শান্তির ভেক ধরে যুদ্ধের সুযোগে মুনাফা শিকারে ব্যস্ত ভারতীয় পুঁজিও

গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ৪ নভেম্বর দেশ জুড়ে যুদ্ধবিরোধী দিবস পালিত হয় এস ইউ সি আই (সি)-র ডাকে। ছবিঃ কলেজ স্কোয়ার, কলকাতা।

ইউরোপে চলা যুদ্ধের অবসান চান তিনি, চান ‘শান্তি’। বললেন– ‘এটা যুদ্ধের সময় নয়।’ তিনি আরও বললেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আমরা সর্বদাই কথা চালিয়ে যাচ্ছি। উপস্থিত অপরজন বললেন, ২০২২-এর এপ্রিলে ইস্তানবুলে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির খসড়ার ভিত্তিতে আলোচনা করার জন্য তিনি সর্বদাই প্রস্তুত। দুই ‘শান্তির দূতের’ কী অপূর্ব কথোপকথন!

বক্তাদের চিনতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে না! গত ২২ থেকে ২৪ অক্টোবর রাশিয়ার কাজান শহরে অনুষ্ঠিত মূলত ৯টি দেশ নিয়ে গঠিত ব্রিকস গোষ্ঠীর সম্মেলনের প্রাক্কালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের এই কথাবার্তার মধ্যে একবারও যুদ্ধ থামাতে বলা হল কি? অবশ্যই না। সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার প্রধান পুটিন যদি তা নাও বলেন, শান্তির দূত হিসাবে পরিচয় দেওয়া নরেন্দ্র মোদিও তা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করলেন না কেন?

বিষয়টা বোঝার জন্য পর পর কয়েকটি তথ্যকে সাজিয়ে নিয়ে দেখা যাক। জেনে রাখা ভাল, নরেন্দ্র মোদি ব্রিকস সম্মেলনে যাওয়ার কিছুদিন আগে গিয়েছিলেন ইউক্রেন ও পোল্যান্ডে। ইউক্রেনে গিয়ে তিনি তাদের পাশে থাকার কথা বলেছেন। এরপর তিনি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে ‘কোয়াড’ সম্মেলন করেছেন। কোয়াডের মূল উদ্দেশ্য এশিয়ায় চিনের আধিপত্য রোখা। এ দিকে ব্রিকস গোষ্ঠীটি গড়ে উঠেছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জি-৭ গোষ্ঠীর পাল্টা অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির বাসনায়। যার অন্যতম দুই স্তম্ভ রাশিয়া এবং চিন। এর সদস্য প্রথমে ছিল ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। পরে যোগ হয়েছে মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। এতে যোগ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে সৌদি আরব সহ আরও ৩০টি দেশ। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির আহ্বানে অতিথি হিসাবে এমন বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ব্রিকস সম্মেলনে উপস্থিতও ছিলেন। কার্যত এটা ছিল ইউক্রেন যুদ্ধের দায়ে মার্কিন সামরিক জোট ন্যাটোর দ্বারা রাশিয়াকে একঘরে করার চেষ্টার বিরুদ্ধে পুটিনের শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ। অন্য দিকে ভারত। চিন, ইরান প্রত্যেকেরই স্বার্থ ছিল রাশিয়ার যুদ্ধের সুযোগে মুনাফা কুড়ানোর।

এই সম্মেলনে যাওয়ার আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি সমস্ত রকম সমর্থন দেওয়ার কথা জানিয়েছেন প্যালেস্টাইনের গাজায় গণহত্যা চালানো ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে, অন্য দিকে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার পক্ষেও তিনি কথা বলেছেন। বেশ জটিল ব্যাপার না? এই মুহূর্তে যে পক্ষগুলির মধ্যে যুদ্ধ চলছে তাদের সকলের সাথেই মোদিজি আলাদাভাবে কথা বলছেন এবং তাদের বিশেষ দাবিকে সমর্থন জানাচ্ছেন। অর্থাৎ বিপরীত স্বার্থবাহী যুদ্ধরত সব পক্ষের দিকেই তিনি আছেন! এমন কাজ যারা করে, তাদের বাংলা প্রচলিত বচনে যা বলা হয় সেটি না হয় উহ্যই থাক। কূটনীতি তো আর প্রচলিত বচন দিয়ে চলে না, তা চলে দেশের পুঁজিপতিদের ব্যবসায়িক স্বার্থের প্রয়োজন দিয়ে।

