ চলে যাবে কেউ জানে না। সেই সময় আপনি যখন বাজারে জিনিস কিনতে যাচ্ছেন তখন দেখছেন গত মাসে যে টাকায় সংসার চালিয়েছিলেন এ মাসে সেই একই টাকার সংসার চালাতে পারছেন না। অথচ মূল্যবৃদ্ধি সরকারের কোনও চিন্তার বিষয় নয়। দুর্নীতি বেকারি রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এর মতোই মূল্যবৃদ্ধিও আজ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এক অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে যেখানে প্রতিদিনই তা বাড়ছে তো বাড়ছেই। জনতার অবস্থা ধীরে ধীরে প্রবল সংকটগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অসাম্য অতিকায় আকার ধারণ করছে। অপুষ্টি বাড়ছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। অপর দিকে মুষ্টিমেয়র ধন-সম্পদ ক্রমাগত বাড়ছে। বাড়ছে সাংসদ বিধায়কদের জন্য খরচ। যে সমস্ত সাংসদ বিধায়করা জনতার ভোটে পরাজিত হয়ে প্রাক্তন তাদেরও অবসরকালীন ভাতা, পেনশন, নানা সুবিধা, প্রশাসনিক নানা খরচ, সরকারি সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ, মন্ত্রী- সাংসদ-বিধায়কদের পিছনে গাড়ির সংখ্যা, তাঁদের নিরাপত্তার পিছনে বিপুল পরিমাণ খরচ ক্রমাগত বাড়ছে।
কেন মূল্যবৃদ্ধি
এই ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার সরকারি নীতি, তাদের মুনাফা ক্রমাগত বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার নীতি। আগেই দেখানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারের দাম কমা বাড়ানো নয়, সরকারি নীতিই পেট্রোপণ্যের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী। দেশে তো খাদ্যপণ্যের কোনও অভাব নেই, করোনা অতিমারির সময় সরকার ঘোষণা করেছিল, দেশে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য মজুত আছে। সরকার খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি করছে। তাহলে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে কেন? খাদ্যদ্রব্যের এই ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণ মজুতদারি ও কালোবাজারি। বিজেপি সরকারের আমলে তা আরও বেড়েছে। এই ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি রুখতে সরকার কি পারত না আরও কঠোর হাতে আইন প্রয়োগ করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দামের উর্ধ্বসীমা বেঁধে দিতে। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি চালাতে। অসাধু কালোবাজারি ও মজুতদারদের কঠোর শাস্তি দিতে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্য সরকারের দায়ও কিছু কম নয়। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে গঠিত রাজ্য টাস্কফোর্সের কী টাস্ক তা জনগণ দেখতেই পায় না। প্রশ্ন উঠছে এই ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির দুর্দিনে কোথায় সরকার? কোথায় গেল রাজ্যের মানুষকে সুশাসন দেওয়ার মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি? কোথায় গেল কেন্দ্রীয় সরকারের আইন?
আসলে এই দেশের মধ্যে দেশ দুটি, একটি ধনীর অপরটি গরিবের। রাজনীতিও দুটি। একটি ধনীর স্বার্থরক্ষার রাজনীতি, তার নাম সংসদীয় গণতন্ত্র।ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের রাজনীতি। এর দ্বারা পুঁজিপতিরা ঠিক করে কোন দল আগামী পাঁচ বছর ক্ষমতায় গিয়ে পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করতে জনগণের উপর মূল্যবৃদ্ধির খাঁড়া নামিয়ে আনবে। এই ব্যবস্থায় দেশের আসল মালিক পুঁজিপতিদের, কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করে সরকারি দলগুলি। আর বাকি নিরানব্বই শতাংশ খেটে খাওয়া মানুষ তারা মারা গেল, না বাঁচল, তাতে সরকারের কিছুই যায় আসে না। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে নয়, তারা ব্যস্ত খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় বৃহৎ পুঁজির মালিকদের প্রবেশের ঢালাও সুযোগ করে দিতে। তার জন্য আইন বদলাতে। এই অসহনীয় পরিস্থিতির অবসানের দাবিতে, খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনের অধিকারগুলি রক্ষার জন্য, দাবিগুলি আদায় করার জন্য, মূল্যবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য গণআন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনও পথ নেই।