৩ জুন, মণিপুরের জাতিদাঙ্গা শুরু হওয়ার ঠিক একমাস পর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে দুই সাংবাদিক দেখেছেন, মণিপুরে পাহাড়বাসী কুকি, জো ইত্যাদি আদিবাসী এবং উপত্যকাবাসী মেইতেইদের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ এতটাই গভীর যে, সে রাজ্যে কর্মরত কেন্দ্রীয় সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার থেকে শুরু করে পুলিশ কর্মচারী, অধ্যাপক, শিক্ষক সকলে এমন জায়গায় বদলি হতে চাইছেন যেখানে নিজের জাতিগত (এথনিক) জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগত আধিপত্য আছে। এমনকি মণিপুর রাজ্য পুলিশের অফিসার হয়েও জাতিগত পরিচয়ের কারণে একমাস ধরে রিলিফ ক্যাম্পে দিন কাটছে এমন উদাহরণও কম নয়।
মণিপুরের পাহাড়ী অঞ্চলের বাসিন্দা আদিবাসী মূলত কুকি জনগোষ্ঠী এবং উপত্যকাবাসী মেইতেইদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল ৩ মে। একমাস পার করেও প্রতিদিন খবর আসছে দাঙ্গা, আগুন লাগানো, লুঠপাটের। মানুষের প্রশ্ন এর শেষ কোথায়? ইতিমধ্যে সরকারি হিসাবেই মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। ৫০ হাজারের বেশি মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে রিলিফ ক্যাম্পে অথবা অন্য রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে হাজারের বেশি। এর পরেও কোথায় পরিস্থিতি গড়াবে কেউ বলতে পারছে না। যদিও এই অন্ধকারের মধ্যে আলোর রেখা হয়ে উঠে এসেছেন বিবাদমান দুই পক্ষের কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, বিশেষত মহিলারা, যাঁরা অন্য জনগোষ্ঠীর আক্রান্ত মানুষের প্রাণ বাঁচাতে নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও এগিয়ে এসেছেন। আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আসাম থেকে এসইউসিআই(সি)-র স্বেচ্ছাসেবকরা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে মণিপুরে ক্যাম্প করেন। মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের স্বেচ্ছাসেবকরা ইম্ফল সহ একাধিক জায়গায় চিকিৎসা শিবির করেন।
কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের নিষ্ক্রিয়তা
প্রশ্ন উঠেছে জাতিদাঙ্গা শুরুর আগেই তা আটকাতে কিংবা শুরু হওয়ার পর তা থামাতে কেন্দ্র এবং রাজ্যের সরকার কী করেছে? তারা যে কার্যত কিছুই করেনি এতদিনে তা সারা দেশের জানা হয়ে গেছে। সরকার দাঙ্গা আটকাবে কি– সরকারি অস্ত্রাগার থেকেই চার হাজারের বেশি আধুনিক অস্ত্র লুঠ হয়ে গেছে। পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনী তা রুখতে প্রায় কোথাও কড়া ব্যবস্থা নেয়নি। সরকার না চাইলে বাহিনী কি এমন নিষ্ক্রিয় থাকতে পারত? মণিপুর যখন প্রতিদিন রক্তে ভাসছে, তখন সমস্যা সমাধানে দ্রুত ছুটে যাওয়ার বদলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দীর্ঘ সময় ব্যস্ত ছিলেন কর্ণাটকের ভোটে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে। পরেও তাঁদের মুখে এ প্রসঙ্গে কার্যকরী কিছু শোনা যায়নি। অবশেষে প্রায় একমাস পর দেশ জুড়ে সমালোচনার ধাক্কায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গাত্রোত্থান না করে পারেননি। তিনি মণিপুরে চারদিন কাটিয়ে যে সব