বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ, নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনকে বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা যে ভাবে ক্রমাগত অপদস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তাঁর সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ ও মর্যাদাহানিকর মন্তব্য করে চলেছেন তাকে নিন্দা করার কোনও ভাষাই বোধহয় যথেষ্ট নয়। এ কথা ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে যে তিনি রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের বিশ্বভারতীর উপাচার্য। তাঁর এই ন্যূনতম সৌজন্যহীন, অভদ্র এবং অন্যায় আচরণ বিশ্বের কাছে ভারতের মাথা নিচু করে দিচ্ছে। হয় মানীর মান বোঝার মতো কোনও যোগ্যতা তাঁর নেই, আর না হয় অত্যন্ত পরিকল্পিত এক ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসাবে এই কাজ তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রথমটিই যদি কারণ হয় তবে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত এই মুহূর্তে তাঁকে এই পদ থেকে অপসারণ করা। দ্বিতীয় কারণটি সত্য হলে প্রতিটি দেশবাসীর উচিত সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
দু’ডেসিমেল জমি অতিরিক্ত রাখার অভিযোগ তুলে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনকে যেভাবে ‘উচ্ছেদ করার’, ‘বাড়ি ভেঙে ফেলার’, ‘বিড়ম্বনায় ফেলার’ হুমকি দিয়ে যাচ্ছে তাতে এই সন্দেহ গভীর হয় যে, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের আসল উদ্দেশ্য জমি উদ্ধার নয়, তাঁকে অসম্মানিত করা। যে বাড়িতে অমর্ত্য সেন বসবাস করেন তা পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত। তাঁর পিতা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের থেকে তা লিজ নিয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষের যদি মনে হয় এই জমির কোনও অংশ বেআইনি তবে তা আইনি পথেই মিটিয়ে নেওয়া যেত। এমনকি উপাচার্য স্বয়ং যদি অধ্যাপক সেনের বাড়িতে গিয়ে তা মিটমাট করে নিতেন তাতে তাঁর সম্মানের কিছুমাত্র হানি ঘটত না, বরং লোকচক্ষে সম্মানবৃদ্ধিই ঘটত। তা না করে তাঁরা যা করছেন তা চরম অসভ্যতা ছাড়া কিছু নয়।
অমর্ত্য সেন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিভেদ-বিদ্বেষের রাজনীতির, ইতিহাস-বিকৃতির রাজনীতির বিরোধী। এই বিরোধিতা তিনি কখনও গোপন করেননি। বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে তাঁর সেকুলার মনোভাবও সকলের জানা। ফলে এমন এক খ্যাতনামা ব্যক্তি যে বিজেপি নেতৃত্বের আক্রমণের নিশানা হবেন, তা বুঝতে বর্তমান ভারতে কারও অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই। কালবুর্গি, দাভোলকর, পানসারে, গৌরী লঙ্কেশের মতো বিজেপি-সংঘ পরিবারের চিন্তার বিরোধীদের এমনকি খুন পর্যন্ত হতে হয়েছে। বিজেপি নেতারা এর আগেও বিশ্ববরেণ্য ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব-এর অমর্যাদা করেছে। মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে বহু কবি সাহিত্যিক অধ্যাপককে জেলে ভরেছে। বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতা আটকাতে তাঁদের সকলকে ‘কলমজীবী’, ‘আন্দোলনজীবী’, ‘দেশদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দিয়েছে। আবার অন্য দিকে জনমনে যেহেতু অমর্ত্য সেনের বিদগ্ধ হিসাবে মর্যাদার জায়গা রয়েছে তাই বিজেপি নেতৃত্ব সরাসরি তাঁর বিরোধিতা না করে বিশ্বভারতীর উপাচার্যকে দিয়ে এ কাজ করাচ্ছেন। এ যদি না হত তবে বিজেপি নেতৃত্ব উপাচার্যের এই অর্বাচীন আচরণের বিরোধিতা করতেন, অবিলম্বে এমন আচরণ বন্ধ করতে নির্দেশ দিতেন। তার পরিবর্তে বিজেপির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের নানা আচরণে এ ব্যাপারে তাঁদের সমর্থনই স্পষ্ট হচ্ছে।
বাস্তবে উপাচার্যের এ হেন আচরণ একই সাথে বিশ্বভারতীর সুনামেও কালি ছেটাচ্ছে। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের এই অশোভন আচরণের বিরুদ্ধে রাজ্যবাসী তো বটেই সারা দেশের গণতান্ত্রিক মানুষের সোচ্চার হওয়া দরকার। কারণ, বুঝতে অসুবিধা নেই যে, অমর্ত্য সেনের অসম্মানের যদি বিরোধিতা না হয়, তবে শাসকের এই চরম ঔদ্ধত্য বাধা পাবে না এবং একবার যদি তারা এ কাজে সফল হয় তবে আগামী দিনে তাদের আক্রমণ থেকে নবজাগরণের চরিত্রগুলি, স্বাধীনতা আন্দোলনের চরিত্রগুলিও রেহাই পাবে না। কারণ আদর্শগত ভাবে এই চরিত্রগুলির সকলেরই যা অবস্থান তা শাসক বিজেপির বিভেদের, অন্ধকারের রাজনীতির বিরোধী। রামমোহন বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র দেশবন্ধু নেতাজি সহ যাঁদেরই চিন্তা এবং কাজ যুক্তি, বিজ্ঞান এবং আধুনিকতার চর্চায় ভাস্বর, তাঁরাই বিজেপির বঙ্গ বিজয়ের পথে দুর্লঙ্ঘ বাধা হিসাবে দাঁড়িয়ে আছেন। শাসক শক্তি জানে, এ-সব চিন্তাকে গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে, এই সব চরিত্রগুলির গায়ে কালি ছেটাতে না পারলে তাদের হিন্দুত্ববাদের সাম্প্রদায়িক বিজয়রথ পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হবে। এ জন্যই তারা বিদ্যাসাগরের মূর্তিও ভেঙেছেন। অমর্ত্য সেনের বিরুদ্ধে বিষোদগার সেই দুরভিসন্ধিরই অঙ্গ।
এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের কঠোর পরিশ্রমের ফসল বিশ্বভারতীকে বাঁচাতে, বাংলার মনীষার শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলিকে বাঁচাতে, অমর্ত্য সেনের মতো মানুষদের মর্যাদা রক্ষা করতে সব স্তরের মানুষের প্রতিবাদে মুখর হওয়ার মধ্য দিয়ে শাসকের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া জরুরি যে, মানীর মানহানির কোনও চেষ্টাকে দেশের মানুষ নীরবে মেনে নেবে না।