এর সঙ্গে আর একটি তথ্য জানা দরকার– নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি পরিচালিত সরকারের সাহায্যে ভারতীয় ধনকুবেরদের মালিকানায় চলা প্রিমিয়ার এক্সপ্লোসিভস, আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস লিমিটেড, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা মিউনিশনস ইন্ডিয়া লিমিটেড প্রভৃতি কোম্পানি ইজরায়েলে এমন অস্ত্র পাঠাচ্ছে যেগুলি প্যালেস্টাইনে গণহত্যা চালানোর কাজে লাগছে। আরও জানা গেছে, ইউক্রেন তাদের সৈন্যবাহিনীর জন্য যে গোলা ব্যবহার করছে তার বেশ কিছু অংশ ভারতীয় কোম্পানির তৈরি (দ্য হিন্দু, ১৭.০৯.২৪ এবং রয়টার্স ১৯.০৯.২৪)।

যদিও, প্রধানমন্ত্রী কাজান থেকে ফিরে আসার পর ২৫ অক্টোবর ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, ভারত যুদ্ধে নিরপেক্ষ নয়, শান্তির পক্ষে। একই দিনে তিনি সংসদের বিদেশ দপ্তর সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সামনে বলেছেন, ইজরায়েলে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। ৩০ হাজার ভারতীয় শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন। আরও ৯ হাজার শ্রমিক দুই দেশের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ইজরায়েলে গেছেন। এর সাথে পড়ুন আরও একটি তথ্য, রাশিয়া ভারতীয় শ্রমিকদের ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাজে নামিয়েছে বলে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের সূত্রই কিছুদিন আগে জানিয়েছে। হইচই হতে ভারত সরকার বলেছিল, তারা রাশিয়ার সাথে কথা বলে এই শ্রমিকদের যুদ্ধের কাজ থেকে মুক্ত করবে। জানা যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ভারতীয় কোম্পানি ইয়ন্ত্রা, বেসরকারি কোম্পানি মিউনিশনস ইন্ডিয়া, কল্যাণী স্ট্র্যাটেজিক সিস্টেমস প্রভৃতি সংস্থা ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি থেকে ‘২৪-এর জুলাইয়ের মধ্যে ১৩৫.২৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম চেক রিপাবলিক, ইতালি, স্পেন এবং স্লোভানিয়াতে পাঠিয়েছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিফেন্স স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ আরজান তারাপোর দেখিয়েছেন, এর আগে দু বছরে মাত্র ৩ মিলিয়ন ডলারের কম মূল্যের অস্ত্র ভারত থেকে এই দেশগুলোতে গেছে। তাঁর মতে, এই অস্ত্র ইউক্রেনের যুদ্ধে ব্যবহার করার ফলেই এর চাহিদা বেড়েছে। রয়টার্স দেখাচ্ছে, অস্ত্র রপ্তানির অনুমোদনহীনএকটি ইতালিয়ান কোম্পানি ‘এমইএস’ যে এই অস্ত্র ইউক্রেনে পাঠাচ্ছে তা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অজানা ছিল না। এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ইয়ন্ত্রার এক পূর্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন ২০২৩ অর্থবর্ষে অনামা যে কোম্পানিটির সাথে ইয়ন্ত্রার ব্যবসার নথি তাদের বার্ষিক আর্থিক রিপোর্টে দেওয়া হয়েছে সেটি হল গোপন অস্ত্র রপ্তানিতে যুক্ত এমইএস। এই তথ্য ইয়ন্ত্রা এবং এমইএস কেউই সরাসরি স্বীকার না করলেও অস্বীকারও করেনি। সেজন্যই বিপুল হারে রপ্তানি বাড়িয়েছে ভারতীয় কোম্পানিগুলি। কাস্টমসের তথ্যও এই মতকে সমর্থন করে (রয়টার্স, ১৯.০৯.২৪)। প্রসঙ্গত, অস্ত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে অবশ্যপালনীয় শর্ত থাকে যে দেশ অস্ত্র কিনছে তা একমাত্র তারাই ব্যবহার করবে। এর অন্যথা ঘটলে, অস্ত্র অন্য কোনও পক্ষকে তারা বিক্রি করলে বা অন্যভাবে সরবরাহ করলে রপ্তানিকারক দেশের কর্তব্য তা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া। ভারত সরকার এই আন্তর্জাতিক কর্তব্যটি করেনি কেন? ভারতীয় ধনকুবেরদের অস্ত্র ব্যবসাটি অক্ষুণ্ন রাখার তাগিদেই নয় কি? এ দিকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে মার্কিন সরকার ১৯টি ভারতীয় কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে রাশিয়াতে যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহের অভিযোগে। অর্থাৎ ভারতীয় পুঁজিপতিরা যুদ্ধরত দুই দেশকেই অস্ত্র ও সরঞ্জাম বেচছে। ৩০ আগস্ট এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং জানিয়েছিলেন, ভারত গত আর্থিক বছরে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের (এক বিলিয়ন ১০০ কোটি) অস্ত্র রপ্তানি করেছে। ২০২৯-এর মধ্যে তা বছরে ৬ বিলিয়ন ডলারে তা নিয়ে যেতে চান তাঁরা। এর সঙ্গে ইজরায়েল এবং রাশিয়া দুই প্রান্তের দুই যুদ্ধক্ষেত্রেই ভারতীয় শ্রমিকদের পাঠানো কী দেখাচ্ছে– ভারতীয় শাসকরা যুদ্ধ টিকিয়ে রাখার পক্ষে, না বন্ধ করার দিকে?

