‘‘গণতন্ত্র, অধিকার এইসব বড় বড় কথার আড়ালে অথরিটিকে কোনও ভাবে লঘু করার চেষ্টা হলে, তার অর্থ দাঁড়াবে বাস্তবে পার্টি নেতৃত্বের অবসান ঘটানো, পার্টি সংহতির অবসান ঘটানো, জনগণকে নেতৃত্বহীন চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া। অথরিটি বাদ দিলে মতাদর্শগত সংগ্রামকেও একটা খোলা ময়দানের তর্কাতর্কিতে পরিণত করা হবে, বিপ্লবী পার্টিকে একটা লক্ষ্যহীন বিতর্ক সভায় অধঃপতিত করা হবে।
এ জিনিস কোনও দিন কোনও বিপ্লবী পার্টি চিন্তা করতে পারে না। ফলে, ব্যক্তিপূজা বা যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার নামে অথরিটিকে হেয় করার, লঘু করার কোনও প্রবণতা বা চিন্তাকেই সমর্থন দূরের কথা, বিন্দুমাত্র লঘু করে দেখা চলে না। আমি যদি আমার কোনও আলোচনার ধরন, কোনও প্রশ্ন তোলার ধরনের দ্বারা পার্টি অথরিটিকে খাটো করে ফেলি, তবে তার দ্বারা আমি গুরুতর অন্যায় ও অপরাধ করব। কোনও বিপ্লবী পার্টি সেটা মেনে নিতে পারে না, মেনে নেওয়া উচিত নয়। এখানেই হচ্ছে সীমারেখা।
পার্টির আভ্যন্তরীণ জীবনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে কোনও বিষয়ে আলোচনার, তর্কাতর্কির ব্যাপক অধিকার পার্টি একজনকে দেবে। কিন্তু, এই ব্যাপক কথাটার মানে সব সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া নয়। সেখানে সীমাটা হচ্ছে, কেউ আলোচনার নামে অথরিটিকে খাটো করতে পারেন না। অথরিটি সম্পর্কে উপলব্ধিটা কোথাও যান্ত্রিক হচ্ছে মনে করলে, তা নিয়ে কেউ আলোচনা করতে পারেন, তবে সেক্ষেত্রে তাঁর প্রশ্নটা হবে সুনির্দিষ্ট। অর্থাৎ যে জায়গায় তিনি মনে করছেন, উপলব্ধিটা যান্ত্রিক হচ্ছে, তিনি সে জায়গাটা দেখিয়ে বলবেন, এই জায়গাটার উপলব্ধি যান্ত্রিক হচ্ছে, এখানে বিষয়টা সম্পর্কে বোঝা সঠিক হয়নি বলেই এটা হচ্ছে, বিষয়টা এভাবে বোঝা হলে যান্ত্রিক হত না। প্রশ্নের উত্থাপনাও এ ভাবে হবে, তবে তার দ্বারা বিপ্লবী আন্দোলনও উপকৃত হবে। কিন্তু প্রশ্ন ও আলোচনা যদি বড় কথার আড়ালেও এমনভাবে তোলা হয়, যার দ্বারা অথরিটি সম্পর্কেই প্রশ্ন এসে যেতে পারে, তবে তাতে কোনও মতেই সম্মতি দেওয়া যায় না। দিলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়, ক্রুশ্চেভের মতো শোধনবাদীদের হাতে পড়ে যেটা সাম্যবাদী আন্দোলনে হয়ে গেল। ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার নামে তারা স্ট্যালিনের অথরিটিকে খাটো করে দিল এবং তার পথ বেয়ে সাম্যবাদী আন্দোলনে শোধনবাদের সিংহদরজা খুলে দিল।
লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের মধ্য দিয়েই লেনিনবাদ সঠিক ও সুনির্দিষ্ট উপলব্ধির রাস্তা পেয়েছিল। ক্রুশ্চেভরা সেটাকে ধ্বংস করে দিল। এর ফলে লেনিনের মূল সিদ্ধান্তগুলো যার যেমন খুশি ব্যাখ্যা করার বিষয় হয়ে দাঁড়াল, পরিণামে আদর্শগত ক্ষেত্রে শোধনবাদ-সংস্কারবাদের অনুপ্রবেশের দরজা খুলে দেওয়া হল। না হলে, অনেক দেশেই কমিউনিস্টদের আত্মদান ছিল, সংগ্রাম ছিল, কাজকর্ম ছিল, অগ্রগতি ছিল। বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলন বহু দূর এগিয়ে গিয়েছিল। তারপর একটা বিরাট সময় ধরে কেবলই পিছনে হটে এল। অন্ধকার যুগ নেমে এল কমিউনিস্ট আন্দোলনে। ব্যক্তিপূজাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে ক্রুশ্চেভরা সর্বনাশ করে দিল। ব্যক্তিপূজাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা অত সোজা নয়। তার জন্য ব্যক্তিপূজাবাদের জন্ম নেওয়ার মূল কারণটা জানতে হয়। এসব কথা ক্রুশ্চেভরা চিন্তা করেনি। তারা স্ট্যালিনকে খাটো করার দ্বারা সাম্যবাদী আন্দোলনে অথরিটির সমগ্র ধারণাকেই ধ্বংস করে দিল।
স্ট্যালিন নিছক একজন ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন অথরিটি ধারণার মূর্তরূপ। স্ট্যালিন সম্পর্কে জনসাধারণের ভূমিকার প্রশ্নটা কীসের সঙ্গে জড়িত? স্ট্যালিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটা গৌরবময় স্মৃতি। তাঁর নামের সঙ্গে, তাঁর মর্যাদার সঙ্গে, তাঁর অথরিটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের একটা ব্যাখ্যা, যা জানার জন্য মানুষের মধ্যে প্রবল আগ্রহ। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ শিখতে হলে স্ট্যালিনের দেখানো পথেই যেতে হবে, কোনও ধারণার ঠিক-বেঠিক বিচার স্ট্যালিনের দেওয়া মানদণ্ডেই করতে হবে। সমগ্র বিশ্বের মেহনতি মানুষের ও কমিউনিস্টদের এই মানসিকতাকেই ধ্বংস করে দেওয়া হল স্ট্যালিনকে মসীলিপ্ত করে, তার অথরিটিকে বিলুপ্ত করার মধ্য দিয়ে।”
‘বৈজ্ঞানিক দ্বন্দ্বমূলক বিচারপদ্ধতিই মাক্সর্বাদী বিজ্ঞান’ বই থেকে