
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে এই জল্পনার মধ্যেই ১০ মে দুই দেশের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা স্বস্তির বাতাস নিয়ে আসে। ওই দিনই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষ এই যুদ্ধ বিরতি দুই দেশের জনগণকেই স্বস্তি দিয়েছে জানিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন যে, কেন বিজেপি সরকার দুই দেশের বিষয়টি নিজেদের মধ্যে নিষ্পত্তি না করে যুদ্ধবাজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, যারা প্যালেস্টাইনকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করতে ইহুদিবাদী ইজরায়েলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক ভাবে সাহায্য করছে, তাদের ভারত-পাক যুদ্ধে শান্তি স্থাপনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দিল?
যুদ্ধ মানেই মৃত্যু, নিরীহ মানুষের প্রাণহানি, সম্পত্তি ধ্বংস, বিপুল ক্ষয়ক্ষতি। এই ক্ষতি কোনও একটি দেশের নয়, যুযুধান দুই দেশেরই। যুদ্ধ যখন থেমে গেল, বিজেপি গোটা দলকে নামিয়ে দিয়েছে দেশ জুড়ে অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য প্রচার করতে ‘তিরঙ্গা যাত্রা’র মিছিলে। যাতে সামনের বিহার নির্বাচন সহ পরপর নির্বাচনগুলিতে এর থেকে ফয়দা তোলা যায়। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে পুলওয়ামা বিস্ফোরণে ৪০ জন জওয়ানের মর্মান্তিক মৃত্যুকে এই ভাবেই পুরোপুরি নির্বাচনী স্বার্থে কাজে লাগিয়েছিল বিজেপি।
কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ, যাঁরা সন্ত্রাসবাদকে আন্তরিক ভাবে ঘৃণা করেন, চান দেশের একটি মানুষেরও যেন সন্ত্রাসবাদীদের হাতে প্রাণ না যায়, পৃথিবী থেকে সন্ত্রাসবাদ যেন চিরতরে মুছে যায়, তাঁদের মনে এখন একের পর এক গুরুতর সব প্রশ্ন উঠে আসছে– যে অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য নিয়ে বিজেপি নেতারা আকাশ-বাতাস তোলপাড় করে চলেছেন, তা কি আদৌ সফল হল? এই অপারেশন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে কি এতটুকুও আটকাতে পারল? ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের ঐক্য, যা সন্ত্রাসবাদীদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, এই অপারেশন দেশের সেই আভ্যন্তরীণ সংহতিকে কতখানি বাড়াতে পারল? এই সব প্রশ্নের উত্তর দেশের মানুষের কাছে বিজেপি সরকারকে স্পষ্ট ভাবে দিতে হবে। যদি তারা দিতে না পারে তবে যুদ্ধের নামে মানুষের জীবন নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলার জন্য তারাই দায়ী থাকবে।
ভারত আমেরিকার মধ্যস্থতা মানল কেন
পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলায় ২৬ জন ভারতীয়ের মৃত্যুর পর বিজেপি-আরএসএস বাহিনী এবং তাদের আইটি সেল একে হিন্দুদের উপর আক্রমণ হিসাবে প্রচার করে দেশজুড়ে মুসলিম বিদ্বেষের বিষাক্ত ঝড় তুলে দিয়েছিল। তারপর অপারেশন সিঁদুর নাম দিয়ে পাকিস্তানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলাশুরু হতে তাকেও পাকিস্তানের উপর ভারতের বিরাট প্রত্যাঘাত বলে প্রচার শুরু করে দেয়। তারা প্রচার করতে থাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অত্যন্ত দৃঢ়চেতা রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর হাত থেকে অপরাধীরা রেহাই পাবে না। অথচ এখন বিদেশ সচিবের বক্তব্য থেকে জানা যাচ্ছে, পাকিস্তানে ভারতের বিমান হামলা ছিল পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে, আগাম বলে-কয়ে। যুদ্ধ কয়েক দিন চলল, দেশের সাধারণ মানুষ সমাজমাধ্যমে এবং সংবাদ চ্যানেলগুলির পাগল-প্রায় প্রচারে যুদ্ধ নিয়ে যখন উত্তেজিত, ঠিক এই সময়ে হঠাৎই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে দিলেন, ‘‘আমেরিকার মধ্যস্থতায় রাতভর আলোচনার পরে, আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, ভারত এবং পাকিস্তান অবিলম্বে পূর্ণ বিরতিতে সম্মত হয়েছে। ‘ ‘
