২৪ জুন নবান্নতে এক প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ হকার এবং ঝুপড়ি ও কলোনিবাসীদের বেআইনি আখ্যা দিয়ে হুঙ্কার ছেড়েছেন। একই সাথে তিনি যে ভাবে কাউন্সিলর, পুলিশ এমনকি মন্ত্রীদের বিরুদ্ধেও জবরদখলে মদত দেওয়া, টাকা নিয়ে ফুটপাথ, জমি দখল করতে দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন তা চমক সৃষ্টি করেছে মানুষের মনে।
প্রশ্ন হল, মুখ্যমন্ত্রী কি এ সব কিছুই জানতেন না, নাকি শহরাঞ্চলের উচ্চমধ্যবিত্ত এবং কর্পোরেট মালিকদের আস্থা অর্জনে এ তাঁর নতুন চমক? একই সাথে তিনি যে ভাবে হকার ও সরকারি জমিতে বসবাসকারী মানুষকে স্থানীয় ও বহিরাগত হিসাবে ভাগ করতে চেয়েছেন, তাতে তাঁর ভোট রাজনীতির লক্ষ্যটা স্পষ্ট হয়ে যায়। দেখা গেল, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য শুনেই কোনও রকম বিভাগীয় নির্দেশনামা ছাড়াই পুলিশ প্রশাসন সেই মুহূর্ত থেকেই অতি সক্রিয় হয়ে উঠে কলকাতা সহ রাজ্যের নানা জায়গায় হকার উচ্ছেদ শুরু করে দিল। বুলডোজার দিয়ে দোকান ভেঙে দেওয়া, পণ্যসামগ্রী লুট করে নিয়ে যাওয়া, এমনকি ঝুপড়িবাসীদের উচ্ছেদেও পুলিশ নেমে পড়ল।
যখন সারা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও বেকার সমস্যা ভয়াবহ আকার নিয়েছে, তখন হাজার হাজার মানুষকে তাঁদের জীবিকা ও বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হলে এক মারাত্মক সামাজিক সংকট যে নেমে আসতে পারে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি মধ্যবিত্ত থেকে গরিব খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের। তাঁরা সরকারের এই আকস্মিক ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রতিবাদ করছেন। পথচারীর পথচলার পরিসর, যানবাহনের চলার পরিসর বজায় রাখা যেমন জরুরি, তেমনই এই হাজার হাজার পরিবারের মুখের গ্রাস রক্ষার প্রশ্ন কোনও সভ্য দেশের সরকার কোনও যুক্তিতেই এড়িয়ে যেতে পারে না।
সঙ্গত কারণেই কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় হকাররা সংগঠিত ভাবে উচ্ছেদের প্রতিরোধে নেমেছেন। ২৫ জুন সিউড়িতে পুলিশ বুলডোজার নিয়ে হকার উচ্ছেদ করতে গেলে অল বেঙ্গল হকার্স ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। জেলা পরিষদের অফিস ঘেরাও করেন। বাধ্য হয়ে প্রশাসন উচ্ছেদ স্থগিত রাখে। ২৬ জুন মহাকরণে হকার সংগঠনগুলির সাথে সরকারের মিটিং চলার সময়েই আবার বীরভূমের প্রশাসন উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে অল বেঙ্গল হকার ইউনিয়নের সভাপতি কমরেড মধুসূদন বেরা ও বীরভূম জেলা হকার ইউনিয়নের সম্পাদক কমরেড মানস সিংহের নেতৃত্বে হকাররা ডিএম অফিসের সামনে রাস্তা অবরোধ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং ডিএম-এসডিও-কে স্মারকলিপি দেন।
প্রতিরোধ গড়ে ওঠে মালদা জেলার চাঁচলে, দক্ষিণ ২৪ পরগণার মথুরাপুরে। অন্য জেলাতেও হকাররা প্রতিবাদে নামেন। সাধারণ মানুষের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও হকারদের প্রতিরোধের সামনে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী ২৬ জুন বলেন, তিনি হকার উচ্ছেদের জন্য বুলডোজার ব্যবহারের পক্ষে নন। হকারদের একটি কার্ড করে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এক মাস পরে তিনি সমস্ত বিষয়টি দেখবেন বলে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি ঘোষণা করেন। এক মাসের মধ্যে কমিটি সার্ভে করবে এবং বেআইনি জবরদখলকারীদের চিহ্নিত করে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। প্রশ্ন উঠছে, তিন দিন পর মুখ্যমন্ত্রীর এই কথার আগেই যে সব হকার ও ঝুপড়িবাসীদের উচ্ছেদ করা হল, জিনিসপত্র লুঠ হয়ে গেল তাদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
