দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১৭-র ৭ থেকে ১৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। দুনিয়ার প্রথম সফল সেই শ্রমিক বিপ্লবের ১০৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে গণদাবীর শ্রদ্ধার্ঘ্য।
উনিশ শতকের গোড়ায় রাশিয়ায় একদিকে জারের সরকার, তার শক্তিশালী আমলাতন্ত্র, অভিজাত সম্প্রদায় ও লক্ষ লক্ষ পদদলিত কৃষক, অন্য দিকে ক্রমবর্ধমান শিল্প বাণিজ্যের প্রসার। এ রকম আর্থ-সামাজিক অবস্থাতেই জারের বিরুদ্ধে রুশ দেশে বিপ্লব প্রচেষ্টার সূত্রপাত। রাশিয়ায় পশ্চিম ইউরোপ ফেরত রুশ সেনা বাহিনীর একদল অফিসার যাঁরা ফরাসি বিপ্লবের ভাবনা-ধারণায় অনুপ্রাণিত ছিলেন, তাঁদের নিয়েই প্রথমে রুশ দেশে গোপন বিপ্লবী দল গড়ে ওঠে। ১৮২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর এমনি একদল অফিসার রাশিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। ওই দলকেই বলা হয় ডিসেম্বরিস্ট। এর পরই জারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সেন্ট পিটারসবুর্গ, মস্কো প্রভৃতি বড় শহরে গড়ে উঠল গোপন বিপ্লবী চক্র। ১৮৭৬ সালে মাইকেল বাকুনিনের প্রভাবে গড়ে উঠল বিপ্লবী সমিতি।
গুপ্ত সমিতিগুলোর ধারাবাহিকতাতেই নারদনিক বা জনতাপন্থীদের আবির্ভাব
রুশ দেশের বিপ্লবের ইতিহাসে এই গুপ্ত সমিতিগুলোর ধারাবাহিকতাতেই নারদনিক বা জনতাপন্থীদের আবির্ভাব। প্রথম দিকে প্লেখানভও ছিলেন একজন নারদনিক। পরে বিদেশে গিয়ে মার্ক্সবাদের সংস্পর্শে এসে তিনি নারদবাদের বিরোধিতা করেন। তবে মার্ক্সের শিক্ষাকে যথার্থ উপলব্ধি করে নারদবাদের বিরুদ্ধে শেষ সফল আঘাতটি করেছিলেন লেনিন। সেই সময় নারদনিকদের উপর জারের পুলিশের চরম অত্যাচার নেমে আসে। নির্বাসন ও ফাঁসি দিয়ে নারদনিকদের মুছে ফেলার চেষ্টা হয়। সেন্ট পিটার্সবুর্গে নারদনিকদের মধ্যে যারা গোপন ষড়যন্ত্রমূলক কাজে সচেষ্ট ছিলেন তাদেরই একটি দলের নেতা ছিলেন লেনিনের দাদা আলেকজান্ডার উলিয়ানভ, যাঁকে জার সরকার ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে। প্লেখানভ সহ অনেকেই পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা বিদেশে কার্ল মার্ক্সের শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ইউরোপের শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন। নারদবাদের ভ্রান্তি উপলব্ধি করে সংগঠিত ও শ্রেণি সচেতন শ্রমিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা বুঝলেন। মার্ক্সবাদীরা নিজেদের যে নামে পরিচয় দিতেন সেই সোস্যাল ডেমোক্র্যাট নামে নিজেদের অভিহিত করলেন তারা। রুশ দেশে মার্ক্সবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৮৮৩ সালে তারা জেনেভাতে গঠন করলেন ‘শ্রমিকমুক্তি গোষ্ঠী।’
শ্রমিকমুক্তি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠার পর রাশিয়ার মাটিতেও মার্ক্সবাদের প্রচার করতে গিয়ে তাঁরা তৎকালীন রাশিয়ার প্রভাবশালী নারদবাদের চিন্তার কাছে বাধা পাচ্ছিলেন সবচাইতে বেশি। নারদনিকরা মনে করত ১) কৃষকরাই হল বিপ্লবের প্রধান শক্তি, কারণ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। একমাত্র কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমেই জারতন্ত্রকে উচ্ছেদ করা যাবে, ২) রাশিয়ায় পুঁজিবাদ একটি আকস্মিক বিষয়, সেখানে এর কোনও বিকাশ ঘটবে না এবং সর্বহারা শ্রেণিরও সেখানে বিকাশের কোনও সম্ভাবনা নেই, ৩) সর্বহারা বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণি নেতৃত্বকারী শ্রেণি নয়। ফলে তাঁরা শ্রমিক শ্রেণিকে বাদ দিয়েই সমাজতন্তে্রর চিন্তা করতেন, ৪) তাঁরা মনে করতেন শ্রেণি সংগ্রামের ফলে ইতিহাস সৃষ্টি হয় না, ইতিহাস সৃষ্টি করে কয়েকজন বীর। জনগণ এই বীরদের অনুসরণ করে মাত্র। এই চিন্তাকে আদর্শগত ভাবে পরাজিত করা ছিল জরুরি। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছিলেন লেনিন।
মার্ক্সবাদী পাঠচক্রের মাধ্যমে মার্ক্সবাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন লেনিন
নারদনিকদের এই ভুল চিন্তার বিরুদ্ধে প্লেখানভ বললেন– রুশ দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ইতিমধ্যেই হয়েছে, সেই বিকাশকে ঠেকানোর সাধ্য তাদের নেই, মূল কাজ হল পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে যে বিপ্লবী শক্তি জন্ম নিচ্ছে সেই শ্রমিক শ্রেণিকে সচেতন ও সংগঠিত করা। তাদের নিজস্ব পার্টি গড়ে তোলা। এক কথায় শ্রমিক শ্রেণিকে বিপ্লবে সামিল করা। ইতিমধ্যেই কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে এক বছরের জন্যে নির্বাসিত হন বিশ্ববিদ্যালয়েরই আইনের ছাত্র লেনিন। নির্বাসিত অবস্থায় ও তার পরবর্তী বছরগুলোতে গুপ্ত বেআইনি মার্ক্সবাদী পাঠচক্রের মাধ্যমে মার্ক্সবাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন লেনিন। সেন্ট পিটার্সবুর্গে তখন শ্রমিক আন্দোলন ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে। রেলওয়ে, খনি শিল্প ও বড় বড় কারখানায় শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষ। তাদের জীবন যেমন কষ্টের তেমনই দুর্দশার। দৈনিক কাজের সময় ১২-১৬ ঘণ্টা। ওই সময় শ্রমিকদের কোনও সংগঠন ছিল না। শ্রমিকদের প্রতিবাদ হত স্বতঃস্ফূর্ত। শোষণ ছিল নির্মম, শ্রমিক প্রতিবাদীদের উপর নেমে আসত কারাবাস, নির্বাসন ও প্রাণদণ্ড। এই অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে দিকে দিকে মাথা তুলছিলেন কারখানায় কারখানায় শ্রমিকরা। শ্রমিকদের সংগঠিত করতে মার্ক্সবাদীরাও সচেষ্ট হন। এই সময়ই লেনিন চেষ্টা করতে থাকেন শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে তুলতে।
শ্রমিক শ্রেণির দল তৈরির প্রচেষ্টা
১৮৯৪ সালের শেষ দিকে সেমিইয়ানিকভ কারখানায় অশান্তির সময় লেনিনের লেখা একটা ইস্তেহার বিতরণের পর তার ফলাফল দেখে মার্ক্সবাদীরা উৎসাহিত হলেন। তার পর নেভি বন্দরের শ্রমিক ধর্মঘটের সময় ‘ডক শ্রমিকদের লড়াই কিসের জন্য’ শিরোনামে আরও একটি ইস্তাহার শ্রমিকদের মধ্যে ও শহরের অন্যত্র ছড়িয়ে দেওয়া হল। এর ফলে নেভি বন্দরের ধর্মঘটী শ্রমিকরা জয়ী হলেন। লেনিন যখন সেন্ট পিটার্সবুর্গ আসেন, সেই সময় শ্রমিকদের ছোট ছোট মার্ক্সবাদী বেআইনি পাঠচক্রের মাধ্যমে মার্ক্সবাদ ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা হত, কিন্তু রাজনৈতিক প্রচারের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে মার্ক্সবাদ নিয়ে যাবার লেনিনের এই নব প্রচেষ্টায় শ্রমিকদের মধ্যে প্রাণের সাড়া জাগলো, প্রবল উৎসাহিত হলেন মার্ক্সবাদীরা।
