কথিত আছে, রামের জন্ম অযোধ্যাতেই। ওখানেই কেটেছে তাঁর বাল্যকাল। তারপর বড় হয়েছেন, পাঠানো হয়েছে বনবাসে। ফিরে এসে ওখানেই রাজত্ব করলেন। রামের জীবনকথার এমন সব মুহূর্তগুলি স্মরণে স্থাপিত হয়েছে এক একটি মন্দির। খেলার জায়গায় গুলেলা মন্দির, লেখাপড়ার স্থানে বশিষ্ঠ মন্দির, যেখানে বসে রাজত্ব করলেন সেখানেও আছে একটি মন্দির। খাবারের জায়গাতে হল ‘সীতা রসুই’। ভরতের বসার জায়গায় মন্দির, হনুমান মন্দির, কোপ ভবন, সুমিত্রা মন্দির, দশরথ ভবন– এমন বিশটি মন্দির সেখানে আছে, যাদের বয়স ৪০০ থেকে ৫০০ বছর।
কিন্তু কী আশ্চর্য! তখন ভারতে যে মুঘল সাম্রাজ্যের কাল! মুসলমান শাসকরা সাহায্য করেছিলেন মন্দির গড়তে? প্রচার তো শুনি, মন্দির ভাঙার জন্যই তাঁরা কুখ্যাত! তাদের শাসনকালে একটা গোটা শহর মন্দিরময় হয়ে গেল, আর তারা কিছু বলল না! এ কেমন শত্রুতা যে তারাই মন্দিরের জন্য জমি দিয়ে দিল! গুলেলা মন্দিরের জন্য মুসলিম শাসকদের দেওয়া জমির কথা যারা বলে তারা নির্ঘাৎ মিথ্যাবাদী! কিন্তু দিগম্বর আখড়ার ওই দলিলটা! যেখানে লেখা আছে মন্দিরের জন্য মুসলিম শাসকরা ৫০০ বিঘা জমি দিয়েছে, সেটা নিশ্চয় একেবারে ডাহা মিথ্যা! আর নির্মোহী আখড়ার জমি যে সিরাজদ্দৌলার দান– এই দলিলটাও মিথ্যা না হয়ে পারে না নিশ্চয়ই! তাহলে সত্যি বলে রইল শুধু বাবর আর তার তৈরি মসজিদ! এখন তো তুলসীদাসকেও মিথ্যা মনে হচ্ছে! তিনি তো ১৫২৮ সালের কাছাকাছি জন্মেছিলেন। বাবর ওই সময়েই রাম মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ গড়েছেন বলে প্রচার আছে। তুলসীদাস তাহলে ওই ঘটনা হয় দেখেছিলেন, না হলে শুনেছিলেন! তিনি বসে বসে তখন দোঁহা লিখছেন–‘তুলসী সরনাম গুলামু হৈ রামকো, যা কো রুচে সো কহৈ অউ। মাঙ্গি কি খৈবি, মসিতকো শৈবি, লৈবোকো একু ন দৈবেকো’। ‘তুলসী তো রামের প্রসিদ্ধ গোলাম। যার যা খুশি বলতে পারো, আমি ভিক্ষা করে খাব আর মসজিদে শোব। কারও সাথে আমার লেনা দেনা নেই।’ তারপর লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রামায়ণ! রাম মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ গড়ছেন বাবর, আর তুলসীদাসের এতটুকু আফশোস হল না! এসব কথা কোথাও লিখেও গেলেন না! কিন্তু কেন?
অযোধ্যায় কি সত্য-মিথ্যা সব গুলিয়ে গেছে? পাঁচ পুরুষ ধরে মুসলিমরা সেখানে ফুলের চাষ করছেন। সেই ফুলই সব মন্দির আর সেখানে অধিষ্ঠিত দেবতাদের এমনকি রামের গলাতেও শোভা পায়! ওখানকার মুসলিমরা কাঠের খড়ম তৈরির পেশায় কে জানে কবে থেকে আছে! ঋষি-মুনি, সন্ন্যাসী, রামভক্ত, সবাই সেই খড়ম পরে মন্দিরে ঢোকেন। চার দশক ধরে সুন্দর ভবন মন্দিরের পুরো দায়িত্ব রইল এক মুসলমানের হাতে! ১৯৪৯ থেকে ২৩ ডিসেম্বর ১৯৯২ পর্যন্ত মন্দিরের ম্যানেজার ছিলেন মুন্নু মিঞা। আরতির সময় লোক কম পড়লে মুন্নু নিজেই করতাল বাজাতে দাঁড়িয়ে পড়তেন। আবার ভাবতে হচ্ছে অযোধ্যার সত্য কোনটা আর মিথ্যা কোনটা!
অগ্রবাল মন্দিরের সমস্ত ইটে আরবিতে ‘৭৮৬’ লেখা। এই মন্দিরের সমস্ত ইট সরবরাহ করেছিলেন, রাজা হুসেন আলি খাঁ। মন্দির নির্মাতা অগ্রবালরা পাগল, না রাজা হুসেন আলি বদখেয়ালি! কোনটা সত্য? এই মন্দিরে প্রার্থনার জন্য যে হাত ওঠে, তা হিন্দুর না মুসলমানের তা বলা মুশকিল। ৭৮৬ সংখ্যাটি থাকায় এই মন্দির সকলকে আপন করে নিয়েছিল।
তাহলে কি শুধু ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখটাই সত্য! সেই দিনটার পর সরকার বেশিরভাগ মন্দির অধিগ্রহণ করেছে। এখন সেখানে তালা, বন্ধ আরতি। লোকের আনাগোনা স্তব্ধ। বন্ধ দরজার পিছনে বসে দেব-দেবীরা বোধহয় ধিক্কার দিচ্ছেন তাদের, যারা গম্বুজে চড়ে রামের দখল নেবার চেষ্টা করেছিল! জনশূন্য হনুমান মন্দির, সীতা রসুই কি আজ ভরে থাকে রক্তের গন্ধে, যা রামের নাম করে বইয়ে দেওয়া হয়েছিল দেশজুড়ে! অযোধ্যা এমন এক শহর যা আজ শুধু এক সমস্যার নামে পর্যবসিত। অযোধ্যা আজ এক সংস্কৃতি ধ্বংসের ইতিবৃত্ত।
– সোসাল মিডিয়া থেকে পাওয়া বিবেক কুমারের হিন্দি রচনা থেকে অনূদিত।
গণদাবী ১৮ অক্টোবর, ’১৯ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত।