অসংগঠিত, রাজনৈতিকভাবে অসচেতন জনতার বিক্ষোভ আন্দোলন বেশি দূর এগোতে পারে না–শিবদাস ঘোষ

আগামী ৫ আগস্ট শুরু হচ্ছে এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের জন্মশতবর্ষ। সারা দেশ জুড়ে শোষিত নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তা উদযাপন করবেন। এই উপলক্ষে ‘গণদাবী’র পক্ষ থেকে তাঁর মূল্যবান বিভিন্ন লেখা ও বত্তৃতার নানা অংশ প্রকাশ করা হবে। এই সংখ্যায় ১৯৭৪-এর ২৪ এপ্রিল পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবসে কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানে দেওয়া ভাষণের অংশবিশেষ প্রকাশ করা হল।

 

আপনারা লক্ষ করেছেন, গুজরাটে জনসাধারণের সহ্যের সীমা অতিক্রম করার ফলে যে আন্দোলনে তারা ফেটে পড়ল, তা বেশি দূর এগোতে পারেনি। বিহারেও আন্দোলন আজ যে পথ গ্রহণ করেছে এবং সেখানে আন্দোলনের নেতৃত্ব কার্যকরীভাবে আজও যে শক্তিগুলোর হাতে রয়েছে, তার ফলে বিক্ষোভ, আত্মত্যাগ, গুলি খাওয়া, প্রাণ দেওয়া, সরকারি তরফ থেকে অত্যাচার, যত কিছুই যে পরিমাণে ঘটুক না কেন, এরও পরিণতি বেশিদূর নয়। যে কথাটা এর দ্বারা আমি আপনাদের কাছে বলতে চাইছি, তা হল এই যে, অত্যাচার যতদিন থাকবে এবং যখন তা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাবে, মানুষ মাঝে মাঝে বিক্ষুব্ধ হয়ে নেতৃত্ব থাকুক আর না থাকুক, আদর্শ ঠিক থাকুক আর না থাকুক, রাস্তা ভুল হোক, পথ ভুল হোক, নেতৃত্ব ভুল হোক, লড়াইয়ের ময়দানে এসে যাবে। এই লড়াই হবে। লড়াই হচ্ছেও। আপনারা মনে রাখবেন, ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ কম রক্ত ঢালেনি। এ কথা যদি কেউ বলেন যে এ দেশের মানুষ লড়তে জানে না, এ দেশের মানুষ প্রাণ দিতে জানে না, এ দেশের মানুষ পুলিশের বন্দুক দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে যায় এবং গর্তে লুকিয়ে থাকে, তা হলে আমি বলব, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। তাঁরা এ দেশের ইতিহাস, বিশেষ করে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও আজ পর্যন্ত যত আন্দোলন এ দেশে ঘটেছে, যত আত্মত্যাগ ও কোরবানি হয়েছে, যত অত্যাচার হয়েছে, যত লাঠি-গুলি চলেছে তার ইতিহাস হয় জানেন না, না হয় জেনে শুনে সেই ইতিহাস তাঁরা বিকৃত করছেন, অথবা তাঁরা সেই ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছেন। আমি আপনাদের বলছি, আবারও এ দেশের মানুষ লড়বে। আন্দোলন সম্পর্কে তাদের নিরাশা, হতাশা, অবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি তাদের আস্থাহীনতা যাই থাকুক, তারা কোনও দলের নেতৃত্বকে পছন্দ করুক না করুক, বা এই সমস্ত রাজনৈতিক দল কিছু করতে পারবে না, এ রকম মনোভাবনা তাদের মধ্যে থাকলেও তারা বসে থাকতে পারবে না। কারণ, পেট বড় বালাই। অত্যাচার শোষণ যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাবে তখন তারাও বোমার মতো ফেটে পড়তে বাধ্য হবে, আন্দোলন করতে বাধ্য হবে, মরবে এবং প্রাণ দেবে। কিন্তু আমি যা বলতে চাইছি, তা হচ্ছে, এর দ্বারা ফল কিছু হবে না। কারণ বিক্ষোভ, বিস্ফোরণ, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন যত ব্যাপকতা নিয়েই গড়ে উঠুক, অসংগঠিত, রাজনৈতিকভাবে অসচেতন জনতার শুধুমাত্র অ্যাজিটেশনাল ফর্ম অব মুভমেন্ট (বিক্ষোভের রূপে এই আন্দোলন) বেশি দূর পর্যন্ত এগোতে পারে না।