কী স্বার্থ ভারতীয় শাসকদের? যে স্বার্থে মার্কিন শাসকরা ইজরায়েলের যুদ্ধে মদত দিচ্ছেন, তা আরও নানা দেশে ছড়িয়ে পড়তে কার্যত সাহায্য করছেন। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করে চলার জন্য মার্কিন কর্তারা তাদের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটকে কাজে লাগিয়ে কোনওমতেই যুদ্ধবিরতি হতে দিতে রাজি নয়। একই ভাবে রাশিয়া এবং ব্রিটেন-জার্মানি-ফ্রান্সের মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি যুদ্ধে ইন্ধন দিচ্ছে নিজ নিজ স্বার্থে। এরা প্রত্যেকেই তাদের অস্ত্র ভাণ্ডার যেমন খালাস করতে চাইছে তেমনই চাইছে কৃষ্ণসাগর, ভূমধ্যসাগর, সহ পুরো বাণিজ্যপথে নিজেদের আধিপত্য। ইউক্রেনকে সামনে রেখে মার্কিন সামরিক জোট ন্যাটোর বিস্তৃতি চাইছে তারা। চাইছে বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে।

একইভাবে রাশিয়া চাইছে ন্যাটোর পাল্টা সামরিক জোট গড়তে। সমাজতন্ত্র ত্যাগ করে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে নাম লেখানো চিন চাইছে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’-এর মতো পরিকাঠামোর মধ্য দিয়ে নিজেদের আধিপত্য বাড়ানোর কাজে এই অস্থিরতাকে ব্যবহার করতে। ঠিক একইভাবে ভারতীয় শাসক পুঁজিপতি শ্রেণিও যুদ্ধ জিইয়ে রাখতে আগ্রহী। যুদ্ধই যদি না থাকে তাহলে ভারতীয় ধনকুবেরদের তৈরি অস্ত্র কিনবে কে? যদিও এটিই সব নয়, স্বার্থ আরও আছে– ভারতীয় পুঁজিপতিরাও ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য, ইজরায়েল হয়ে ইউরোপে সহজ বাণিজ্য পথ তৈরি ও তাতে আধিপত্য চায়। ফলে ইজরায়েলের আক্রমণ নিয়ে তারা চুপ থাকে।

তা হলে, ভারতীয় শাসকরা নিরপেক্ষ নয়, শান্তির পক্ষে– এ কথা কি সত্যি? একেবারেই নয়। সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি আমেরিকা, মার্কিন নেতৃত্বে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীদের জোট ন্যাটো কিংবা রাশিয়ার মতো ভারতও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র হিসাবে যুদ্ধের পক্ষে। অন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মতো তারও শত্রু শান্তি। ইউক্রেন এবং প্যালেস্টাইনের যুদ্ধ ভারতীয় ধনকুবেরদের অস্ত্র ব্যবসাকে চাঙ্গা করেছে। তেমনই, রাশিয়ার থেকে সস্তায় তেল নিয়ে তা শোধন করে দেশীয় এবং ইউরোপের বাজারে চড়া দামে বেচে বিপুল মুনাফা করছে ভারতীয় পুঁজিপতিরা। ভারতীয় শাসক শ্রেণি যথার্থই শান্তির পক্ষে থাকলে যুদ্ধ থেকে মুনাফা তোলার জন্য চুপ করে না থেকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ ধ্বনিত করত। বলত, যুদ্ধের ফলে একটি মৃত্যুও আমরা মানব না। তারা কখনওই তা বলেনি।