১৮৯৫ সালে লেনিন সেন্ট পিটার্সবুর্গ-এর সমস্ত শ্রমিক পাঠচক্রকে ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তুললেন ‘শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি সংগ্রাম সংঘ।’ লেনিনের পরিচালনায় শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি সংগ্রাম সংঘ শ্রমিকদের পরিচালিত অর্থনৈতিক দাবি আদায়ের সংগ্রামের সঙ্গে জার শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামকে এক সূত্রে গ্রথিত করে, রাশিয়াতে সর্বপ্রথম শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐক্য সাধনের সূচনা করলেন। রাশিয়ার বিপ্লবীদের জীবনে এই ঘটনাটি সম্পর্কে লেনিন বলেছিলেন, ‘সেন্ট পিটার্সবুর্গের শ্রমিক শ্রেণির মুক্তিসংগ্রাম সংঘের গুরুত্ব হল শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতায় বিপ্লবী পার্টির সূত্রপাত।’ শুরু হল শ্রমিক শ্রেণির দল তৈরির প্রচেষ্টা। পার্টি কী ভাবে গড়ে তুলতে হবে তার সুনির্দিষ্ট বিশদ পরিকল্পনা উপস্থিত করে ১৯০১ সালে ইস্ক্রার সম্পাদকীয়তে ‘কোথা থেকে শুরু করতে হবে’– এই শিরোনামে লেনিন লিখলেন, পার্টি তৈরির ক্ষেত্রে একটি ‘সারা রুশ পত্রিকা’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। লেনিন বললেন, পত্রিকার মারফত খবর ছড়িয়ে দিতে হবে, পত্রিকার মারফত আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে, তারপরেও পত্রিকার দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না, পত্রিকার মাধ্যমে পার্টির সংগঠনও গড়ে তুলতে হবে। একজন শ্রমিক ইস্ক্রার দপ্তরে পাঠানো তার চিঠিতে লিখলেন, ‘আমার বিদ্যে অল্প, কিন্তু ইস্ক্রা পড়ে আমি জানতে পেরেছি সত্যটা কী। লিখলেন, মেহনতি মানুষ প্রচণ্ড তেতে আছে, শুধু একটি স্ফূলিঙ্গ এসে পড়ার অপেক্ষা, স্ফূলিঙ্গ থেকে জ্বলে উঠবে আগুন। আগেও কারখানায় হরতাল হত, কিন্তু সেটা ছিল ঘটনামাত্র। এখন শ্রমিকরা বুঝতে পারছে, শুধু একটা হরতাল হওয়াটা কিছু নয়, হরতালকে নিয়ে যেতে হবে রাজনৈতিক লড়াইয়ে। লেনিনের যুগটা সাম্রাজ্যবাদের যুগ। হাতে কলমে বিপ্লব করার যুগ। এই যুগে লেনিনীয় তত্ত্বই হল মার্ক্সবাদ। যাঁরা এটা বোঝেননি, তাদের বিরুদ্ধে প্রবল আদর্শগত সংগ্রাম চালাতে হয়েছিল। এই পথেই স্ট্যালিনের আবির্ভাব।
অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার ঘেরাটোপে শ্রমিক আন্দোলনকে আটকে ফেলার অর্থ মজুরি দাসত্বের জীবনকেই চূড়ান্ত মনে করা
রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের উপর মালিকরাও সর্বপ্রকার আক্রমণ বাড়াতে থাকে। আবার তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে শ্রমিক ধর্মঘট, শ্রমিক সংগ্রাম। ক্রমবর্ধমান এই শ্রমিক সংগ্রামের আবহেই এই সংগ্রাম দুটো ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে অর্থনীতিবাদীরা মনে করতেন শ্রমিকরা শুধু অর্থনৈতিক দাবি নিয়ে লড়বে, রাজনৈতিক সংগ্রামে তারা অংশগ্রহণ করবে না, রাজনৈতিক সংগ্রাম করবে উদারনৈতিক বুর্জোয়ারা। অন্য দিকে লেনিনের নেতৃত্বে যথার্থ মার্ক্সবাদীরা মনে করতেন অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার ঘেরাটোপের মধ্যে শ্রমিক আন্দোলনকে আটকে ফেলার অর্থ হল তাদের মজুরি দাসত্বের জীবনকেই চূড়ান্ত বলে মনে করা। তাই লেনিন বললেন, শ্রমিকদের শ্রেণি চেতনা যথার্থ রাজনৈতিক চেতনা ততক্ষণ হয়ে ওঠে না, যতক্ষণ না সে সব ধরনের স্বৈরাচার, নির্যাতন, হিংসা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য শিক্ষিত হয়। শ্রমিক শ্রেণির চেতনা যথার্থ রাজনৈতিক হতে পারে না, যদি শ্রমিকরা সুনির্দিষ্ট ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে, বিশেষ করে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে। তিনি বললেন, যদি তারা সমস্ত শ্রেণি, গোষ্ঠী ও জনগণের সমস্ত অংশের জীবনধারার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করতে না পারে, বস্তুবাদী বিশ্লেষণকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে না পারে– এই যথার্থ শ্রেণি চেতনা, রাজনৈতিক চেতনা শ্রমিক শ্রেণির অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া থেকে আপনা আপনি গড়ে উঠতে পারে না। এ প্রসঙ্গে লেনিন বললেন, ‘শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক শ্রেণি চেতনা একমাত্র বাইরে থেকে আসতে পারে। এর অর্থ হল, আসতে পারে একমাত্র অর্থনৈতিক সংগ্রামের বাইরে থেকে শ্রমিক ও মালিকের সংগ্রামের বাইরে থেকে। একমাত্র সমস্ত শ্রেণির মধ্যে সম্পর্কের ভিতর দিয়েই এই জ্ঞান অর্জন করা যেতে পারে। শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা দেওয়ার অর্থ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের (তখন কমিউনিস্টদের সোস্যাল ডেমোক্র্যাট বলা হত) অবশ্যই জনগণের সমস্ত শ্রেণির মধ্যে যেতে হবে। সমস্ত ক্ষেত্রেই তাদের অগ্রগামী বাহিনীকে পাঠাতে হবে। এ ভাবে লেনিন শ্রমিক আন্দোলনে রাজনৈতিক চেতনার গুরুত্ব সম্পর্কে তার বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ রেখেছেন। বলেছেন, চেতনার গুরুত্বকে খাটো করলে শ্রমিকদেরই অপমান করা হয়। পার্টির কাছে তত্তে্বর গুরুত্বকে খাটো করলে সেই হাতিয়ারটিকে খাটো করা হবে যার সাহায্যে পার্টি বর্তমানকে বুঝেছে, ভবিষ্যতকে দেখেছে। তাই লেনিন বলেলেন ‘বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন হতে পারে না। … যে পার্টি সব থেকে অগ্রসর তত্তে্বর দ্বারা চালিত একমাত্র সেই পার্টি পারে অগ্র্রবর্তী ভূমিকা পালন করতে।’
লেনিন রুশ দেশের শ্রমিক শ্রেণির প্রকৃত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন
প্রথম মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা নিয়ে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নেতাদের সাথে বিতর্কে লেনিন বললেন– নিজ নিজ দেশে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের স্বার্থে এক দেশের শ্রমিক অন্য দেশের শ্রমিকদের উপর গুলি চালাতে পারে না। তাদের দায়িত্ব হবে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধতা করা, যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে নিজ নিজ দেশে বিপ্লব সমাধা করার চেষ্টা করা। রুশ দেশের যে আসন্ন বিপ্লবের কথা লেনিন বলেছিলেন তার সূত্রপাত ১৯০৫-এর শুরুতেই। সারা রুশ দেশ হয়ে উঠল মিছিলে মিছিলে উত্তাল। ব্যারিকেড খাড়া হল শ্রমিকদের, রাস্তায় রাস্তায় জারের সৈন্যদের সঙ্গে চলতে থাকল সংঘর্ষ। রুশ দেশের শ্রমিকরা দুর্জয় সাহসে একজোট। তাদের দাবি এ বার আর অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক।
