বিচারের অঙ্গীকারে বহ্নিশিখারা

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘শাড়িমোড়া যেন আনন্দশ্রী, দেখ বাংলার নারী/দেখনি এখনও ওঁরাই হবেন অসি-লতা-তরবারি।’ ২৯ আগস্ট নজরুল স্মরণদিবসে কলকাতার রাজপথে শাণিত তরবারির মতোই ঝলসে উঠলেন বাংলার হাজার হাজার নারী, রাজপথের কংক্রিট কেঁপে উঠল তাঁদের সম্মিলিত কণ্ঠের আওয়াজে– ‘আমরা বিচার চাই। উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ আরজি কর হাসপাতালের ভয়াবহ ধর্ষণ ও খুনের বিচার চেয়ে এই বিশেষ দিনটিতে প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন এই রাজ্যের মহিলারা, শিরোনামে ছিল বিদ্রোহী কবির সেই স্মরণীয় আহ্বান– ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’।

শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে অধিকার অর্জনের পথ নারীদের জন্য বরাবরই বেশ কঠিন, দুর্গম। তবু সেই কঠিন পথ ধরেই যুগে যুগে দেশে-বিদেশে নারীরা এগিয়েছেন, সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছেন, হয়ে উঠেছেন সংগ্রামের প্রেরণা। অথচ যাদের সুস্থ-সুন্দর আলোকিত জীবন, সমাজে মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার দাবিতে তাঁদের এই সংগ্রাম, সেই মেয়েদের আজও প্রতিনিয়ত লড়তে হয় একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য। একবিংশ শতাব্দীতে এই কলকাতার বুকে, স্বাধীনতার মাসেই নারকীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে নিজের কর্মক্ষেত্র হাসপাতালের মধ্যে ধর্ষিত এবং খুন হলেন এক চিকিৎসক তরুণী। বরাবরের মতোই সরকার-পুলিশ-প্রশাসন দ্রুত অপরাধীদের খুঁজে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার বদলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অপরাধীদের আড়াল করতে। নানা টালবাহানায় ক্রমশ বিলম্বিত হতে থাকছে ন্যায়বিচার। অন্য দিকে এই সুযোগে ক্ষমতার গদি দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সেইসব রাজনৈতিক দল, যাদের নিজেদের শাসনাধীন রাজ্যে নারী সুরক্ষার চেহারা ভয়াবহ। এই কুৎসিত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির আবহে আন্দোলনের ব্যাটন হাতে তুলে নিয়েছেন এই রাজ্যের সচেতন গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ। প্রতিদিন অজস্র সভা, মিছিল, অবরোধ থেকে আওয়াজ উঠছে– ‘আমরা বিচার চাই। ধর্ষকের শাস্তি চাই’। এই দাবিতেই ২৯ আগস্ট মহিলাদের ডাকে ‘অঙ্গীকার যাত্রা’ দেখিয়ে দিল, স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর পার করে নারীদের যখন বিচার চেয়ে, নিরাপত্তা চেয়ে পথে নামতে হয়, তাঁরা এমন তুফান তুলেই পথে নামেন।

ভাদ্রের কড়া রোদ উপেক্ষা করে কলেজ স্কোয়ার প্রাঙ্গণে সে দিন জড়ো হচ্ছিলেন হাজার হাজার মহিলা। রাজ্যের প্রান্ত প্রত্যন্ত থেকে, গ্রাম-শহর-মফস্বল থেকে এসেছেন তাঁরা। মঞ্চে বক্তব্য রাখলেন এই কর্মসূচির অন্যতম আহ্বায়ক চিত্র পরিচালক শতরূপা সান্যাল, প্রাক্তন অধ্যক্ষা মৈত্রেয়ী বর্ধন রায়, অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ, অধ্যাপিকা ডাঃ নূপুর ব্যানার্জী, জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের নেত্রী ভাস্বতী মুখার্জী, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব অনিতা রায় প্রমুখ। এ দেশের বুকে যে মানুষটি মেয়েদের শিক্ষার জন্য, তাঁদের অন্ধকারময় জীবনের অবসানের জন্য জীবনপণ করে লড়েছিলেন, সেই বিদ্যাসাগরের মূর্তির পাদদেশ থেকে শুরু হল পথচলা। কারও কোলে শিশুসন্তান, কেউ খুঁড়িয়ে হাঁটছেন লাঠি নিয়ে, কেউ অসুস্থ শরীরে হাঁপিয়ে পড়ছেন, একটু থেমেই আবার চলা শুরু করছেন দ্বিগুণ উৎসাহে। হালিশহর থেকে এসেছিলেন বছর দুইয়ের ছেলেকোলে এক তরুণী। তাঁর ঘামে ভেজা মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। এক প্রৌঢ়া বলে ওঠেন, ‘কষ্ট হলেও আসতেই হবে। এ আমাদের বিচার পাওয়ার লড়াই।’ অশীতিপর এক বৃদ্ধা হাঁটছিলেন থেমে থেমে। ‘হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না মাসিমা’? মলিন আটপৌরে শাড়ি পরা ক্ষীণ দেহে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়– ‘যত কষ্ট হোক, আসব, আবার আসব। এ রকম অন্যায়ের একটা বিচার কেন হবে না? আমার মেয়েকে যারা এ ভাবে মারল, তাদের শাস্তি হবে না’? অভয়া বা তিলোত্তমা যে নামেই ডাকি, আর জি করের নির্যাতিতা মেয়েটি এ ভাবেই আজ ঘরে ঘরে প্রতিটি মায়ের মেয়ে হয়ে উঠেছেন। মা-বোনেরা যেন নিজের সন্তান হারানোর শোক বুকে নিয়ে পথে নেমেছেন বিচারের দাবিতে। সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা, একটি স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা হাঁটছিলেন অন্য একজন মহিলার হাত ধরে। ‘এই বয়সেও মিছিলে এসেছেন’? প্রশ্ন শুনে তিনি বলেন, ‘বয়সটা কোনও বিষয় নয় ভাই। আজও যদি পথে না নামি, আর কবে, কিসের জন্য নামব বলো’!

দু’পাশের ফুটপাত ছাপিয়ে মহিলাদের ঢল নামছে রাস্তায়, মিছিলের শেষ যখন পৌঁছে গেছে শ্যামবাজার, শেষ প্রান্ত তখনও হেদুয়া পার করেনি। কে নেই মিছিলে? শিক্ষিকা, অধ্যাপিকা, নার্স, আইনজীবী, চিকিৎসক যেমন আছেন, তেমনই আছেন আশাকর্মীদের সংগঠন, পরিচারিকাদের সংগঠন সহ নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের মহিলারা। যেদিকে চোখ যায়, আকাশের দিকে মুষ্টিবদ্ধ হাত আর সহস্র কণ্ঠের সম্মিলিত স্লোগান। যে মেয়েটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে ফুটে ওঠার আগেই ঝরে গেল অমানুষিক বর্বরতার বলি হয়ে, তার সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা হাজার কণ্ঠের দ্রোহের চিৎকার হয়ে উঠেছে সেদিন। অন্যের যন্ত্রণা বুকে বহন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠলে যে অপূর্ব চরিত্র সৃষ্টি হয়, তারই স্বাক্ষর দেখল এ দিনের কলকাতা। কলেজ স্ট্রিট, বিবেকানন্দ রোড, হাতিবাগান ধরে মিছিল যখন এগোচ্ছে, দু-পাশের দোকান, বাড়ির বারান্দা, ছাদ থেকে সাগ্রহে দাঁড়িয়ে দেখেছেন অজস্র মানুষ। এ তাঁদেরও কথা, তাঁদেরও দাবি।

আরজি করের ঘটনা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। সেই ঘটনার পর বিগত কুড়ি দিনে দেশ জুড়ে ঘটে গেছে আরও অজস্র ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, হত্যা। যে দেশে প্রতি পনেরো মিনিটে একজন করে নারী ধর্ষিতা হন, যে দেশের রাজ্যে রাজ্যে প্রতিদিন ঘটে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, নারী পাচারের ঘটনা, সেই দেশে মেয়েদের সুস্থ মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার অর্জন আরও বহু দূরের পথ। কিন্তু এই দিনের অঙ্গীকার যাত্রা দেখিয়ে দিল, সে পথের শেষ না দেখা পর্যন্ত মেয়েরা রাস্তা ছাড়বেন না। নজরুলের ছবি হাতে নিয়ে তাঁর প্রয়াণ দিবসে যে অঙ্গীকার যাত্রায় তাঁরা সামিল হয়েছেন, আগামী দিনে স্ফূলিঙ্গ থেকে দাবানলের মতো তা ছড়িয়ে পড়বে পাড়ায় পাড়ায়, শহরে, গঞ্জে, দেশে। এই অঙ্গীকার আরজি করের নির্যাতিতার ন্যায়বিচার পাওয়ার অঙ্গীকার, নারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষার অঙ্গীকার। যে সমাজ ধর্ষক তৈরি করছে, অপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে তাকে ভাঙারও অঙ্গীকার। প্রতিবাদের শক্তি, প্রতিবাদের আনন্দ নতুন করে অনুভব করছেন এই শহরের, রাজ্যের মানুষ।