অস্ত্র ব্যবসার বড় খদ্দের বলেই মোদিজির এত খাতির আমেরিকায়

অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে সাড়ম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি আমেরিকা ঘুরে এলেন। তাঁর এই সফর নিয়ে বিজেপির আইটি সেল সহ একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন মিডিয়া হাউস খুবই উচ্ছ্বসিত। তারা এমন একটা ভাব করছে যেন মোদিজি একটা অতুল কীর্তির অধিকারী হলেন এবং দেশের মানুষের এক মহা উপকার হল। যেন এর আগে আর কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা সফর করেননি। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনও খুবই সমাদর দেখালেন মোদিকে। মোদি আবার সরকারি খরচে চল্লিশ লক্ষ টাকা দামের হীরের আংটি সহ অন্যান্য মূল্যবান উপহারও দিয়েছেন বাইডেন দম্পতিকে। একেবারে মহোৎসবের মতো আনন্দ উৎসব, খানাপিনা সেলফি তোলার সমারোহ চলল দুই দেশের শাসকদের মধ্যে।

আমেরিকার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্রপ্রধানদের যে বিশেষ ধরনের রাজকীয় ভোজসভায় আপ্যায়িত করা হয়, সেইরকম ভোজসভায় মোদিকে আপ্যায়ন করলেন বাইডেন সাহেব এবং গোটা আমেরিকা জুড়ে সেই অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি পর্যন্ত সাড়ম্বরে প্রচার করা হল। কিন্তু কী এমন জরুরি প্রয়োজন ছিল ভারত সরকারের এই সফরের এবং আমেরিকান শাসকরাই বা ভারতীয় পুঁজিবাদের বর্তমান বিশ্বস্ততম সেবাদাস নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত এবং গদগদ কেন?

চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতকে পাশে চায় আমেরিকা

স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বিকাশোন্মুখ ভারতীয় পুঁজিবাদ বৃহৎ ও পরিকাঠামোগত শিল্পগঠনের জন্য আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রেখে চলত। আবার আমেরিকা তখন দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত মিত্র ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার জন্য সহায়তা করত। ভারতীয় পুঁজিবাদী শাসককুল আবার প্রয়োজনে আমেরিকা ও ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলোর থেকেও সহায়তা নিয়ে বিশ্ব পুঁজিবাদী বাজারের ছোট অংশীদার হয়ে ওঠার উচ্চাশায় তাদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখত এবং ভারত যে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে যোগ দেবে না, সেখানে পুঁজিবাদি রাষ্ট্রব্যবস্থাই বহাল থাকবে– সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়াকে এই আশ্বাস দেওয়ার জন্য সদ্য স্বাধীন অনান্য অনেক অ্যাফ্রো-এশীয় দেশের সঙ্গে নিজেদেরকে জোটনিরপেক্ষ বলে প্রচার করত। এর ফলে আবার একই সঙ্গে সদ্যস্বাধীন অন্যান্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে উচ্চাকাঙক্ষী ভারতীয় পুঁজি প্রাধান্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিল এবং ভারতীয় পুঁজিবাদ সেই সব দেশের বাজার দখল করতে শুরু করেছিল।