ট্রাম্পের এই ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি সরকার দেশের মানুষের অজস্র প্রশ্নের মুখে পড়লেন– মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী করে সবার আগে যুদ্ধবিরতির কথা ঘোষণা করে দিলেন? মোদি সরকারই বা কী শর্তে আমেরিকার মধ্যস্থতা মেনে নিল? সরকার স্পষ্ট করে দেশবাসীকে জানাক, পহেলগামের হামলায় জড়িত সন্ত্রাসবাদীদের, যারা ভারতীয় সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী পাকিস্তানে আশ্রয়প্রাপ্ত, তাদের ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার শর্ত কি তার মধ্যে রয়েছে? কিন্তু এ সব কোনও প্রশ্নের উত্তর প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁর অন্য মন্ত্রীরা দেশের মানুষকে দেননি। ধরেই নেওয়া যায়, এ সব প্রশ্নের কোনও উত্তর সরকারের কাছে নেই।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি যুদ্ধের বদলে ব্যবসার পরামর্শ দিয়েছেন দুই দেশকে। বলেছেন, তিনি বাণিজ্য বন্ধের হুঁশিয়ারি দেওয়াতেই কাজ হয়েছে। ভারত কি তবে সন্ত্রাস বন্ধের শর্ত থেকে সরে গিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ব্যবসার শর্তে যুদ্ধবিরতি মেনে নিল? ব্যবসার কোন শর্তে ভারত যুদ্ধ বিরতি মানল? এই মধ্যস্থতার বিনিময়ে ভারত কি তবে আমেরিকার পণ্যের জন্য দেশের বিরাট বাজার হাট করে খুলে দেবে? সাম্প্রতিক আরব দেশগুলি সফরের সময়ে দোহায় দাঁড়িয়ে ট্রাম্প দাবি করেছেন, আমেরিকার প্রায় সমস্ত পণ্যে আমদানি শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনতে রাজি হয়েছে ভারত এবং সেই মর্মেই চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে এমন চুক্তি ভারত কবে করল? সেই চুক্তিতে কি ভারতের সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পেল? দেশের জনগণ, এমনকি বিরোধী দলগুলি, যারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তাদের সবাইকে অন্ধকারে রেখে প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতারা কি গোপনে এমন চুক্তি করলেন? এর দ্বারা কি তাঁরা দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা করলেন, নাকি দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থই রক্ষা করলেন? উল্লেখ্য, এ দিনই দোহায় ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজের কর্ণধার মুকেশ আম্বানি। তা ছাড়া সংবাদমাধ্যমের খবর থেকেই জানা যাচ্ছে, আমেরিকা পাকিস্তানকে বাণিজ্যে বিপুল ছাড় দিতে চলেছে। তা হলে সংঘর্ষ বিরতিকে শর্ত হিসাবে ব্যবহার করে ডুবন্ত অর্থনীতির পাকিস্তান যদি আমেরিকার সঙ্গে তার বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে নিতে পারে তবে তো অপারেশন সিঁদুরের দ্বারা পাকিস্তানই লাভবান হল দেখা যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘‘পাকিস্তানের তরফ থেকে সংঘর্ষ বিরতির প্রার্থনা করা হয়েছিল। পাকিস্তান বলেছিল, তাদের দিক থেকে আর কোনও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বা সামরিক দুঃসাহস দেখানো হবে না। তার পরেই মোদি সরকার এ নিয়ে বিবেচনা করেছে। ‘‘এ ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষকে স্পষ্ট ভাবে কিছু জানাতে রাজি হননি। প্রশ্ন উঠেছে, সংঘর্ষ বিরতির প্রস্তাব পাকিস্তান যদি দিয়ে থাকে তবে পাকিস্তানের তরফে কে দিল? ভারতের কাকে দিল? পাকিস্তান কি কোনও লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে? তা যদি না হয় তবে তা দেশের মানুষকে জানানো হল কীসের ভিত্তিতে? তা ছাড়া বিদেশ দফতরের প্রেস বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর এই কথাগুলি নেই কেন? দেশের মানুষ এগুলি জানতে চাইলেও প্রধানমন্ত্রীর তরফে এ সব প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। অপারেশন সিঁদুরে ভারতের জয়টা তা হলে কী ঘটল?
ট্রাম্প বলেছেন, কাশ্মীর প্রশ্নে তিনি নিজে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যস্থতা করবেন। তিনি উভয় দেশকে নিরপেক্ষ জায়গায় আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। বিজেপি সরকার কি এই আলোচনায় রাজি হয়েছে? যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে এটিও কি কোনও শর্ত হিসাবে কাজ করেছে? ভারতের দীর্ঘ দিনের নীতি– কাশ্মীর দ্বিপাক্ষিক বিষয়। ট্রাম্পের এই প্রস্তাব এবং পাকিস্তানের তাতে রাজি হওয়া তো বাস্তবে কাশ্মীর সমস্যায় মার্কিন হস্তক্ষেপ। অথচ তৃতীয় শক্তির মধ্যস্থতা গত ৫০ বছর ধরে ভারতের বৈদেশিক নীতিতে স্থান পায়নি। তা হলে অপারেশন সিঁদুর কি এ বার আমেরিকাকে ঢোকার সুযোগ করে দিল?
ভারত কারও সমর্থন জোগাড় করতে পারল না কেন
কাশ্মীর প্রশ্নে আমেরিকা ছাড়াও রাশিয়া এবং চিন দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়েছে। এ বার ব্রিটেনের নামও এই দলে যুক্ত হল। কয়েক দিন আগে যে ব্রিটেনের সঙ্গে ভারত অবাধ বাণিজ্য চুক্তি করে ব্রিটেনের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বের কথা ফলাও করে প্রচার করছিলেন বিজেপি নেতারা, সেই ব্রিটেনও এ ব্যাপারে ভারতের উপর চাপ বাড়াতে নেমে পড়েছে। মনে রাখা দরকার, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ পহেলগাঁও সন্ত্রাসের নিন্দা করলেও কোনও বড় শক্তিই কিন্তু পাকিস্তানের নাম সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়ায়নি, তেমনই ভারত পাকিস্তানকে আইএমএফের ঋণ দেওয়ার বিরোধিতা করলে তাতেও তারা সায় দেয়নি। সিন্ধু জলচুক্তি বাতিল করে ভারতের পাকিস্তানকে জল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন পায়নি। বরং এ ক্ষেত্রে তারা ভারতকে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলার পরামর্শই দিয়েছে। বিজেপির প্রচারক বাহিনী এবং ধামাধরা মিডিয়া বাহিনী প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বগুরু হিসাবে প্রচারের যে বিরাট বেলুন তৈরি করেছিলেন, চার দিনের যুদ্ধই তাকে ফুটো করে দিল। বাস্তবে বিজেপি সরকারের ভুল বিদেশনীতিতে সন্ত্রাসবাদী হামলায় ভারতের ২৬ জনের নির্মম মৃত্যু এবং পাকিস্তানি গোলায় ১০ হাজার বাড়ি এবং ২২ জন ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যু সত্ত্বেও ভারত কি বিশ্বে একা হয়ে পড়ল না? একা যে হয়ে পড়েছে তা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল যখন বিজেপি সরকার দেশে দেশে প্রচার করার জন্য বিরোধী দলগুলির সদস্যদের নিয়ে কমিটি গড়ে দিল। বিজেপি সরকারের গত এক দশকের শাসনে যে বিরোধীদের শুধু অবজ্ঞাই জুটেছে তাদের প্রতি সরকারের এত আস্থাই বুঝিয়ে দেয় সরকার যুদ্ধ থেকে ফয়দা তুলতে গিয়ে বাস্তবে গোটা দেশকেই একঘরে করে ফেলেছে।
সমাজমাধ্যম এবং ধামাধরা চ্যানেলে মিথ্যার বন্যা
পহেলগাঁও গণহত্যার মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা মোকাবিলায় সরকার দেশের অভ্যন্তরেই বা কতটুকু সংহতি গড়ে তোলার চেষ্টা করল? এই গণহত্যা দেশ জুড়ে মত-ধর্ম নির্বিশেষে স্বতঃস্ফূর্ত এবং ঐক্যবদ্ধ বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। এই বিক্ষোভে কাশ্মীরও বাকি দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। সংসদীয় বিরোধীরা সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে গোটা দেশের আবেগ একত্রিত হয়েছিল। আর এ ক্ষেত্রে শাসক দলের ভূমিকাটি কী ছিল? তাদের ভূমিকা ছিল পুরোপুরি ঐক্য-সংহতির বিরোধী। বিজেপি-আরএসএস বাহিনীর হাতে কাশ্মীরের ছাত্ররা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আক্রমণের শিকার হতে শুরু করলেন। সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করেও যাঁরা যুদ্ধের বিরুদ্ধতা করলেন এবং এর পিছনে যে বিজেপির একটা অন্য উদ্দেশ্য আছে সেই সন্দেহের কথা বললেন, তাঁদের দেশদ্রোহী, পাকিস্তানপন্থী বলে দেগে দেওয়া হতে থাকল। পহেলগাঁও ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর যাঁরা বিরোধিতা করেলেন তাঁদের ‘সেকু’ বলে গালি দেওয়া হতে থাকল। বিজেপি-আরএসএস বাহিনীর এই প্রচারে তাল মেলায় সরকারি এবং একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন সংবাদ চ্যানেলগুলি। যে দু-একটি চ্যানেলের উপর সত্য খবরের জন্য কিছুটা নির্ভর করা চলত, সেগুলিও ফেক তথা মিথ্যা, বানানো খবর প্রচারের লজ্জাজনক উন্মাদনায় এমন মেতে উঠল যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতীয় মিডিয়ার মর্যাদা কার্যত ধুলোয় মিশে গেল।
বিজেপি নেতাদের প্রচার জাতীয় সংহতির বিরুদ্ধে গেল
এই উন্মাদনা এমন মাত্রায় পৌঁছল যে, পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডে নিহত বায়ুসেনার আধিকারিক বিনয় নারওয়ালের স্ত্রী হিমাংশী যখন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেও কাশ্মীরী এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ না ছড়ানোর কথা বলেন, তখন তাঁর ব্যক্তিগত ব্যথা-যন্ত্রণাকে পর্যন্ত কোনও আমল না দিয়ে তাঁকে ক্রমাগত আক্রমণ করতে থাকল এই কুৎসা-বাহিনী। সমাজের সচেতন অংশের বিরুদ্ধে বিজেপি-আরএসএস বাহিনীর এই কুৎসা যে নিছক কোনও আবেগ প্রসূত নয় তা বুঝতে কারওরই অসুবিধা হয়নি যখন দেখা গেল কোনও বিজেপি নেতা-মন্ত্রীই অনুগামীদের এই কুৎসিত আচরণের বিরোধিতা করতে এগিয়ে এলেন না। আবার খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের বিদেশসচিব সংঘর্ষ বিরতির কথা ঘোষণা করলে এই শক্তিই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আকার নিয়ে তাঁকেও আক্রমণ করতে ছাড়ল না। তাঁকে শুধু দেশদ্রোহী, পাকিস্তানপন্থী বলেই এই বাহিনী ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর মেয়ের নামেও কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ করতে থাকে। যুদ্ধের অগ্রগতি ঘোষণা করতে সাংবাদিক সম্মেলনে একজন মুসলিম এবং একজন শিখ মহিলা সেনা অফিসারকে পাশে বসিয়ে বিদেশসচিব ধর্মনিরপেক্ষতার যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন তাকে পর্যন্ত নস্যাৎ করে দিয়েছে বিজেপির যুদ্ধবাজ নেতা-কর্মীরা তাঁদের কলঙ্কজনক অপপ্রচারে। যেখানে সোসাল মিডিয়ায় এতটুকু সরকার বিরোধিতা দেখলে কর্তৃপক্ষ, সরকার এফআইআর করতে এতটুকু দেরি করে না, সেখানে এই মিথ্যা, বানানো এবং জাতীয় সংহতির পরিপন্থী প্রচারের বন্যাতেও একটি এফআইআর-ও তাদের করতে দেখা যায়নি। শাসক শক্তির পরিচালনায় দেশের স্বার্থকে সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে বিভাজনের রাজনীতির কাছে বলি দেওয়া হল।
তাই বিজেপি যতই ‘ত্রিরঙ্গা যাত্রা’ করে অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য প্রচার করতে থাকুক, বাস্তবে এই অপারেশনের দ্বারা সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করা তো গেলই না, এমনকি পহেলগাঁও কাণ্ডে দোষীদেরও চিহ্নিত করা গেল না। ভারতের অভ্যন্তরীণ সংহতি আরও দুর্বল হয়ে বিভাজন আরও চওড়া হল এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান আরও দুর্বল হল। কাশ্মীরের বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক থেকে বহু পাক্ষিক বিষয় হয়ে উঠল। তাই সাফল্য দূরে থাক অপারেশন সিঁদুর বহু অপ্রীতিকর প্রশ্ন তুলে দিল।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ২৩ – ২৯ মে ২০২৫ এ প্রকাশিত