বাণী দিয়েছেন তার মোদ্দা কথা হল সরকার তদন্ত কমিশন করবে। রাজ্য পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ নিয়ে রাজ্যের মানুষের যে প্রবল ক্ষোভ, তা বুঝেই তিনি তদন্তের নামে কালক্ষেপ করতে চেয়েছেন। পরিস্থিতি এমন যে পুলিশের যে কাজ করার কথা তা তিনি নিজের ঘাড়ে নিয়ে জনগণের কাছে আবেদন করেছেন, লুঠ করা অস্ত্র জমা দিন। যদিও তারপর এক সপ্তাহে মাত্র শ’দেড়েক অস্ত্র ফেরৎ এসেছে বলে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। মণিপুর হাইকোর্টের যে রায় দাঙ্গার তাৎক্ষণিক কারণ হিসাবে সমালোচিত হয়েছে তাকে তিনি তাড়াহুড়োর রায় বলেছেন। মণিপুরের নাগরিক সমাজের সাথে কথা বলার প্রয়োজনবোধ তাঁর অবশেষে জেগেছে– কিন্তু সবটাই বড় দেরিতে! তিনি এবং প্রধানমন্ত্রী যেমন চুপ করে বসে ছিলেন, তেমনই তাঁর দলের রাজ্য সরকারও দাঙ্গা যেন চলতেই দিয়েছে। অমিত শাহের অতীত উদ্ধৃতি, ‘ক্রোনোলজি সমঝিয়ে’ স্মরণ করে সন্দেহ হয় আসলে বিজেপি নেতৃত্ব এই অশান্তি চলতে দিতেই চেয়েছে।
২৭ মার্চ মণিপুর হাইকোর্টের এক বিচারপতির বেঞ্চ যখন সে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মেইতেইদের তফশিলি জনজাতি (এসটি) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ করতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়, সরকার কি তার পরিণাম জানত না? তাহলে রাজ্য সরকারের আইনজীবীরা হাইকোর্টে সঠিক ভূমিকা নেননি কেন? এমনকি সুপ্রিম কোর্টও বলেছে, হাইকোর্টের মামলায় আইনজীবীরা সঠিক ভূমিকা নিলে তাঁরাই আদালতকে স্মরণ করিয়ে দিতেন, এই রায় তার এক্তিয়ারের বাইরে যাচ্ছে (দ্য টেলিগ্রাফ, ৮.০৫.২০২৩)। দেখা গেল রায়ের পর এক মাসের বেশি সময় রাজ্য এবং কেন্দ্রের ‘ডবল ইঞ্জিন’ বিজেপি সরকার কার্যত যেন জাতিদাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করেই ছিল! হানাহানি ছড়িয়ে পড়ার অনেক পরে সরকার যত দিনে নড়ে বসেছে, তত দিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্টে মণিপুরের জনজাতি সংগঠন অভিযোগ জানিয়েছে যে, বিজেপি সরকারের জন্যই ‘এথনিক ক্লিনসিং’ বা জাতিগতভাবে একটি অংশের জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে দাঙ্গা ছড়াতে পেরেছে।
বেশ কিছুদিন ধরে বিজেপির রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুরে পাহাড়ে এবং বনাঞ্চলে মায়ানমার থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী খোঁজার অছিলায় ভারতীয় নাগরিক আদিবাসীদেরও স্বাভাবিক এবং আইনগত অধিকার দিতে অস্বীকার করছে। তারা বহু গ্রাম উচ্ছেদ করার কাজ শুরু করেছে। সংবিধানের ৩৭১-সি ধারা এবং আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত আইনগুলি অকেজো করে রেখে অধিকাংশ বনাঞ্চলকে ‘রিজার্ভ ফরেস্ট’ ঘোষণা করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করতে অভিযান চলছে। মূলত কুকি জনজাতিদের বেশ কিছু গ্রাম সরকার উচ্ছেদ করেছে বা উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছে। এ সবের ফলে পাহাড়ি জনজাতিদের মধ্যে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আশঙ্কা, উদ্বেগ ও ক্ষোভ দানা বাঁধছে। এ কথা ঠিক যে, এই সমস্ত এলাকায় দারিদ্র এবং অন্য পেশার সুযোগের অভাবে আদিবাসী