যুদ্ধ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অস্তিত্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা লেনিন দেখিয়েছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধের জন্ম দেয়। কোনও ভূখণ্ড দখলের থেকেও বর্তমান যুগে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে মূল লক্ষ্য হল বাজারের দখল। বাজার নিয়ে কাড়াকাড়ি এবং পরস্পরের মধ্যে বাজারের ভাগ বাঁটোয়ারার জন্যই পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের দেশগুলির শাসকরা পরস্পরের বিরুদ্ধে দুটি বিশ্বযুদ্ধ লড়েছে। এছাড়াও অসংখ্য ছোট ছোট আঞ্চলিক যুদ্ধেও তারা এ কারণেই লড়েছে। আজকের যুগে যুদ্ধে এমনকি জয় পরাজয় সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, যুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য অর্থনৈতিক। বিশ্বসাম্যবাদের মহান নেতা স্ট্যালিন দেখিয়েছিলেন, পুঁজিবাদী দেশগুলো শিল্পের সংকট কাটানোর জন্য অর্থনীতির সামরিকীকরণ ঘটিয়েছে। যুদ্ধ তাদের প্রয়োজন অর্থনীতিকে সংকট থেকে বাঁচানোর জন্যই। যতদিন সমাজতান্ত্রিক শিবির বিশ্বে ছিল ততদিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির প্রচারমাধ্যম বলত সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপরীতে ‘গণতান্ত্রিক’ (অর্থাৎ পুঁজিবাদী) দেশগুলির দ্বন্দে্বর ফলেই বিশ্বে যুদ্ধের বিপদ বর্তমান। সমাজতান্ত্রিক শিবির না থাকলে আর যুদ্ধের বিপদ থাকবে না। আজ সমাজতান্ত্রিক শিবির নেই, অথচ যুদ্ধের বিপদ বাড়ছে। যুদ্ধ যে পুঁজিবাদী দেশগুলির বাজার নিয়ে কাড়াকাড়ির পরিণামেই ঘটে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের অন্যান্য বিশ্লেষণের মতোই যুদ্ধ সংক্রান্ত এই বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ কতটা সঠিক তা আজকের পরিস্থিতি দেখিয়ে দিচ্ছে।

মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতীয় শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি পুঁজিবাদী অর্থে দুর্বল দেশগুলির ওপর আধিপত্য বিস্তারের আকাঙক্ষা নিয়ে তাদের সাথে নানা জোট-ব্লক তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে বাজার দখলের আকাঙক্ষায় ভারতীয় বুর্জোয়ারা তখন থেকেই কখনও বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের সাথে বোঝাপড়া করেছে কখনও তাদের সাথে দ্বন্দ্বে গেছে। তিনি ১৯৬২ সালেই দেখিয়েছেন– ‘প্রতিটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের এবং সেই অর্থে ভারতীয় পুঁজিবাদী রাষ্টে্রর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী ঝোঁক সুপ্ত রয়েছে– যা পুঁজিবাদী অর্থনীতির মধ্যেই নিহিত’ (সময়ের আহ্বান)। তিনি দেখিয়েছিলেন, যত দিন যাচ্ছে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা প্রকট হচ্ছে। আরও দেখিয়েছেন, ‘মিলিটারি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে সংকুচিত আভ্যন্তরীণ বাজারের় কৃত্রিম তেজিভাব বজায় রাখার এবং ভারতবর্ষের সামরিক শক্তিকে বাড়িয়ে তোলার প্রয়োজনেই ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি যত দীর্ঘ সময় সম্ভব চিনের সাথে সীমান্ত সমস্যা, পাকিস্তানের সাথে কাশ্মীর সমস্যা এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সাথে তার নানান বিতর্কিত বিষয়কে জিইয়ে রাখার পথে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক যে অর্থনীতির সংকট যত তীব্র হবে, জনসাধারণের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে দিতে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে শাসক শ্রেণি তত বেশি করে এই সব বিষয় নিয়ে হইচই করবে’ (ওই)।