মুখ্যমন্ত্রী হকারদের ‘বেআইনি’ বললেও আসলে তাঁর সরকারের প্রশাসন ও পুলিশই বেআইনি কাজ করে চলেছে। ২০১৪ সালে তৈরি হকার আইন ‘প্রোটেকশন অফ লাইভলিহুড অ্যান্ড রেগুলেশনে’ সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা আছে– এক বছরের মধ্যে প্রতিটি রাজ্য সরকার রাজ্যের হকার বিধি প্রণয়ন করবে, ফুটপাতের এক-তৃতীয়াংশ স্থান নিয়ে হকাররা কেনাবেচা করতে পারবেন, হকারদের নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য ৪০ শতাংশ হকার প্রতিনিধি নিয়ে টাউন ভেন্ডিং কমিটি গঠন করা হবে। এই টাউন ভেন্ডিং কমিটি সার্ভে করে হকারদের পরিচয়পত্র দেবে। বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা না করে হকার উচ্ছেদ করা যাবে না। অথচ ১০ বছরেও সার্ভে হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী এখন এক মাসে এই কাজ শেষ করবেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
২০১৬-তে মহাকরণের রোটান্ডায় নগর উন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও তাঁর আধিকারিকের উপস্থিতিতে এক সভায় হকার সংগঠনগুলির প্রতিনিধিদের কাছে নগর উন্নয়ন দপ্তরের সেক্রেটারি একটি খসড়া বিধি পড়ে শোনান। কিন্তু সেই বিধির কপি উপস্থিত প্রতিনিধিদের হাতে না দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মতামত দিতে বলেন। স্বাভাবিক কারণেই প্রতিনিধিরা এই খসড়া প্রত্যাখ্যান করেন এবং খসড়ার প্রতিলিপি দেওয়ার জন্য দাবি করেন। আজ পর্যন্ত সেই বিধির কোনও কপি কোনও সংগঠনকে সরকারিভাবে দেওয়া হয়নি। নগর উন্নয়নমন্ত্রী তথা কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ফিরহাদ হাকিম নিজের পছন্দমতো কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধি নিয়ে টাউন ভেন্ডিং কমিটি গঠিত হল বলে ঘোষণা করলেও আজ পর্যন্ত কোনও গেজেট নোটিফিকেশন হয়নি। এআইইউটিইউসি অনুমোদিত অল বেঙ্গল হকার্স ইউনিয়ন ও কলকাতা ভ্রাম্যমাণ হকার্স ইউনিয়ন এবং এআইইউটিইউসি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি সহ সব কটি বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে টাউন ভেন্ডিং কমিটি গঠন এবং তাতে সমস্ত সংগঠনের প্রতিনিধিদের যুক্ত করার দাবি জানানো হলেও কলকাতা কর্পোরেশন আজ পর্যন্ত তার কোনও উত্তর দেয়নি। রাজ্যের কোনও জেলাতেই টাউন ভেন্ডিং কমিটি গঠন ও হকারদের পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজটি হয়নি। এই পরিচয়পত্র না থাকার কারণে করোনা অতিমারিকালে কেন্দ্রীয় সরকার প্রদত্ত দশ হাজার টাকা স্বল্প সুদে ও সহজ কিস্তিতে ঋণ থেকে রাজ্যের সমস্ত হকার বঞ্চিত থেকে গেছেন। এই সময়েও বাঁকুড়ার মাচানতলা, বর্ধমান স্টেশন, বারুইপুর, রায়দিঘি, সল্টলেক ও কলকাতায় হকার উচ্ছেদ করে সরকার। মুখ্যমন্ত্রী এখন কাউন্সিলরদের টাকা নিয়ে হকার বসানোর জন্য অভিযুক্ত করছেন, অথচ টাউন ভেন্ডিং কমিটি থাকলে হকাররা নিজ অধিকারেইসুষ্ঠুভাবে ব্যবসার সুযোগ পেতে পারতেন। পরিকল্পিতভাবে হকারদের জায়গা দিলে ফুটপাথ কিংবা রাস্তা আটকানোর প্রশ্নই উঠত না। হকারদের শাসকদলের কাছে নতজানু রাখা এবং তাদের কাছে থেকে নেতাদের তোলা আদায়ের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই কি সরকার টাউন ভেন্ডিং কমিটি গঠন করছে না? কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহ ও শহরের দারিদ্র দূরীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রকের হিসাবে হকাররা জাতীয় অর্থনীতির ৬৩ শতাংশজোগান দেন। তাঁরা সাধারণত কোনও ব্র্যান্ডেড পণ্য বিক্রি করেন না। গ্রামীণ গৃহস্থ শ্রমিকরা ছোট ছোট কুটির শিল্পে এবং ক্ষুদ্র শিল্পে যা উৎপাদন করেন মূলত সেই সমস্ত পণ্যই হকাররা সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেন। তাঁরা রাজপথে জনসাধারণের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ভরসা। পথ দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসাকেন্দে্র নিয়ে যেতেও তাঁরা এগিয়ে আসেন। এমনকি