তবে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তা দানে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ রুষ্ট হলে সোভিয়েত তার সামরিক শক্তি নিয়ে ভারতের পাশে দাঁড়ায়। এর পরে ক্রমশ আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ছোট রাষ্ট্রগুলোর ওপর প্রভাব বৃদ্ধি করে আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৯০ এর দশকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপে প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর থেকেই সোভিয়েত সহ গোটা সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হলে ভারতীয় পুঁজিবাদী শাসকেরা একটু একটু করে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা শুরু করে। ইতিমধ্যে সমাজতান্ত্রিক চীনেও প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হয়ে চীন কার্যত একটি মিলিটারি শাসিত সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয় এবং দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক সমুদ্রে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদকে তীব্র প্রতিযোগিতায় ফেলে দেয়। কালক্রমে দক্ষিণ এশিয়ার প্রভুত্বের লড়াইয়ে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ ক্রমেই চীনের কাছে হটে যেতে থাকে। চীন আবার তার মূল ভূখণ্ডের কাছেই অবস্থিত এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রাচীনকাল থেকে চীনেরই অংশ বর্তমানে আমেরিকা নিয়ন্ত্রণাধীন তাইওয়ান দ্বীপরাষ্ট্রকে নিজের অধিকারে আনার জন্য ওই এলাকায় আমেরিকার সঙ্গে সামরিক পাঞ্জা কষা শুরু করে দেয় এবং দেখা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদী চীন সামরিক বলে কোনও অংশেই আমেরিকার থেকে কম নয়। অন্য দিকে, সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া আবার সমাজতান্ত্রিক যুগে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের অংশ ইউক্রেন প্রভৃতি দেশগুলো দখল করার জন্য সেখানে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে এবং আমেরিকা বা অন্যান্য পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর চোখ রাঙানিকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করছে না। কিন্তু দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে আমেরিকার যথেচ্ছ সেনা অভিযানের ফলও সে দেশের শাসকদের পক্ষে সুখকর নয়। এইসব দেশে মারাত্মক আহত প্রাক্তন সৈন্যরা এবং নিহতদের পরিবারবর্গ সহ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন আমেরিকান নাগরিকরা প্রশ্ন তুলছেন যে, সাত সমুদ্র পারের দেশের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আমেরিকান যুবকদের মরতে হবে কেন? তাঁরা বুঝেছেন যে, আসলে আমেরিকান পেট্রো ব্যারনদের স্বার্থেই এইসব যুদ্ধ। কাজেই, এখনই তাইওয়ান বা ইউক্রেনে সেনা পাঠানোও আমেরিকা বা ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এই কারণে, বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের সঙ্গে পাঞ্জা কষায় দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আজ একান্ত প্রয়োজন।

সমর শিল্পে ভারত চায় আমেরিকার সহযোগিতা

দ্বিতীয়ত, বিশ্বপুঁজিবাদের বর্তমান ভয়াবহ বাজার সংকটের ফলে ভারত আমেরিকা দুই বৃহৎ পুঁজিবাদী দেশই আজ বাজার সংকটে জেরবার। আজকের ভারতে ১৪২ কোটি লোকের মধ্যে ৭০ শতাংশেরই কোনও ক্রয়ক্ষমতাই নেই অর্থাৎ আধুনিক বাজারে সাজানো হরেকরকম পণ্য কেনার ক্ষমতা তাদের নেই। তারা শুধু কোনও রকমে একবেলা আধপেটা খাবার জোগাড় করতে পারে বা কখনও তাও পারে না। এমন অবস্থায় ভোগ্যপণ্যের শিল্প ভারতীয় পুঁজিবাদ আর নতুন করে তৈরি করতে চায় না, বরং চালু শিল্পই বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। কিন্তু আদানি, আম্বানি, টাটা প্রভৃতি ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠীগুলি আবার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনীদের তালিকায় নিজেদের নাম তুলে নিতে পেরেছে। তাদের কেনা গোলাম বিজেপি সরকারের দ্বারা একটার পর একটা সুবিশাল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জলের দরে সম্পূর্ণ বা আংশিক কিনে নিয়ে, সরকারকে দিয়ে নিজেদের হাজার হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স মকুব করিয়ে নিয়ে, আকাশচুম্বী লাভে পেট্রোপণ্যের ব্যবসা করে তারা গোটা দেশের ৯০ শতাংশ সম্পদেরই মালিকে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই বিপুল পুঁজি এখন তারা খাটাবে কোথায়? নরেন্দ্র মোদি তাই নতুন আওয়াজ দিয়েছেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। মজার ব্যাপার, বিশ্বরাজনীতিতে ভারতীয় ও চীনা সাম্রাজ্যবাদ পরস্পরের ঘোর শত্রু হলেও বাণিজ্যিক আদান প্রদানে দু’দেশের পুঁজিপতিদের ভালই বোঝাপড়া রয়েছে। সস্তা চীনা পণ্যে ভারতের ভোগ্যপণ্যের বাজার বর্তমানে ভেসে যাচ্ছে। যাবতীয় ইলেকট্রনি’ থেকে শুরু করে বাঙালির বিয়ের কার্ড, নকল বেনারসী শাড়ি পর্যন্ত চীনে তৈরি হয়ে এ দেশে বিক্রি হচ্ছে। উৎপাদন শিল্পের ঝঞ্ঝাট এড়ানোর জন্য ভারতীয় পুঁজিপতিরাও এগুলো নিজেরা তৈরি না করে আমদানি করে বিক্রি করেই লাভ করছে। তাই মোদিজির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ আসলে হল, দেশে অস্ত্র কারখানা গড়ে তোলা। সংকটগ্রস্ত অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের মতোই ভারতীয় শাসকশ্রেণিও অর্থনীতির সামরিকীকরণ শুরু করেছে বহুদিন আগেই। তবে এতদিন তারা শুধু চীন পাকিস্তানের জুজু দেখিয়ে বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ও যুদ্ধ সম্ভার কিনছিল। এখন ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিরা পাশ্চাত্য ধনকুবেরদের তুলনীয় পর্বতপ্রমাণ পুঁজির অধিকারী হয়ে নিজেদের দেশেই অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সম্ভার তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু এর জন্য চাই অস্ত্র নির্মাণশিল্পে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ আমেরিকান শিল্পপতিদের সাহায্য। আমেরিকান পুঁজিও ভারতের ১৪২ কোটি জনসংখ্যার বিরাট বাজার পেতে মরিয়া।

কী চুক্তি স্বাক্ষরিত হল

মোদিজির এবারকার সফরে তাই বাইডেন সরকারের মধ্যে অস্ত্র ও সামরিক সম্ভার নির্মাণ ও বিক্রয়ের নিম্নলিখিত চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়েছেঃ ১. তেজস এমকে টু লাইট কমব্যাট যুদ্ধবিমান আমেরিকার জেনেরাল ইলেকট্রিক ও ভারতের হিন্দুস্তান এরোনটিক লিমিটেড যৌথ উদ্যোগে তৈরি করবে। ২. আমেরিকা ভারতকে তিন বিলিয়ন ডলার মূল্যে তিরিশটি এমকিউ-নাইন-বি মডেল প্রিডেটর ড্রোন বিক্রি করবে। ৩. আমেরিকার সেমিকনডাক্টর এবং চিপ নির্মাতা মাইক্রন টেকনোলজি কোম্পানি গুজরাটে চিপ নির্মাণ শিল্প গড়ে তোলার জন্য ৮২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এবং গুজরাট রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পে ২.৭৫ বিলিয়ন ডলার ঢালবে। প্রসঙ্গত, এই সেমি কনডাকটর ও চিপ নির্মাণ শিল্পে মার্কিন পুঁজির সিংহভাগ খাটে তাইওয়ানের সেমিকনডকটর শিল্পে এবং তাইওয়ানেই সারা বিশ্বের ৮০ শতাংশ চিপ ও সেমিকনডাক্টর তৈরি হয়। স্পষ্টতই তাইওয়ানের অধিকার নিয়ে চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধায় আমেরিকা এখন তার নতুন বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে এই শিল্প সরিয়ে আনতে চাইছে।

 ভারত সহ গোটা বিশ্বে বেকারি আজ সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি হিসেব অনুযায়ীই ভারতে কর্মক্ষম যুবকদের ২৫ শতাংশই বেকার। যাঁরা বা কাজ করেন তাঁদের সিংহভাগের আয় নামমাত্র। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মোদি বাইডেন সাম্রাজ্যবাদী চক্র ভারতের সস্তা শ্রমশক্তিকে লুঠ করারও ফন্দি এঁটেছে। আমেরিকান ধনকুবের স্যাম অল্টম্যান, ভারতের আনন্দ মহীন্দ্রা, মুকেশ আম্বানি প্রমুখ শিল্পপতিরা একযোগে বসে ‘ইনোভেশন হ্যান্ডশেক’ নামে একটি নতুন নীতি তৈরি করেছে। শিল্পায়নের ও কর্মসংস্থানের ধুয়ো তুলে এইসব শিল্পে এতদিনের শিল্প ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কোনও শ্রমনীতিই আর থাকবে না। সরকারি ব্ল্যাঙ্ক চেক নিয়ে তারা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করবে এবং ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ পলিসির ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ করবে।

জনগণের মধ্যে মোদিবিরোধী ঝড়

স্পষ্টতই, যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদীদের বিশ্ব রাজনীতিতে নিজ নিজ বাজার দখল ও সম্প্রসারণ এবং অস্ত্র নির্মাণ ও কেনাবেচার মাধ্যমে নিজ নিজ অর্থনীতিতে কৃত্রিম তেজিভাব সৃষ্টি করা এবং একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে ভুয়ো যুদ্ধাতঙ্ক তৈরি করে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে ধামাচাপা দিয়ে রাখাই মোদির এই আমেরিকা সফরের উদ্দেশ্য। ভারত বা আমেরিকার জনসাধারণের মৌলিক সমস্যা সমাধানের কোনও কথা এখানে আলোচিত হয়নি এবং উদ্দেশ্যও তা ছিল না। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, মোদির এই সফর নিয়ে আমেরিকার গণতন্ত্রপ্রিয় এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। ২০০২ সালে মোদিরই মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময়ে গুজরাতের ভয়াবহ দাঙ্গা ও মুসলিমদের গণহত্যা, মুসলিম রমণীদের গণধর্ষণ সব কিছুই যে মোদি সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে হয়েছিল এবং এর ফলে ২০১৪-তে মোদি ভারতের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন আমেরিকান সিনেট আমেরিকায় মোদির প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল– এ কথা গণতন্ত্রপ্রিয় আমেরিকান জনসাধারণ ভোলেননি। ‘ওহে বাইডেন, মোদিকে জিজ্ঞেস করো’ লেখা ব্যানার নিয়ে সারা দেশে সর্বত্র মোদি-বাইডেন মিত্রতা বিরোধী অসংখ্য বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে। অর্থাৎ বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বলছেন, ‘মোদিকে প্রশ্ন করো’– তাঁর সরকার গুজরাত দাঙ্গা দমন করার চেষ্টা না করে সহায়তা করেছিল কেন? কেন তাঁর দল দেশে মুসলিম বিরোধী উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতি নিয়ে চলে? কেন মুসলিমদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে? কেন প্রতিনিয়ত ভারতে দলিতদের ওপর অত্যাচার চলছে? কেন সরকারের সমালোচনাকারী সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের মিথ্যা অভিযোগে জেলে পোরা হচ্ছে, এমনকি হত্যা করা হচ্ছে? মণিপুরে জাতিদাঙ্গা দমন করতে মোদি সরকার ব্যর্থ কেন? গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে তৈরি বিবিসি-র তথ্যচিত্র মোদি সরকার ভারতে নিষিদ্ধ করল কেন? উল্লেখ্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস সংগঠন মোদির আমেরিকা সফরকালে এই তথ্যচিত্র প্রকাশ্যে দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। বিক্ষোভকারীদের মতে মোদিকে এত খাতিরদারি করার পরিবর্তে ‘মুক্ত দুনিয়া’র দেশের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এইসব প্রশ্ন তোলা উচিত। শুধু গণবিক্ষোভই নয়, আমেরিকান সিনেটের সত্তর জনেরও বেশি আইনপ্রনয়নকারী সদস্য যৌথভাবে বাইডেনকে একটা চিঠি পাঠিয়ে দাবি করেছে যে, তিনি যেন ভারতে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার বিষয়ে মোদির সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁরা লিখেছেন যে, ভারতে বর্তমানে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং সমাজকর্মী ও সাংবাদিকদের ওপর সরকারি আক্রমণ এবং সংবাদমাধ্যম ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধ ভীষণভাবে বেড়ে গেছে। আমেরিকান কংগ্রেস ও সিনেট সদস্যদের একটা বড় অংশ মোদির বত্তৃতা বয়কট করেছেন এবং আমেরিকান কংগ্রেসে মোদির মতো একজন সাম্প্রদায়িক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বাইডেন প্রশাসনের সমালোচনাও করেছেন। সব মিলিয়ে মোদির এবারকার আমেরিকা সফরে এটাই স্পষ্ট হয়েছে যে, সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সেবাদাস শাসকেরা যেমন বিশ্বজুড়ে তাদের শোষণের শৃঙ্খলকে আরও মজবুত করতে পরস্পর আরও নিবিড় বোঝাপড়া গড়ে তুলছে, তার বিপরীতে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষও সারা পৃথিবীতে সোচ্চার হচ্ছে। প্রয়োজন, সঠিক সর্বহারা বিপ্লবী রাজনীতির ভিত্তিতে এইসব প্রতিবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিপূরক দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করা।