আপনারা লক্ষ করে দেখবেন, আমাদের দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে আন্দোলনের যে কৌশল চলেছে, এ আন্দোলনের প্রকৃতিও সেইরকম, অর্থাৎ মানুষকে রাজনৈতিকভাবে, সুষ্ঠু রাজনৈতিক লক্ষ্য সম্বন্ধে সচেতন করে, সংগঠিত করে, সংগঠিত রূপে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা নয়। এর প্রকৃতি হচ্ছে, মানুষের মধ্যে প্রচলিত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং লড়াইয়ের মনোভাব যখন দানা বাঁধতে থাকে, মানুষ কিছু একটা করবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে, তখন কিছু গরম ভাষণ দিয়ে তাদের উত্তেজিত করে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া। তারা সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে থাকে, আর নেতারা মাঝে মাঝে কিছু কিছু ‘লড়াইয়ের কর্মসূচি’ দিতে থাকেন। নেতাদের গায়ে আঁচড়টিও লাগে না। বড় জোর একটা সরকার যদি অত্যন্ত ভয় পেয়ে যায়, বিব্রত বোধ করতে থাকে, বা একটু আনওয়াইজ (বেকুব) হয়, তা হলে নেতাদের ধরে নিয়ে গিয়ে ‘আসুন স্যার’ বলে জেলে পুরে দেয়। নেতাদের সেই জেলে যাওয়াটা একটা রাজনৈতিক ক্যাপিটাল (মূলধন) হয়। তাঁরা বেশ হাসতে হাসতে জেলে যান। গিয়ে সেখানে ডিভিশন ওয়ান প্রিজনার (প্রথম শ্রেণির বন্দি) হন, আর জেলে তাঁদের অ্যালাউয়েন্স আরও বেশি পাওয়া দরকার কি না তার জন্য লড়ালড়ি করেন। আবার দশ-পনেরো দিন বাদে গলায় মালা পরে বেশ মহাবীরের মতো বেরিয়ে আসেন এবং বেরিয়ে এসেই সরকারের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার দিতে থাকেন। আর নির্বাচন থাকলে তো কোনও কথাই নেই। তাঁরা বলতে থাকেন, এই সরকার কিছুই করেনি। আমরা লড়েছি, আমাদের ক্ষমতায় বসাও, সরকারি গদিতে বসাও। বসালেই একেবারে রামরাজত্ব আমরা কায়েম করে দেব। আন্দোলনের এই যে প্রকৃতি, এটাকেই আমি বলতে চেয়েছি, বুর্জোয়াদের অনুরূপ বুর্জোয়া ফর্ম অব অ্যাজিটেশনাল মুভমেন্ট (বুর্জোয়া কায়দায় বিক্ষোভ আন্দোলন)।

স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বুর্জোয়ারা ব্রিটিশবিরোধী জনতার আন্দোলনের প্রবণতাকে অসংগঠিত অবস্থায় রেখে বিচ্ছিন্নভাবে জনতাকে দিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়িয়েছে এবং তার চাপে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে বারগেইন (দর কষাকষি) করতে চেয়েছে। আজও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, যারা জনতার মধ্যে অসন্তোষ এবং বিক্ষোভকে শুধু উস্কানি দেয় এবং তাকে ভিত্তি করেই লড়াইয়ের ময়দানে জনতাকে নামিয়ে দেয়, আর তার ফলে পুলিশের অত্যাচারে, শাসনযন্তে্রর দমনপীড়নে স্বাভাবিকভাবেই সরকারবিরোধী, শাসকদলবিরোধী যে মনোভাব এবং ঘৃণা জনতার মধ্যে বিস্তার লাভ করে, তাকেই তারা মনে করে একটা পলিটিক্যাল গেইন (রাজনৈতিক লাভ)। এর দ্বারা বিপ্লব হোক বা না হোক, জনসাধারণের দুর্দশার জন্য দায়ী এই সমাজব্যবস্থার কোনও একটা আমূল পরিবর্তন হোক বা না-হোক, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। কিন্তু এর দ্বারা সরকার বা শাসকদলবিরোধী যে বিক্ষুব্ধ মনোভাব এবং ঘৃণা জনসাধারণের মধ্যে আরও তীব্র হয়ে দেখা দেয়, তাকে ভিত্তি করেই এই সমস্ত দলগুলি কেউ বিপ্লবের কথা, সমাজতন্তে্রর কথা, কেউ জনসাধারণের জন্য কী করবে তার লম্বা ফিরিস্তি এবং জনসাধারণকে উজির-নাজির বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রভৃতি বড় বড় প্রতিজ্ঞা, ভাষণ, কর্মসূচি, এই সমস্ত দাখিল করে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের দিকে যায় এবং সরকার গঠনের চেষ্টা করে। আমি বলি, এই যে ভিসাস সার্কল (দুষ্ট চক্র), অর্থাৎ এই যে লড়াই বার বার দানা বাঁধছে, বিক্ষোভে মানুষ ফেটে পড়ছে, আর যারা নির্বাচনী পার্টি তারা সেই বিক্ষোভ থেকে মওকা নিয়ে ইলেকশন রাজনীতিতে ফয়দা তুলছে–সেই দুষ্ট চক্র থেকে গণআন্দোলন, বামপন্থী আন্দোলন এবং জনগণের বিপ্লবী আন্দোলনের বেরিয়ে আসার পথ কী?