জনজাতিভুক্ত মানুষ পোস্ত চাষে আকৃষ্ট হন। জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে সরকার যেমন সাধারণ মানুষকে বিকল্প রোজগারের রাস্তা দেখাতে পারত, তেমনই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে একে ঘিরে চলা ড্রাগ ব্যবসা দমন করে এই চাষকেই প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরি ও অন্য অর্থকরী ব্যাপারে কাজে লাগাতে পারত। তা না করে জনজাতিদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার কাজে পোস্ত চাষ বন্ধকেই অজুহাত করেছে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার। এই পার্বত্য জনজাতিগুলির মধ্যে বহুদিন ধরেই সমতল এবং ভারতের অন্যান্য অংশের সাথে বিচ্ছিন্নতারবোধ আছে। এই বিচ্ছিন্নতার মূলে আছে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথেও তাদের বিচ্ছিন্নতা। জাতীয় নেতারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে এদের অঙ্গীভূত করে নেওয়ার চেষ্টা করেননি। বরং নানা অছিলায় দমন পীড়ন চালিয়েছেন। স্বাধীনতার পর ঐতিহ্যগত এই শূন্যতাকে ভারতীয় পুঁজিবাদ তার রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগিয়েছে। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সংকট বর্তমান সংকটের পশ্চাদভূমি হয়ে রয়েছে।
একচেটিয়া মালিকদের সেবাদাস হিসাবে কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিজেপি সরকার দুই দল শোষিত মানুষের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ জিইয়ে রাখতেই চেয়েছে। যাতে তারা মানুষের ওপর দমন পীড়ন চালানোর ‘নৈতিক ছাড়পত্র’ পেয়ে যেতে পারে। ফলে মণিপুর হয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাথে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ পথ, সে রাজ্যের খনিজ এবং বনজ সম্পদ ও জমির ওপর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মালিকানার বদলে বৃহৎপুঁজিদের কর্পোরেট কোম্পানির মালিকানার থাবা বসাতে সুবিধা হবে। অন্যদিকে সরকারি দলের পক্ষে এক একটি গোষ্ঠীর ত্রাতা সেজে তাদের ভোট কেনার সুযোগ আসবে।
বিভাজনের রাজনীতি সমস্যা বাড়াচ্ছে
এসটি সংরক্ষণের প্রশ্নের সাথে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জনগোষ্ঠীগুলির পরিচিতির সংকট (আইডেন্টিটি ক্রাইসিস)-কে। আদিবাসীদের মধ্যে একদল সুযোগ-সন্ধানী প্রচার করছে, উপত্যকাবাসী এবং রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইরা এমনিতেই তোমাদের থেকে বেশি অগ্রসর। রাজ্যের ৬০ সদস্যের বিধানসভায় তারাই ৪০ জন। রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তারা প্রভাবশালী। ফলে তারা এসটি তালিকায় এলে জনজাতিরা সব হারাবে।
অন্যদিকে মেইতেইদের মধ্যে প্রচার হয়েছে, কুকি, জো, চিন ইত্যাদি জনজাতির লোকেরা দলে দলে মায়ানমার বা ভারতেরই অন্য রাজ্য থেকে এসে মণিপুরের অধিকাংশ জমি দখল করে নেবে। তাতে মেইতেইদের গরিষ্ঠতা ধাক্কা খাবে। এসটি হতে পারলে তোমরাও পাহাড়ে জমি কিনতে পারবে। কারণ আইন অনুসারে মণিপুরে তফশিলি জনজাতিদের জমি তারা ছাড়া অন্য জনগোষ্ঠীর কেউ কিনতে পারে না। মণিপুরে পার্বত্য এলাকা এবং বনাঞ্চল ৯০ শতাংশ, উপত্যকা মাত্র ১০ শতাংশ। এই উপত্যকাতেই ৫৩ শতাংশ লোকের বাস। ফলে আরও জমি পেলে তোমাদের উন্নতি হবে। প্রচার হচ্ছে, এসটি তালিকাভুক্ত হলে চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রের দরজা মেইতেইদের জন্য হাট করে খুলে যাবে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে শাসক দলের অধিকাংশ নেতাই মেইতেই জনগোষ্ঠীভুক্ত। তাঁদের একপেশে এবং সাম্প্রদায়িক ভূমিকা নানা অংশের মানুষের মধ্যে বৈরিতা বাড়াতেই সাহায্য করেছে।
রাজ্য প্রশাসন এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট যে, জনজাতিভুক্ত এক বিজেপি এমএলএ আক্রান্ত হলেও রাজ্যের পুলিশ বাহিনী প্রায় দর্শক হয়েই থেকেছে। বিজেপির কিছু নেতা মেইতেইদের হিন্দু এবং জনজাতিদের খ্রিস্টান হিসাবে দেখিয়ে এই সংঘর্ষে ধর্মীয় রং দিতে চেয়েছেন। এর ফল হচ্ছে মারাত্মক। মণিপুরের পাহাড় থেকে নির্বাচিত এমএলএ-দের মধ্যে থেকেই পাহাড়ে আলাদা প্রশাসনের দাবি উঠছে। ফলে বিচ্ছিন্নতাবোধ আরও জোরদার হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
অন্য রাজ্যের মতো মণিপুরেও বিজেপি শাসনের ওপর মানুষের ক্ষোভ প্রবল। বিজেপি চেয়েছে সরকার বিরোধী এই ক্ষোভকে দাঙ্গার স্রোতে ভাসিয়ে দিতে। উপত্যকার মানুষের ক্ষোভ চাপা দিতে তারা মেইতেইদের ত্রাতা সাজতে চায়। কিন্তু বিজেপি যে ভাবে মণিপুরের সমগ্র মেইতেই গোষ্ঠীকে একমাত্রিক হিন্দুত্বের নিরিখে দেখাচ্ছে, তাতে তৈরি হচ্ছে নতুন সমস্যার সম্ভাবনা। মেইতেইদের বড় অংশ হিন্দু হলেও তাদের মধ্যে উচ্চবর্ণ, ক্ষত্রিয়, এসসি, ওবিসি ইত্যাদি সম্প্রদায়গত ভাগ আছে, এমনকি বেশ কিছু মুসলিমও আছেন। সকলে এক গোষ্ঠীভুক্ত হতে চাইবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অন্যদিকে, বিজেপি এবং আরএসএস উত্তরপূর্ব ভারতের প্রাচীন লোকবিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রচলিত ধর্মগুলির গায়ে উগ্র হিন্দুত্বের ছাপ লাগাতে চায়। মেইতেইদের মধ্যেও বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের পাল্টা হিসাবে প্রাচীন সানামাহি ধর্মের কথা উঠছে। বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক লাইন এ জাতীয় আরও নতুন নতুন সমস্যার জন্ম দিতে পারে বলে বহু সমাজবিদের আশঙ্কা।
জাতি পরিচয় নির্বিশেষে সব সাধারণ মানুষই বঞ্চিত
সাম্প্রতিক এই হানাহানি মণিপুরের জনজীবনের গভীর সমস্যাকে একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এ দেশের মানুষ এমন পরিস্থিতিতে বাস করেন যে, সংরক্ষণের সামান্য সুবিধা পাওয়া বা না পাওয়ার প্রশ্ন যেন তাঁদের অস্তিত্বের সংকট ডেকে আনছে। এত বছর ধরে যে সমস্ত জনজাতি সংরক্ষণের আওতায় থেকেছেন তাঁদের জীবনের কোনও একটি জ্বলন্ত সমস্যার সুরাহা কি এসটি বা এসসি সংরক্ষণের ফলে ঘটেছে? অন্যদিকে, মেইতেইরা যদি এসটি সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েও যান, তাতেও তাঁদের জীবনের মৌলিক সমস্যাগুলির কি কোনও সমাধান হবে? দিল্লির পূর্বতন কংগ্রেস থেকে শুরু করে বর্তমান বিজেপি শাসকদের আমলেও মণিপুর সহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়নের নিরিখে চরম অবহেলিত থেকেছে। শিল্প, সরকারি চাকরির সুযোগ, উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একেবারেই হাতে গোনা। এ সবের কোনও সুরাহা হবে কি?