এই শিক্ষার আলোয় ভারতের বর্তমান শাসকদের আচরণ মিলিয়ে দেখলে কী বোঝা যাচ্ছে? ব্রিকস সম্মেলনে তারা রাশিয়ার সাথে বসে ডলারের বদলে টাকা বা রুবলে বাণিজ্যের জন্য মাথা ঘামিয়েছে। যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার সুযোগে সস্তায় পাওয়া তেল কী ভাবে ভারত এবং চিন উভয়েই সহজে পেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেছে। যে কারণে এই বৈঠকের একেবারে পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ করেই নরেন্দ্র মোদি ও শি জিন পিং একত্রে বসে চিন-ভারত সীমান্ত বিরোধে আপাতত বিরতির বার্তা দিয়েছেন। তার কিছুদিন আগেই মার্কিন কর্তাদের সাথে বসে কোয়াড গোষ্ঠীর বৈঠকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনের আধিপত্য রোখার ব্যাপারে তারা ছক কষেছে। আবার এই সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানে গিয়ে ভারতের বিদেশমন্ত্রী সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে চিন, রাশিয়া সহ কাজাখস্তান, ইরান, বেলোরুশের মতো দেশের সাথে বৈঠক করে বাণিজ্যের চেষ্টা করেছেন। এরা সকলেই শান্তির বাণী দেয়, কিন্তু আস্তিনে লুকোনো থাকে তীক্ষ্ণ ছুরি। সুযোগ পেলেই একে অপরকে আক্রমণ করে। কখনও সরাসরি যুদ্ধে, কখনও বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।

ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজি মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকায় সাম্রাজ্যবাদী থাবা বসাচ্ছে। ফলে নানা দেশে ভারতীয় এই পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সাধারণভাবে ভারত বিরোধী বিক্ষোভ হিসাবে সামনে আসছে। এশিয়ার প্রায় সব প্রতিবেশী দেশের জনগণের মধ্যে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির এই ভূমিকার বিরুদ্ধে বিপুল ক্ষোভ আছে। সম্প্রতি আফ্রিকার কেনিয়ায় আদানি গোষ্ঠীর লগ্নির বিরুদ্ধে সে দেশের মানুষের ক্ষোভের কথা সামনে এসেছে। একচেটিয়া সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির এই আধিপত্যের চেষ্টার সাথে ভারতীয় জনগণের উন্নতি কিংবা গর্বের কোনও সম্পর্ক নেই। টাটা-রিলায়েন্স-আদানিদের বিদেশি লগ্নি ভারতীয় জনগণের জীবনে সমৃদ্ধি আনে না। বরং ভারতীয় শাসক শ্রেণির এই প্রতিভূরা তাদের তাঁবেদার সরকারের সাহায্যে ভারতের জনগণকেও তীব্র শোষণে ছিবড়ে করে দেয়। অন্যদিকে তারা যুদ্ধ থেকেও মুনাফা তোলে। জানা যাচ্ছে যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার ওপর আমেরিকা, ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা থাকার ফলে ভারতীয় কোম্পানিগুলো অতি সস্তায় রাশিয়া থেকে যে তেল আমদানি করেছে তা শোধনের পর চড়া দামে ইউরোপের বাজারেই বেচে আরবের তেল মার্চেন্টদের সম্মিলিত লাভের থেকেও বেশি কামিয়েছে। কিন্তু এর জন্য ভারতীয় জনগণের কী লাভটা হয়েছে? তারা কি সস্তায় তেল পেয়েছে? রিলায়েন্স-এসার-আদানিদের লাভের ফলে কি দেশের মানুষের রোজগার বেড়েছে বা কর্মসংস্থানের কোনও সুরাহা হয়েছে? কিছুই হয়নি। বরং মূল্যবৃদ্ধির বোঝা মানুষের জীবন জেরবার করে দিচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, অতি সামান্য মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে অধিকাংশ ভারতীয় শ্রমিক। নরেন্দ্র মোদি সাহেবের নিজভূমি গুজরাট থেকেই কাজের সন্ধানে হাজার হাজার মানুষ আমেরিকার সীমান্ত বেআইনিভাবে পেরোতে গিয়ে ধরা পড়ছেন। ইজরায়েলে, রাশিয়াতে যুদ্ধের বিপদের কথা জেনেও ভারতীয় শ্রমিকরা একটু বাড়তি বেতনের আশায় ছুটছেন। ভারত আজ মানব পাচারের অন্যতম হটস্পট বলে চিহ্নিত। এ দেশের অসহায় যুবক-যুবতীরা পাচারকারীদের সহজ শিকার।

মোদিজি যে শান্তির বাণী শুনিয়েছেন, তা অন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে ভারতীয় একচেটিয়া মালিকদের আপাত শান্তির সাথে যুক্ত। দেশের জনগণের জীবনে শান্তি এনে দেওয়ার সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই।