কাশ্মীর প্রধানত একটি পর্যটনপ্রধান রাজ্য হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত হলেও, এর মূল অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে কৃষির উপর। বিশেষ করে আপেল চাষের উপর। বছরের পর বছর কাশ্মীরের মানুষ হাজার হাজার বর্গ-কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আপেল চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
তাঁদেরই একজন মহম্মদ সফী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আপেল চাষিরা এক ভয়ঙ্কর আক্রমণের মুখে। সদ্য পরাজিত পূর্বতন বিজেপি পরিচালিত কাশ্মীর সরকার সারা রাজ্য জুড়ে রেললাইন পাতা শুরু করেছে। বলা হচ্ছে এতে নাকি কাশ্মীরের পর্যটন ও শিল্পায়ন আরও বিকশিত হবে। এদিকে এর জন্য বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করছে সরকার। ফলে আপেল চাষিরা বিপন্ন হয়ে পড়েছেন।
অবসরপ্রাপ্ত ভেটেরিনারি সার্জেন এবং জামরুটের বাসিন্দা পিয়ার সিং-এর কথায় গ্রামের অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষি ও দুধ খামারের ওপর নির্ভরশীল। জমি হারালে তারা অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। জীবিকা হারাচ্ছেন, পথে বসছেন গ্রামের মানুষ।
ঠিক একই কথা মহম্মদ শফিরও, যার জমির উপর দিয়ে এখন চলে গেছে কংক্রিটের রেলপোল। এখন এই জমির মালিক সরকার, যারা জমি অধিগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নের নামে এখান থেকে মহম্মদ শফির মতো আরও অনেক কৃষককে উৎখাত করবে।
আপেল চাষিরা উদ্বিগ্ন। কাশ্মীরের মোট আয়ের বেশ বড় অংশ আসে এই আপেল চাষ থেকে। বহু পরিবারের জীবন ও জীবিকা এই আপেল চাষের উপর নির্ভর করে আছে। কিন্তু সেই আপেল চাষই এখন ধ্বংসের মুখে। জমি অধিগ্রহণ হওয়া সত্তে্বও এখানকার মানুষ আন্দোলন তো দূর, প্রতিবাদ করতেও পারছেন না। প্রতিবাদ করলেই মারধোর, পুলিশি ও মিলিটারি অত্যাচার আর দেশদ্রোহীর তকমা। সরকারকে জিজ্ঞেস করা হলে তাদের একটাই উত্তর– ক্ষতিপূরণ তো দেওয়া হবে। কী ক্ষতিপূরণ, কত ক্ষতিপূরণ, আদৌ সেই ক্ষতিপূরণ সবাই পাবে কি না, কবে থেকে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, সেই ক্ষতিপূরণ কতটা ন্যায্য ইত্যাদি প্রশ্নের় সরকারের কোনও উত্তর নেই।
অনেকেই মনে করেন রেল, সড়ক ইত্যাদি পরিকাঠামোগত উন্নয়ন মানেই সামগ্রিক উন্নতির সুযোগ খুলে দেওয়া। বাস্তব কি তাই? এ দেশে সড়ক, রেল, শিল্প যাই হোক না কেন তাতে কিছু লোকের উন্নতি, রোজগার হয় না এমন নয়। কিন্তু এর মূল লক্ষ্য থাকে পুঁজিপতি শ্রেণির উন্নয়ন। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দৃষ্টিতে বলা যেতে পারে– ‘কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোড় পেলি বল’?
২০১৯-এর ৫ আগস্ট মোদি সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়। তখন থেকে তা কেন্দ্রশাসিত এলাকা হয়ে গেছে। ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ ধারার অবলুপ্তির পর বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজি মালিকরা সেখানকার জমির দখল নেওয়ার আশায় লালায়িত। মাঝারি কৃষকদের উচ্ছেদ করে তারা বড় বড় ফার্ম করবে। রেল সেই ফার্মের পণ্যপরিবহণে সাহায্য করবে– এই তাদের আশা। এর সাথে আছে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে তাদের লাভের হিসাব। জনগণ জমি দেবে, লাভে তুলবে কর্পোরেট মালিক। একেই বলে পুঁজিবাদী উন্নয়ন।
দেশের অন্যান্য অংশের মতো কাশ্মীরও তার ব্যতিক্রম নয়। ৩৭০ ধারা রদ করেই মোদি সরকার দাবি করেছিল কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ প্রচুর কাজ পাবে, পাবে শিল্পায়নের সুবিধা, আর পাবে সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে সুরক্ষা। বর্তমানে এই তিনটিই আকাশকুসুম হয়ে থেকে গেছে, বরং বেড়েছে মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ। বেড়েছে প্রতিবাদী মানুষকে গ্রেপ্তার ও তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা। ফলে আজ এই আপেল চাষিরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত তাই নয়, তাদের বেঁচে থাকা মারাত্মক সঙ্কটের মুখে।
কাশ্মীরী পরিবেশকর্মী রাজা মুজাফফর ভাটের কথায়– ‘হ্যাঁ, রেললাইনের প্রয়োজন অবশ্যই। কিন্তু শোপিয়ান, অনন্তনাগ এবং অন্যান্য জেলার মধ্য দিয়ে রেললাইনের জন্য প্রচুর গাছ কাটা পড়বে, যা এই অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষের জীবিকাকে ঝুঁকিতে ফেলবে। তিনি আরও বলেন– ‘এই রেললাইন কোনও সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরামর্শ না করে, কথা না বলে, তাদের মতামত না নিয়েই করা হয়েছে, যা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সম্পূর্ণ বিরোধী।’ দিল্লি পরিচালিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কাশ্মীর আর কাশ্মীরীদের জন্য নেই।
বোঝা যাচ্ছে কাশ্মীরের শীতল হাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। জীবন-জীবিকা হারানোর মুখে দাঁড়িয়ে যে কোনও সময় মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়বে। কারণ পেট বড় বালাই।