অর্থনীতির ‘জীবন রেখা’ ভারতীয় রেল আজ সর্বাত্মক সংকটে

ভারতের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থা ভারতীয় রেলওয়ে মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন৷ এই সংকটের সাথে সরাসরি জড়িত প্রায় বারো লক্ষ রেলকর্মচারীর জীবনজীবিকা এবং কোটি কোটি ভারতীয় নাগরিকের পরিবহণের প্রশ্ন৷ এই ভয়াবহ আক্রমণে প্রতিটি দেশবাসীই উদ্বিগ্ন৷

ব্রিটিশ শাসিত ভারতে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায়েই ১৮৫৩ সালে ভারতীয় রেলব্যবস্থার পত্তন হয়৷ প্রাক স্বাধীনতা যুগেই গোটা ভারতবর্ষে প্রায় পঞ্চান্ন হাজার রুট কিলোমিটার রেল লাইন পাতা হয়ে যায়৷ যার ব্যাপ্তি আজ প্রায় সত্তর হাজার রুট কিলোমিটারের কাছাকাছি৷ ভারতীয় রেলওয়ে ব্যবস্থা গোটা ভারতকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে একসূত্রে আবদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে৷ ভারতে শ্রমিক আন্দোলনেও রেল শ্রমিকদের ভূমিকা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে৷ রেল যেমন গোটা দেশের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে তেমনি দেশের বেকার যুবক যুবতীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে৷ হাজার দুর্নীতি সত্ত্বেও রেলওয়ে ব্যবস্থা বহু সামাজিক দায়ভার বহন করার পরও প্রতি বছর ভারত সরকারের কোষাগারে হাজার হাজার কোটি টাকা লভ্যাংশ জমা করেছে৷

চূড়ান্ত বাজার সংকটে জর্জরিত ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি তাদের মুনাফার পাহাড়কে স্ফীত করার তাগিদে অন্যান্য পরিষেবা ক্ষেত্রের ন্যায় ভারতীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাকেও পুঁজি খাটানোর ক্ষেত্র হিসাবে খুলে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করা শুরু করেছে বহুদিন পূর্বেই৷

১৯৫১ সালে রেলওয়ে ব্যবস্থার রাষ্ট্রায়ত্তকরণ হয় এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প হিসাবেই এর বিকাশ হয়৷ কিন্তু ১৯৯১ সালে কংগ্রেস সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং যে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেন তার পরেই রাষ্ট্রায়ত্ত রেলশিল্পকে কীভাবে পুরোপুরি বেসরকারিকরণ করা যাবে, সেই লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে প্রকাশ ট্যান্ডন কমিটি গঠন করা হয়৷ তাঁর সুপারিশ অনুযায়ী রেলের নিজস্ব ক্যাটারিং ব্যবস্থাকে আই আর সি টি সি–তে রূপান্তরিত করা হয়৷ মাল পরিবহণের জন্য গঠন করা হয় কনটেনার করপোরেশন৷ রেলে বহু অফিস, সাফাই ব্যবস্থা, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের বহু কাজ তখন থেকেই বেসরকারি হাতে চলে যায়৷ পদ বিলুপ্তি, অবসরপ্রাপ্তদের পুনর্নিয়োগ করা, ক্যাজুয়াল কর্মীর নিয়োগ বন্ধ এসবই প্রায় তখন থেকেই শুরু হয়ে যায়৷

২০০২ সালে গঠিত হয় রাকেশ মোহন কমিটি৷ এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রেলকে কোর অর্থাৎ যে অংশ সরাসরি রেল পরিবহণের সাথে যুক্ত তা বাদ দিয়ে বাকি রেলওয়ে ব্যবস্থাকে ননকোর আখ্যা দিয়ে, তার সামগ্রিক বেসরকারিকরণ শুরু হয়ে যায়৷ রেলের বহু স্কুল, হাসপাতাল, নিজস্ব ছাপাখানা, অফিস কারখানা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয় নতুবা ‘আউটসোস’ করে দেওয়া হয়৷ অফিসগুলিতে নিয়োগ প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ রেলের সাতটি প্রোডাকশন ইউনিট যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কার্সও আছে, তাদেরকে কর্পোরেটাইজড করে ধীরে ধীরে ব্যক্তিমালিকের কাছে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনাও এই সময়ই করা হয়৷

২০১৫ সালে বিজেপি সরকারের নেতৃত্বে গঠিত বিবেক দেবরায় কমিটি৷ গোটা রেলওয়ে ব্যবস্থাকেই বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে এক গুচ্ছ পরিকল্পনা পেশ করে৷ শক্তিশালী ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলনের অনুপস্থিতিতে, মোদি সরকার একের পর এক সেই পরিকল্পনাই রূপায়িত করে চলেছে৷ প্রায় সমস্ত রেলওয়ে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ যে পাঁচটি রেলওয়ে ছাপাখানা অবশিষ্ট ছিল তাও বন্ধ করে দেওয়ার অধ্যাদেশ জারি করা হয়ে গেছে৷ রেলের সতেরোটি জোনে জেনারেল স্টোরস ডিপোগুলির প্রতিটিতে তিন থেকে চার হাজার কর্মী কাজ করত, সেগুলিকে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে৷ বেসরকারি ট্রেন চালু হয়ে গেছে৷ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রুটে এবং শহরতলিতে বেসরকারি ট্রেন চলাচলের পরিকল্পনা হয়ে গেছে এবং তা খুব শীঘ্রই  কার্যকরী হতে চলেছে৷ সমস্ত বড় ওয়ার্কশপগুলি হয় বন্ধ হওয়ার মুখে অথবা বেশিরভাগটাই বেসরকারি  মালিকের অধীনে এসে গেছে৷ টিকিট কাটার ব্যবস্থা অর্ধেকটাই বেসরকারি হাতে চলে গেছে৷ বাকি যতটুকু আছে তাও অতি শ্রীঘ্রই বেসরকারি হাতে চলে যাবে৷ রেলের হাজার হাজার একর জমি বিক্রি করার ফরমান জারি হয়ে গেছে৷

এক সময় রেলে সাড়ে বাইশ লাখ কর্মী বাহিনী ছিল৷ কেন্দ্রের পরের পর সরকারগুলি তা কমাতে কমাতে ১২ লক্ষে নামিয়ে এনেছে৷ এখনও গরিব মধ্যবিত্ত মানুষের এবং তাঁদের নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য ও কারখানার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও উপাদানজাত দ্রব্যের বৃহত্তম পরিবহণ মাধ্যম হল ভারতীয় রেল৷ এখনও দুর্গম, অনগ্রসর ও অলাভজনক এলাকায় সামাজিক দায়িত্ব পালন করে, রেল তার পরিবহণ ব্যবস্থা চালু রেখেছে৷

এই রেলওয়ে বেসরকারিকরণ হয়ে গেলে ব্যক্তি মালিক তার মুনাফা বাড়াতে একের পর এক জনবিরোধী পদক্ষেপ নেবে৷ বিগত ৪ অক্টোবর থেকে যে ‘তেজস’ বেসরকারি ট্রেন চালু হল তার ভাড়া সাধারণ ট্রেনের ভাড়ার প্রায় তিনগুণ করে দেওয়া হয়েছে৷ জনসাধারণের কষ্টার্জিত অর্থে তৈরি রেল লাইন, রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থা স্টেশন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ইত্যাদি ব্যবহার করে ব্যক্তি মালিক শুধু তার লাভের পাহাড়ই গড়ে তুলবে৷ এই ব্যক্তি মালিকানাধীন ট্রেনগুলি কোনও লেট করবে না অর্থাৎ সরকারি ট্রেনগুলিকে রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখে ওই প্রাইভেট ট্রেনগুলিকে আগে ছেড়ে দেওয়া হবে৷ শহরতলির লোকাল ট্রেন সহ আরও যে পঞ্চাশটি রুটে ব্যক্তি মালিকানাধীন ট্রেন চলবে সেখানেও একই দশা হবে৷ বাস্তবে ধীরে ধীরে সরকারি রেলওয়ে ব্যবস্থাটা ধ্বসে পড়বে৷ সাধারণ মানুষ বাধ্য হবেন বেসরকারি ট্রেনে যাতায়াত করতে৷