মণিপুরের জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে। শহরাঞ্চলের দারিদ্রের নিরিখে সারা ভারতে শীর্ষে। ২০২০-২১-এর অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী এই রাজ্যের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি যুবদের ৪৫ শতাংশ বেকার। লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট দেখাচ্ছে কর্মক্ষম জনসংখ্যার মাত্র ৩২ শতাংশ কিছু কাজ পায় (দ্য টেলিগ্রাফ ৫.৩.২০২২)। ৩ লক্ষ ৩৫ হাজারের বেশি বেকার দীর্ঘদিন কাজ না পেয়ে অথবা কাজ পাওয়ার বয়স পেরিয়ে যাওয়ার কারণে ২০২২-এর অক্টোবরে এমপ্লয়মেন্ট রেজিস্টার থেকে নাম তুলে নিয়েছেন (ইম্ফল ফ্রি প্রেস ২৮.১০.২০২২)। এই রাজ্যের অকৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষের ৬৫ শতাংশই স্বনিযুক্ত। সরকারি বা বেসরকারি মিলিয়ে নির্দিষ্ট বেতনের স্থায়ী কিংবা ক্যাজুয়াল চাকরি মণিপুরে মোট কর্মসংস্থানের মাত্র ২৭.৮ শতাংশ। মণিপুরে শিল্প অতি নগণ্য, সরকারি চাকরিও খুব কম। সংরক্ষণের আওতায় থেকেও পার্বত্য জেলাগুলির আদিবাসী মানুষের মধ্যে দারিদ্র এবং কর্মহীনতার মাত্রা অতি তীব্র। তাহলে নতুন করে কোনও সম্প্রদায় সংরক্ষণের সুবিধা পেলেও চাকরি পাবেন কোথায়? মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, কোনও জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণ থাকলেও তার সুযোগ নিয়ে সরকারি চাকরি কিংবা ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের সুযোগ পায় সংরক্ষণভুক্ত জনগোষ্ঠীর ধনী এবং প্রভাবশালী পরিবারের হাতে গোনা কয়েকজনই। তাই চাকরিই যেখানে নেই, তার সংরক্ষণ নিয়ে দুই দল শোষিত মানুষের মধ্যে লড়াইতে কাদের লাভ হচ্ছে? বিবদমান জনগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় তা ভাবতে হবে। গণদাবীর পাতায় আমরা বারে বারেই দেখিয়েছি– সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকা বা না থাকা দিয়ে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, শিক্ষাহীনতা, সমাজিক বৈষম্যের সমাধান কোনও ক্ষেত্রেই হয় না। কিন্তু এই নেই-রাজ্যের দেশে যদি কিছু সুযোগ বাড়ে– এই আশায় এখন ভারতের নানা জায়গাতে একাধিক জনগোষ্ঠী নানা ধরনের সংরক্ষণ চেয়ে বিশেষত এসটি তালিকায় প্রবেশের জন্য আন্দোলন শুরু করেছেন।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গেও কুড়মি বা মাহাতো জনগোষ্ঠীর মানুষ একটানা কয়েকদিন রেল অবরোধ করে এসটি তালিকায় প্রবেশের দাবিকে সামনে আনতে চেয়েছেন। তাঁদের এই দাবির পাল্টা বিরোধিতা করেছে আদিবাসী সংগঠনগুলি। এই নিয়ে একটা সংঘাতের পরিস্থিতিও তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে। অথচ দুই জনগোষ্ঠীরই শোষিত মানুষের সমস্যা যে এক, তা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন কি? একই রকমের দাবি উঠছে রাজস্থান, গুজরাট, হরিয়ানা সহ ভারতের নানা রাজ্যে। তা নিয়ে রক্তাক্ত হানাহানিও হচ্ছে।
অবৈজ্ঞানিকভাবে আন্তর্জাতিক ও রাজ্যগুলির অভ্যন্তরীণ সীমানা নির্ধারণ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমস্যাকে আরও বাড়িয়েছে। মিজোরাম, মণিপুরের আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলির নানা শাখার মানুষ পাশের দেশ মায়ানমারেও আছেন। তাঁদের মধ্যে আদানপ্রদানও আছে। এ জন্য কোনওমতেই মণিপুরের সমস্ত কুকি, জো, চিন, জোমি জনগোষ্ঠীর মানুষকে বহিরাগত বলা চলে না। অনুপ্রবেশ যদি কিছু হয়ে থাকে তা রুখতে এবং শরণার্থীদের নিজের জায়গায় পাঠানোর আইনি পথ সরকার নিতে পারে। তার জন্য অত্যাচারের রাস্তা নিতে হয় না। দরিদ্র জনজাতিদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিলে ভারত সরকার এই সমস্যা অনেকটাই মেটাতে পারে। কিন্তু কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও সরকারই এই দায় নেয় না।
প্রান্তিক মানুষের ‘পরিচিতির সংকট’ পুঁজিবাদেরই সৃষ্টি
নানা কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য জনজাতিগুলির সাথে সমতলের মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মেলামেশা আদানপ্রদানের ফাঁক থেকে গেছে। যেটা উত্তর-পূর্বের নানা অংশে একটা পরিচিতির সংকট হিসাবে দেখানো হয়়। এই অংশের মানুষ নিজেদের মূল ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন বলে অনুভব করেন। এর কারণ অনেকাংশে আছে এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুর্বলতার মধ্যে। স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রাধান্য বিস্তারকারী গান্ধীবাদী আপসমুখী ধারার নেতাদের মধ্যে তথাকথিত উচ্চবর্ণের প্রাধান্য ছিল। তাঁদের মধ্যে থাকা ভাষাগত, জাতিগত প্রশ্নে উচ্চবর্ণজাত আভিজাত্য, অহংবোধ ও মানসিকতা জনজাতিভুক্ত মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে যোগ দিতে বাধা দিয়েছে।
স্বাধীনতার পরেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সার্বিক উন্নতির দিকে কোনও সরকারই নজর দেয়নি। ফলে কিছুটা বিচ্ছিন্নতা বোধ নিয়েই এই অঞ্চলের মানুষ থেকেছেন। একে ব্যবহার করে একদল সুযোগ সন্ধানী নেতা নিজেদের আখের গোছানোর জন্য পৃথকতাবাদী শক্তিগুলোকে মাথা চাড়া দিতে সাহায্য করে। একসময় কংগ্রেস সরকার উপত্যকা এবং পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর কিছু প্রভাবশালী অংশকে খুশি রেখে বাকি জনগণের ওপর দমন পীড়ন চালিয়ে উত্তর-পূর্বকে ঠাণ্ডা করতে চেয়েছিল। বিজেপিও একই কায়দা নিয়েছে।
এই অঞ্চলের একদল প্রভাবশালী সম্পত্তিবান মানুষ দিল্লির শাসকদের ছায়ায় থাকতে কেন্দ্রে যে সরকার আসে তাদের দিকেই ঢলে পড়ে। এই প্রভাবশালীদের জোরেই কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলই সাধারণত মণিপুরে বিধানসভা ভোটে জিতে সরকার গড়ে। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের প্রকৃত মনোভাব প্রতিফলিত হয় না। যে কারণে মণিপুরের পাহাড়ে এবং উপত্যকাতেও গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় শাসকদের ওপর মানুষের ক্ষোভ আছে। দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের প্রকৃত দাবিগুলি না শুনে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনের অজুহাতে কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক বাহিনীর হাতে যথেচ্ছ স্বৈরাচারী ক্ষমতার ‘আফস্পা’ আইন তুলে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে মণিপুরের পাহাড়ে যেমন মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে পৃথক হতে চেয়েছে, তেমনই উপত্যকাতেও তা হয়েছে। শর্মিলা চানুর অনশন-আন্দোলন, মিলিটারির অত্যাচারের বিরুদ্ধে মহিলাদের আন্দোলন এ সবই ঘটেছে মণিপুরের উপত্যকায়। বিজেপি আগুন নিয়ে খেলতে গিয়ে সে সত্য বোধহয় ভুলে যেতে চাইছে।
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় একদিকে যেমন খেটে খাওয়া মানুষের ওপর শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির দমন পীড়ন থাকে, একই সাথে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী জনগোষ্ঠীর দাপট দেখানোর চেষ্টা থাকে দুর্বল জনগোষ্ঠীর উপর। মহান মাক্সর্বাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে আপসমুখী ধারা প্রধান হয়ে ওঠার ফলে এ দেশে জাতিগঠনের মধ্যেই দুর্বলতা থেকে গেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজনৈতিকভাবে ভারত এক হলেও ভাষাগত, জাতিসত্তাগত, উপজাতিগত, প্রাদেশিক এমন কি এক প্রদেশের মধ্যেও নানা এলাকার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা থেকে গেছে। মাঝে মাঝেই তা ফেটে পড়তে চায়। শাসকরাও উস্কানি দেয় খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্য ভাঙার জন্য। মণিপুর সহ সমগ্র ভারতের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে বুঝতে হবে প্রান্তিক মানুষের বিচ্ছিন্নতা বোধ, তাদের ‘পরিচিতির সংকট’ আসলে এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী সৃষ্টি।
এই সমস্যার থেকে মুক্তি পেতে হলে সারা দেশের খেটেখাওয়া মানুষের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের সাথে একাত্ম হওয়া প্রয়োজন। শুধু নিজের রাজ্য বা জাতিসত্তার গণ্ডি নয়, সারা দেশের শোষিত মানুষের জন্য শোষণ উচ্ছেদের লড়াইয়ের সাথে যুক্ত হতে পারার মধ্যেই আছে মণিপুরের শোষিত মানুষের মুক্তির রাস্তা।