Breaking News

৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি! রামা কৈবর্ত-রহিম শেখের কী এল-গেল

 

প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলবল দেশ জুড়ে প্রচার চালাচ্ছেন, ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে তাঁরা ‘উন্নত’ দেশে পরিণত করে দেবেন। আপাতত ২০২৫ সালের মধ্যেই দেশকে পৌঁছে দেবেন ৫ ট্রিলিয়ন (লক্ষ কোটি) ডলারের অর্থনীতিতে।

দেশ যদি ‘উন্নত’ হয়, দেশের অর্থনীতি যদি দ্রুত হারে শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে তবে দেশবাসী হিসাবে সকলেরই ভাল লাগার কথা। কারণ, দেশের উন্নতি মানে তো দেশের মানুষের উন্নতি– তাদের ভাল থাকা, ভাল খাওয়া-পরা, শিক্ষা-চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি, বেকারদের কর্মসংস্থান।

প্রশ্ন হল, অর্থনীতির বৃদ্ধির সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক উন্নতির আদৌ কি কোনও সম্পর্ক আছে? এক কথায় বললে– না, নেই। তা হলে প্রধানমন্ত্রী আর্থিক বৃদ্ধির কথা এত গর্ব করে বলছেন কেন?

সেই উত্তর খোঁজার আগে দেখে নেওয়া যাক আর্থিক বৃদ্ধি বলতে কী বোঝায়। একটি নির্দিষ্ট বছরে দেশের সামগ্রিক পণ্য ও পরিষেবা ক্ষেত্রের মোট উৎপাদনই হল দেশের আর্থিক উৎপাদন। এই উৎপাদন পূর্ববর্তী বছরের নিরিখে যে হারে বাড়ে তাকে সেই দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার বলে। দেশের এই মোট উৎপাদনকেই প্রধানমন্ত্রী ৫ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছেন। বর্তমানে অর্থনীতির আনুমানিক বহর ৩.৫ লক্ষ কোটি ডলার। ২০২৫ সালের মধ্যে অর্থনীতিকে ৫ লক্ষ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না, সেই বিতর্কে আমরা যাব না। যদিও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের মতো প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বলেছেন, সেটা আদৌ সম্ভব নয়। কারণ তার জন্য বছরে বৃদ্ধির হার হওয়া দরকার কমপক্ষে ১৬ শতাংশ। বর্তমান বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল ৭.৮ শতাংশ। ফলে ব্যাপারটা যে অসম্ভব তা বলাই যায়। কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখন থাক।

ভারতের মতো একটি দেশে উৎপাদন হচ্ছে না, তা তো নয়। বরং কলে-কারখানায়, কৃষিতে, পরিষেবা ক্ষেত্রে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ তো উৎপাদন করে চলেছে। তাই উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। সেই উৎপাদন ৩.৫ লক্ষ কোটি থেকে ৪.৫ কিংবা ৫ লক্ষ কোটি ডলারে পরিণত হল, সেটাও বড় বিতর্কের বিষয় নয়। আসল কথা হল, কোটি কোটি মানুষ এই যে বিপুল পরিমাণে সম্পদ প্রতিদিন উৎপাদন করে চলেছে, তা যাচ্ছে কোথায়, তার ফল কে ভোগ করছে? শ্রমজীবী মানুষদের ভাগে তার কতটুকু পৌঁছচ্ছে? দেখা যাক সে হিসেবটা।

২০২৩ সালের অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলছে, মাত্র ৫ শতাংশ নাগরিকের হাতে জমা হয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৬০ শতাংশ। আর নিচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষের জন্য জুটেছে তার মাত্র ৩ শতাংশ। এই হিসেবই বলছে, সরকারের রাজস্ব আয়ের বেশির ভাগটাই আসে যে জিএসটি থেকে তার ৬৪ শতাংশ আসছে সমাজের সবচেয়ে নিচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষকে লুঠ করে। অথচ ওপরের তলার ১০ শতাংশ ধনী অংশ দেয় মাত্র ৩ শতাংশ জিএসটি। অক্সফ্যাম দেখাচ্ছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে শতকোটিপতির সংখ্যা ১০২ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৬। শুধু এই হিসেব থেকেই স্পষ্ট, প্রধানমন্ত্রীর কথিত এই বিপুল ধনবৃদ্ধির সঙ্গে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই। ধনবৃদ্ধি হয়েছে শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় ধনীরই। আর যারা দিবারাত্রি হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে এই বিপুল পরিমাণ উৎপাদন করে চলেছে, সরকারি রাজস্বের বেশির ভাগটাই জোগাচ্ছে, তারা কেমন আছে? তাদের বেশির ভাগেরই নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়। ঘরে আলো জ্বলে না, মাথার উপর ছাদ নেই, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া হয় না, বাবা-মা-সন্তানদের চিকিৎসা হয় না। কারণ মালিকরা তাদের নিঃশেষে খাটিয়ে নিলেও উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয় না। তাদের শ্রম চুরি করেই মালিক শ্রেণির এই সম্পদের পাহাড়। এই যে শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা, যেখানে পুঁজিপতিরা অবাধে শ্রমজীবী মানুষের শ্রম লুঠ করতে পারে, রাজ্যে রাজ্যে এবং কেন্দ্রে থাকা সরকারগুলি সেই ব্যবস্থার পাহারাদার বলেই। ভারতীয় ধনকুবেররা যখন কেউ বিশ্বে পঞ্চম স্থানে, কেউ দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে, সরকার তখন সভ্যতার আসল কারিগর একজন শ্রমিকের দৈনিক নূ্যনতম মজুরি ধার্য করেছে ১৭৮ টাকা। সেটুকু দিতেও বেশিরভাগ মালিক রাজি হয় না। তাই অর্থনীতির পরিমাণ যা-ই হোক, তাতে দেশের রামা কৈবর্ত-রহিম শেখের কিছুই যায়-আসে না।

বাস্তবে অর্থনীতির বৃদ্ধিই হোক, আর উন্নত দেশের তকমাই হোক, এ সবই মালিক শ্রেণি তথা শাসক শ্রেণির চোখ দিয়েই দেখা। কারণ, অন্য সব কিছুর মতোই উন্নয়ন বিচারের মাপকাঠিও দুটি– একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ শোষিত মানুষের জীবন-মানের সাপেক্ষে, আর একটি দেশের পুঁজিপতি-শিল্পপতি-ধনকুবেরদের পুঁজির আরও বৃদ্ধির সাপেক্ষে। যে হেতু সমাজটা শোষক ও শোষিত দুটি সুনির্দিষ্ট শ্রেণিতে বিভক্ত, তাই উন্নয়নের মাপকাঠিও শ্রেণি নিরপেক্ষ ভাবে একটিই হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর দলবল যে বৃদ্ধি আর উন্নয়নের দাবি করছেন তা আসলে এই দ্বিতীয় মাপকাঠিতেই মাপা।

বাস্তবে লোকসভা ভোটের আগে মোদি সরকারের সাফল্য তুলে ধরতেই দেশ জুড়ে একদিকে সরকার এবং অন্য দিকে বিজেপি ও আরএসএসের কর্মী বাহিনী এই উন্নয়নের স্বপ্ন ফেরি করতে নেমেছেন। কিন্তু তাতে কি কাজ হবে? এই দিয়ে তারা ভোলাতে চায় দেশের অন্নহীন, ক্ষুধার্ত, কর্মহীন, শিক্ষা-চিকিৎসাহীন বিরাট সংখ্যক দেশবাসীকে, ভোলাতে চায় তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা, ভোলাতে চায় প্রতি বছর ঋণের জালে জড়িয়ে আত্মহত্যা করা সহস্র কৃষকের পরিবারকে? কিন্তু এই দিয়ে কি সত্যিই তাদের ভোলানো যাবে? ভোলানো যে যাবে না তা বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরাও ভালই বোঝেন। তাই তো রামমন্দির নির্মাণের দেশজোড়া প্রচার, হিন্দুত্বের জিগির তোলার মরিয়া চেষ্টা।

স্বাভাবিক ভাবেই যত দিন যাচ্ছে, দেশের বেশিরভাগ শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্র, অনাহার, বেকারি বেড়েই চলেছে। সঙ্গে বাড়ছে মানুষের ক্ষোভ। আর সেই সব কিছুকে চাপা দিতেই সরকার তাদের নীতির সাফল্য বোঝাতে দেশের মানুষকে আর্থিক বৃদ্ধির, দেশের উন্নতির গল্প শোনাচ্ছে। অন্য দিকে তাদের লক্ষ্য, মানুষের এই ক্ষোভ যাতে বিক্ষোভের আকারে, আন্দোলনের আকারে, বিদ্রোহের আকারে ফেটে না পড়ে, তারা যাতে সংগঠিত হতে, সচেতন হতে না পারে। তার জন্যই ধর্মের জিগির, জাতপাতের জিগির, তার জন্যই মন্দির রাজনীতি, তার জন্যই ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো। শ্রমজীবী মানুষ শত ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকুক। মালিক শ্রেণিকে নয়, জাত-ধর্মের ভিত্তিতে অন্য শ্রমিককে শত্রু ভেবে যেন তারা পরস্পর লড়াই করে। তা হলেই মালিকরা নিশ্চিন্ত। দেশের শিক্ষিত ছাত্র-যুব সমাজ যাতে প্রশ্ন না করে, সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে আঙুল না তোলে তেমন করেই তাদের সিলেবাস তৈরি কর, ইতিহাসকে বিকৃত করে দাও, সমাজবিকাশের বৈজ্ঞানিক নিয়মগুলিকে ছাত্রদের জানতে দিও না। চন্দ্র অভিযানের সাফল্যকে শাসকের সাফল্য হিসাবে দেখাও, কিন্তু তার পিছনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুশৃঙ্খল দিকটি তাদের জানতে দিও না। একদিকে রামমন্দির নির্মাণ, গোমাতার পুজো, ইতিহাসের বিকৃতি, মানুষের ভাবনাকে পিছন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, অন্য দিকে দেশকে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখানো– বিজ্ঞানের কারিগরি দিক, অর্থনীতির সাফল্য আর আধ্যাত্মিক চিন্তার সংমিশ্রণ, এই তো ফ্যাসিবাদী শাসকের পরিপূর্ণ লক্ষণ। পুঁজিবাদ সব সময়ই তার আকণ্ঠ নিমগ্ন সঙ্কট থেকে রেহাই পেতে এই ফ্যাসিবাদেই শেষ আশ্রয় খোঁজে। পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস বিজেপি সরকারও তাই খুঁজছে। কিন্তু একই সঙ্গে শোষিত মানুষ, যাদের উপর পুঁজিপতি শ্রেণি সঙ্কটের সমস্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে, তারা এই সঙ্কটের হাঁসফাঁস অবস্থা থেকে চিরতরে রেহাই পেতে যথার্থ মুক্তির পথ খুঁজে চলেছে। সেই পথ গেছে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দিশায়। দেশে দেশে আজ তাই আবার সমাজতন্ত্রের স্লোগান তুলে পথে নামছে মুক্তিকামী শ্রমজীবী মানুষ।