ফলে ভারতীয় রেলের পরিণতি হবে বিএসএনএল, এয়ার ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান কেবলস এর মতো৷ সাধারণ মানুষের জন্য বিভিন্ন রকম সুযোগ সুবিধা এখনও আছে, বয়স্ক নাগরিক সহ বিভিন্ন রকমের যে কনসেশন আছে, বিনামূল্যে ত্রাণসামগ্রী পরিবহণ, স্বল্প ভাড়ার খাদ্যসামগ্রী পরিবহণ সবই বন্ধ হয়ে যাবে৷ ট্রেনের ভাড়া বাড়বে বিপুল পরিমাণে৷

রেল কর্মচারীরা যে সব সুযোগ, সুবিধা, অধিকার দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জন করেছেন সেগুলি ব্যাপকভাবে খর্ব করা হবে৷ ইতিমধ্যে নতুন পেনশন নীতির মাধ্যমে ২০০৪ সালের পরে নিযুক্ত রেলকর্মীদের নিশ্চিত পেনশনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ শোনা যাচ্ছে তাঁদের পারিবারিক পেনশন ও গ্র্যাচুইটির অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে৷ পঞ্চান্ন বছর বয়স বা তিরিশ বছর চাকরির অজুহাতে প্রায় সাড়ে তিনলক্ষ রেলকর্মচারীকে ছাঁটাই করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গেছে৷ রেলস্টেশনগুলি থেকে হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হটিয়ে দিয়ে বড় বড় ‘ফুড প্লাজা,শপিং মল’ তৈরি হচ্ছে৷ যেখানে সাধারণ গরিব মানুষ এক গ্লাস জল বা এক কাপ চাও খেতে পারবেন না৷ বেসরকারি ট্রেনগুলিতে রেলকর্মীরা ভ্রমণ সংক্রান্ত যে সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন তার অধিকাংশও থাকবে না৷ এক কথায় সমগ্র রেলশিল্পটাই আজ ভয়াবহ আক্রমণের সম্মুখীন এবং রেল কর্মীরাও অতিদ্রুত এক মারাত্মক দুর্দিনের সামনে পড়বেন৷

এই অবস্থায় সমস্ত রেলকর্মচারীদের ভাবা দরকার অতীতে রেল শ্রমিকরা বহু গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেছেন৷ রেল শ্রমিক আন্দোলন প্রগতির ইতিহাসে আঠারো জন রেলশ্রমিক শহিদের মৃত্যু বরণ করেছেন৷ বহু অধিকার অর্জন করেছেন৷ ১৯৭৪ সালে রেল ধর্মঘট ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক স্বর্ণ অধ্যায় রচনা করেছে৷ অথচ আজ এইরকম ভয়ঙ্কর আক্রমণের সামনেও রেল কর্মচারী সংগঠনগুলির আপস এবং দুর্বলতার কারণে কোনও কার্যকরী আন্দোলন গড়ে উঠছে না৷

রেলে কংগ্রেস সরকারের মাধ্যমে যে একের পর এক আক্রমণ শুরু হয়, আজ নরেন্দ্র মোদি সরকারের মাধ্যমে তা বহুদূর বিস্তৃত৷ এরে রুখতে হলে, বিজেপির জনবিরোধী চরিত্র জনসমক্ষে স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে৷ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে এই দুষ্ট শক্তিকে৷ এবং দেশের সাধারণ জনগণ এবং রেল শ্রমিক–কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ করে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, তা না হলে মারাত্মক বিপদ নেমে আসবে জনজীবনে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১১ সংখ্যা)