আপনারা একটা কথা মনে রাখবেন, বিক্ষোভ যত বড়ই হোক, বিক্ষোভ আর বিপ্লব এক নয়। বিক্ষোভের দ্বারা আপনাআপনি বিপ্লব হয়ে যায় না। বিপ্লব মানে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, অর্থাৎ বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে তার জায়গায় একটি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, যাকে আমরা বলি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোটির ধাঁচাটিকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলে তার জায়গায় সমাজতান্ত্রিক ধাঁচা প্রবর্তন। তাকে আমরা বলি বিপ্লব। এই বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে আপনাআপনি জন্ম নেয় না, ইতিহাস এ কথা বলে না, বিজ্ঞান এ কথা বলে না, এ ধারণা অনৈতিহাসিক ও অবৈজ্ঞানিক। এই ভাবে যারা বিক্ষোভকে বিপ্লবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে তারা হয় মূর্খ, আর না-হয় অত্যন্ত ধূর্ত, জাঁহাবাজ ইলেকশন রাজনীতিবিদ। তারা বিক্ষোভ আন্দোলনগুলিকেই, অর্থনৈতিক আন্দোলনগুলিকেই একটু মারমুখী ঢং-এ পরিচালনা করে সেগুলিকেই ‘বিপ্লব’ ‘বিপ্লব’ বলে চালিয়ে আসল বিপ্লবী আন্দোলনের প্রস্তুতিকে বিপথগামী করে দেয় এবং এইভাবে বিপ্লবটাকে গড়তে দেয় না। বিপ্লবের পথে তারা এসে বাধা সৃষ্টি করে। তাই বিক্ষোভ আর বিপ্লব এক নয়– এ কথা মনে রাখবেন। বিক্ষোভ এই পশ্চিমবাংলাতেই আজ না হলেও, আবার হবে, যেমন অতীতে হয়েছে। মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। কিন্তু, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, মার খেয়ে, সরকারবিরোধী হয়ে তারা আবার ইলেকশন রাজনীতির মধ্যে যাবে। পুঁজিবাদ যে জায়গায় ছিল, শোষণ যে জায়গায় ছিল, বেকার সমস্যা যে জায়গায় ছিল, শিক্ষার মান যে-ভাবে নিম্নগামী হচ্ছিল, নৈতিক মান যে-ভাবে দিনের পর দিন নিচের দিকে নেমে যাচ্ছিল– এগুলো সবই থাকবে। এর কেশাগ্রও আপনারা স্পর্শ করতে পারবেন না। হাজার কোরবানি হলেও শুধুমাত্র বিক্ষোভের দ্বারা, কোরবানির দ্বারা, আত্মত্যাগের দ্বারাই আপনারা বিপ্লব সংগঠিত করতে পারবেন না। এই বিপ্লব সংগঠিত করতে হলে আপনাদের নির্দিষ্ট স্পষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে সংগঠিত হতে হবে– অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে সচেতন সংঘবদ্ধ জনতার দীর্ঘস্থায়ী লড়াই পরিচালনার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ১৫ জুলাই ২০২২