শ্রমিক আন্দোলনের এই উত্তাল তরঙ্গ রোধ করে এ সাধ্য কার? জারের সৈন্য মরিয়া হয়ে আক্রমণ করল। কয়েকশো শহিদের বুকের রক্তে আরও রাঙা হয়ে উঠল লাল ঝান্ডা। মে মাসে সারা দেশে ধর্মঘটী শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল দু’লক্ষেরও বেশি। ১৯০৫ সালের জুন মাসে বিদ্রোহ দেখা দিল পোটেমকিন যুদ্ধজাহাজে। যুদ্ধজাহাজটি ছিল ওডেসার কাছে আর ওডেসা শহরে চলছিল সাধারণ ধর্মঘট। যুদ্ধ জাহাজের অত্যাচারী অফিসারদের উপর প্রতিশোধ নিল বিদ্রোহী নাবিকরা। জারের হুকুমে আরও কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ এল প্রথম জাহাজের বিদ্রোহী নাবিকদের পরাস্ত করতে। কিন্তু বিদ্রোহী নাবিকদের উপর গুলি চালাতে অস্বীকার করল অন্য যুদ্ধজাহাজের নাবিকরা। বিদ্রোহের লাল নিশান উড়তে লাগল পোটেমকিনের মাস্তুলে। ওডেসার ধর্মঘটী মজুর আর পোটেমকিনের বিদ্রোহী নাবিক আগুনের অক্ষরে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করল রুশ দেশের বিপ্লবে।
১৯১৩ সালের গ্রীষ্মকালে সেন্ট পিটার্সবুর্গের ধাতু শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনে তিন হাজার শ্রমিকের উপস্থিতিতে বিপুল ভোটে জয়ী হলেন বলশেভিকরা। শ্রমিক শ্রেণি যে তাদেরই পক্ষে তার স্পষ্ট প্রমাণ যেমন পাওয়া গেল আবার লেনিনই যে রুশ দেশের শ্রমিকদের প্রকৃত নেতা তা উপলব্ধি করা গেল। ১৯১৪ সালের নভেম্বরে লেনিন লিখলেন ‘প্রাভদার শিক্ষায় হাজার হাজার শ্রেণি সচেতন শ্রমিক বেরিয়ে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে থেকেই গড়ে উঠবে নতুন নেতৃত্ব।’ পরে লিখেছিলেন প্রায় চল্লিশ হাজার শ্রমিক প্রাভদা কিনছেন, আরও অনেক বেশি সংখ্যক পড়ছেন। যুদ্ধ, কারাবাস, সাইবেরিয়ায় নির্বাসন ইত্যাদি কারণে যদি এই সংখ্যার পাঁচগুণ এমনকি দশগুণ শ্রমিকও ধ্বংস হয়ে যায় তা হলে শ্রমিকদের এই অংশটি কিছুতেই লোপ পেতে পারে না। এই অংশটি বেঁচে আছে। তাঁরা বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, জাতিদম্ভের বিরোধী। একমাত্র তাঁরাই দাঁড়িয়ে আছেন জনগণের মধ্যে জনগণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে। শোষিত নির্যাতিত ও শ্রমজীবীদের আন্তর্জাতিকতার পতাকা তাঁরাই উঁচুতে তুলে ধরেছেন। এই পতাকা তুলে ধরেই রুশ দেশের বলশেভিক সংগঠনগুলো মার্ক্সবাদকে বুকে বহন করে কমরেড লেনিনের শিক্ষায় শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিপুল বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলল। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক অংশ নিল ধর্মঘটে। একের পর এক শ্রমিক ধর্মঘট সাধারণ ধর্মঘটে পরিণত হল। ১৯০৫-এর বিপ্লবে অর্জিত কারখানা শ্রমিকদের গণকমিটি বা সোভিয়েতের সংগ্রামের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ১৯১৭-র নভেম্বরে গড়ে উঠল শ্রমিক ও সৈনিকদের সোভিয়েত বা গণকমিটি। প্যারি কমিউনের বিপ্লবের শিক্ষাও তাদের সামনে ছিল।
সোভিয়েতগুলিই ছিল নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার ভ্রূণ। লেনিনের নেতৃত্বে শ্রমিক ও সৈনিকদের সোভিয়েতগুলো গড়ে তুলল গণঅভ্যুত্থান। ৭ নভেম্বর থেকে ১৭ নভেম্বর দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনে বিশ্বের প্রথম শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল শোষিত মানুষের মুক্তি আন্দোলনের মহান দিশারী কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে। মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচারধারা আয়ত্ত করে মার্ক্সের শিক্ষার মূল নির্যাসকে উপলব্ধি করে সঠিকভাবে মার্ক্সবাদ প্রয়োগের মাধ্যমে সফল হল দুনিয়ায় সর্বপ্রথম শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লব। রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হল সমাজতন্ত্র– শোষণহীন এক সমাজ।