কোনও আপৎকালীন পরিস্থিতি বা বড় কোনও দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কলকাতা পুলিশ হকার নেতাদের সাহায্য চেয়ে থাকে। আজ দেশে লক্ষ লক্ষ বেকার, যার মধ্যে রয়েছে বহু উচ্চশিক্ষিত যুবক। বিভিন্ন বন্ধ কলকারখানার শ্রমিক, কর্মচ্যুত লক্ষ লক্ষ মানুষ যাঁরা পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে দূর-দূরান্তে চলে যেতেন, আজ সারা দেশে কাজের অভাবে তাঁদের একটা বড় অংশ হকারি পেশায় প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছেন। সারা দেশ জুড়ে হকারি পেশার আবশ্যকতা এবং অর্থনীতিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং সমাজে তাদের বিশেষ অবস্থান– বিষয়গুলি মাথায় রেখেই হকার আইন ২০১৪ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে টালবাহানা করে চলেছে। খুচরো ব্যবসায় বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটাতে হকার বাজারকে ধ্বংস করবার চেষ্টাই এর একমাত্র কারণ।
এই চেষ্টা বর্তমান সরকারই শুধু করেনি, অতীতে ১৯৯৬ সালে সিপিএম পরিচালিত রাজ্য সরকার অপারেশন সানসাইন-এর মধ্য দিয়ে হকার উচ্ছেদ করে দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিদের আস্থা অর্জন করতে চেয়েছিল। কলকাতার লক্ষাধিক হকারের সমস্ত সম্পদ সেদিন পুলিশ লুট করেছিল যার প্রমাণ সেই সময়কার সংবাদপত্রে পাওয়া যাবে। সেদিন মমতা ব্যানার্জী তার় বিরোধিতা করতে রাস্তায় নেমেছিলেন। আজ ক্ষমতায় থাকতে হলে তাঁর প্রয়োজন একচেটিয়া পুঁজির আশীর্বাদ। তাই রিলায়েন্স, গোয়েঙ্কাদের মতো একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের শপিং মলের ব্যবসার স্বার্থে তিনি হকারদের নিয়ন্ত্রণের নামে উচ্ছেদ করবার মতো এইরকম একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন।
এ রাজ্যের বিজেপি নেতারা ঘোলা জলে মাছ ধরতে এখন ‘বুলডোজারের সামনে দাঁড়াব’ বলে হুঙ্কার দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার রেল এবং কেন্দ্রীয় সরকার অধিকৃত এলাকাকে হকার আইনের বাইরে রেখেছেন। অথচ রেলের উপর নির্ভর করে চলে বহু ক্ষুদ্র ব্যবসা। গরিব সাধারণ মানুষের জন্য রেলপথে সামান্য টাকায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করে থাকেন হকাররা। হকার ও ছোট দোকানদারদের উচ্ছেদ করে কেন্দ্রীয় সরকার রেলের জমি বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিতে চাইছে। রেলের প্ল্যাটফর্মগুলিতে সৌন্দর্যায়নের নামে হকার উচ্ছেদ করে খাবার সহ বহু পরিষেবাকেই বড় বড় পুঁজিমালিকদের হাতে তুলে দিচ্ছে। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ যাঁরা হকারি করে সংসার চালান তাঁরা রেলে কিংবা শহরের রাস্তায় সর্বত্রই কেন্দে্র বা রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও পুলিশ-প্রশাসনের তোলাবাজির অসহায় শিকার। এর বিরুদ্ধে আজ শুধু হকাররাই নয়, সমাজের সমস্ত স্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। আজ সব স্তরের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে আছে হকারদের জীবিকা রক্ষা ও পথচারীদের চলার পরিসর বজায় রাখার জন্য সরকারকে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে বাধ্য করার বিষয়টি।
প্যালেস্টাইনের উপর ইজরায়েলের হামলা বন্ধের দাবিতে শিলিগুড়িতে বিক্ষোভ
গত অক্টোবর মাস থেকে প্যালেস্টাইনের উপর একতরফাভাবে ইজরায়েলের ধারাবাহিক আক্রমণে শিশু সহ হাজার হাজার নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করার বিরুদ্ধে কলকাতায় বামপন্থী দলগুলির প্রতিবাদের পাশাপাশি শিলিগুড়িতেও ২৬ জুন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। শহর জুড়ে মিছিল এবং ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহুর কুশপুতুল পোড়ানো হয়। কুশপুতুলে অগ্নিসংযোগ করেন জেলা সম্পাদক কমরেড গৌতম ভট্টাচার্য।